পৃথিবীর সবাইই কোনো না কোনো বিশ্বাসে বিশ্বাসী। হোক সেটা মূল ধারার ধর্মবিশ্বাস বা আধাত্ম্যবাদ কিংবা প্রকৃতিবাদ। মোটা দাগে এসব বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। কারণ এখানেও মত এবং পথের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। কারণ আধাত্ম্যবাদের সাথে দর্শন অনেকক্ষেত্রেই সম্পর্কিত যা মূলধারার ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
অনেকেই বিশ্বাস করে ধর্ম তাদেরকে যে বার্তা দেয় তার নিগূঢ় অর্থ আছে। সেই অর্থ অনুসন্ধান করে তারা সেটার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা তৈরি করে। ‘কাব্বালাহ’ সেরকমই একটি মতবাদ। যার মূল নিহিত রয়েছে ইহুদিদের ধর্মবিশ্বাসের ভেতর। যদিও মূলধারার ধর্মবিশ্বাসের ভেতর মরমী তত্ত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তথাপি ইহুদি এবং খ্রিস্টানধর্মের কিছু অলৌকিক ঘটনা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মোজেস (ইসলাম ধর্মে মুসা (আঃ))-এর সাপকে লাঠিতে পরিণত করা, জ্যাকব (ইসলাম ধর্মে ইয়াকুব (আঃ))-এর স্বর্গীয় দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্তি, কিং ডেভিড (ইসলাম ধর্মে দাউদ (আঃ))-এর জেরুজালেমে প্রবেশের সময়ের ঘটনা-এই সবই মরমী দিককে তুলে ধরে। তবে ‘কাব্বালাহ’ মতবাদের পেছনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করে এজকেইলের ঈশ্বরের সিংহাসন-রথ দর্শনের ঘটনা।
কাব্বালাহ’র উত্থানের ইতিহাস বহু পুরোনো। একে ‘তোরাহ’-র মৌখিক সংস্করণও বলা যেতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, তোরাহ কি? ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়কে বলা হয় তোরাহ।
মোজেস (ইসলাম ধর্মে মুসা (আঃ)) সিনাই উপত্যকায় ঈশ্বরের সাথে তার অনুসারীদের চুক্তি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে এই ঘটনা নিয়েই ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ রচিত হয়। তবে তোরাহ’য় যেসব নির্দেশনা বা আলোচনা রয়েছে তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে।
বেশিরভাগই গ্রহণ করে সরাসরি নির্দেশনা আর স্বল্পসংখ্যক লোক অনুসন্ধান করে এর নিগূঢ় তত্ত্ব। আর এভাবেই গড়ে ওঠে ইহুদি ধর্মবিশ্বাসের একটি মরমী শাখা যার নাম দেয়া হয় ‘কাব্বালাহ’।
কাবালিস্ট সাধকরা বিশ্বাস করেন এর মূল অ্যাডাম (ইসলাম ধর্মে আদম (আঃ))-এর সময়কাল থেকে উৎসারিত। মরমী তত্ত্বে বিশ্বাসীদের জন্য এই বিশ্বাস অমূলক নয়।
কাব্বালাহ’র প্রাচীন শিকড়ের সন্ধান পাওয়া যায় প্রথম শতাব্দীতে, প্যালেস্টাইনে (ফিলিস্তিন)। সেই সময় সেখানে রোমান শাসন চলছিল। প্যালেস্টাইনের (ফিলিস্তিন) অধিবাসীদের ভাষা ছিল আরামিক। এই আরামিক ভাষাতেই রচিত হয় কাব্বালাহ’র উৎস হিসেবে বিবেচিত গ্রন্থ ‘জোহার’।
দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইহুদিদের উপর রোমানদের নির্যাতন বাড়তে থাকলে ইহুদি যাজক সিমোন বার ওচাই তার পুত্রকে নিয়ে গুহায় আত্মগোপন করেন এবং তোরাহ চর্চা অব্যাহত রাখেন।
প্রায় এক যুগ পর তিনি তোরাহ’র একটি তাফসির রচনা করেন এবং এর নাম দেন ‘জোহার’ অর্থাৎ জ্যোতি। এটি কোনো একক গ্রন্থ নয় বরং কতগুলো গ্রন্থের সমষ্টি।
তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি ‘সেফের ইয়েৎযিরা’ (সৃষ্টি রহস্যের গ্রন্থ) নামক গ্রন্থটি প্রভাব বিস্তার করে। এই বইয়ে সৃষ্টি রহস্যের সাথে ঈশ্বরের ১০টি স্বর্গীয় সংখ্যা এবং হিব্রু বর্ণমালার ২২টি অক্ষরের সংযুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়। এদের একত্রে ‘গোপন জ্ঞানের ৩২টি পথ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১২ শতকে ‘সেফের হা বাহির’ (জ্যোতিময় গ্রন্থ) গ্রন্থটি কাব্বালাহ মতবাদকে উন্নীত করায় বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। ১৩ শতকে মেসেস দ্য লিওন সিমোন বার ওচাই রচিত ‘জোহার’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।
এরপর দুই ধারায় চর্চা এগিয়ে যায়। স্প্যানিশ এবং লুরিয়ানিক ধারার মধ্যে সূচনা ঘটে স্প্যানিশ ধারায় এবং জনপ্রিয়তা পায় লুরিয়ানিক ধারায়।
স্প্যানিশ কাব্বালাহ- ‘সেফের হা টেমুনা’ গ্রন্থটি পরবর্তী শতকে স্পেনে বিস্তার লাভ করে এবং তোরাহ’র ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা দান করে। স্পেন থেকেই ‘সেফের হা জোহার’ বইটি উদ্ভুত হয়।
সৃষ্টিরহস্য, আত্মা, পাপ, আধ্যাত্ম্য এসব নিয়ে এখানে আলোচনা রয়েছে। স্পেনে ইহুদিদের উপর রোমানদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে তাদের আশ্রয় দান করেন তুর্কি শাসক। তাই পরোক্ষভাবে এই মতবাদ চর্চায় মুসলমানদেরও ভূমিকা আছে। সেখানে নির্বিঘ্নে তারা তাদের চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে।
লুরিয়ানিক কাব্বালাহ-১৬ শতকের মাঝামাঝি লুরিয়ানিক কাব্বালাহ বিস্তার লাভ করে। ইসাক বেন সলোমন লুরিয়া ছিলেন একজন কাবালিস্ট এবং ইহুদি পণ্ডিত। তিনি তার সময়ে কাব্বালাহ চর্চাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান।
১৮ শতকের শেষ দিকে এসে কাব্বালাহ মতবাদটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এখনও এটি চলমান। আব্রাহাম আইজাক কুক ১৯ শতকের গোড়ার দিকে কাব্বালাহ মতবাদকে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রাখেন।
কাব্বালাহ যেহেতু অতিন্দ্রীয়বাদের সাথে সম্পর্কিত তাই এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে নশ্বর মানবের অবিনশ্বর আত্মা। এই আত্মার তিনিটি স্তর। এগুলো হলো:
- নেফেস
- রুয়াক
- নিশামাহ
নেফেস হচ্ছে পাপ-পঙ্কিলতায় প্ররোচিত সত্তা। রুয়াক বিশুদ্ধ সত্তা এবং নিশামাহ হচ্ছে এমন একটি স্তর যাতে পৌঁছাতে প্রচুর জ্ঞান, অধ্যাবসায় এবং একাগ্রতা প্রয়োজন। কাবালিস্টরা মূলত এই বিষয়গুলোকে অগ্রধিকার দিয়ে জ্ঞানচর্চা করে।
তবে মূলধারার ‘কাব্বালাহ’ চর্চার জন্য হিব্রুভাষা আয়ত্ত করা আবশ্যক। কেননা ঈশ্বরের দশটি স্বর্গীয় বর্ণ এবং হিব্রু বর্ণমালা মিলেই জ্ঞানের ৩২ পথ উন্মোচিত হয়। কাবালিস্টরা মনে করেন কাব্বালাহ চর্চায় সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়।
কেননা এর মূল লক্ষ্য নিগূঢ় তত্ত্ব অনুসন্ধান করা। এজন্য নিজের আত্মার পরিশুদ্ধ সত্তাকে কেন্দ্রীভূত করতে হয়। না হলে এর মূলে পৌঁছানো অসম্ভব।
বিগত ৫০০ বছরে কাবালিস্টরা এই ধারা চর্চায় বেশ এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৫ সালে আমেরিকায় কাব্বালাহ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এর পরিচালক ফিলিপ বার্গ। তিনি তার স্ত্রী কারেন বার্গের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। সহকারী পরিচালক মাইকেল বার্গ। তিনি একাধারে কাবালিস্ট নেতা, শিক্ষক এবং লেখক।
কাব্বালাহ অনুসারীরা বাম হাতের কব্জিতে চিহ্ন সম্বলিত লাল ব্রেসলেট পরিধান করেন যাতে সাতটি গেরো বিদ্যমান। এর মাধ্যমে তাদের ভেতর আত্মিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়, খারাপ দৃষ্টি থেকে নিরাপদ রাখে এবং শান্তি, সমৃদ্ধি বয়ে আনে বলে তাদের বিশ্বাস।
সাধারণত অনূর্ধ্ব চল্লিশ এবং নারীদের কাব্বালাহ চর্চায় নিরুৎসাহিত করা হয়। যদিও এখন অনেকক্ষেত্রেই শিথিলতা এসেছে। তবে ইহুদিদের মাঝে এখনও নারীদের এই চর্চা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
এর জনপ্রিয়তা বর্তমানে কম নয়। তরুণরা এই চর্চায় ঝুঁকছে। পূর্বের ন্যায় এখন আর গোপনে চর্চার প্রয়োজন হয় না। নিজ কমিউনিটিতে কাবালিস্টরা নিজেদেরকে ভেতর একটি দৃঢ় বন্ধন করে তুলেছে। নিত্যনতুন গবেষণা, ব্যাখ্যা আর চর্চায় জ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করছে।
যদিও এই মতবাদ নিয়ে বহু তর্ক-বির্তক রয়েছে। মূলধারা থেকে ভিন্ন হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তথাপিও এর পরিধি উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
Feature Image: bulletin.hds.harvard.edu Reference: 01. Kabbala. 02. Kabbalah. 03. kabbalah.