খুব বাজে একটা স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গলো কালপূর্নিয়ার। স্বপ্নে দেখলেন, স্বামী সিজারের প্রতিমূর্তি থেকে ঝলকে ঝলকে রক্ত বের হচ্ছে আর তা দিয়েই হাত সাফাই করছে রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। রাতে আর ঘুম আসেনা। চারদিকে কেবল স্বামী সিজারের জয়ধ্বনি, তবুও এরকম বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে মুষড়ে পড়েন স্ত্রী কালপূর্ণিয়া। স্বামীকে ভয়ার্ত কণ্ঠে জানান দুঃস্বপ্নের কথা। স্বামী যাতে আজ আর বাহিরে না যায়।
কিছুদিন আগেকার এক সকালের কথা মনে পড়ে সিজারের। পম্পেইকে হত্যার পরের ঘটনা, চারদিক থেকে মিলছিল ফুলেল শুভেচ্ছা। সেদিন সকালে রাস্তায় এক জ্যোতিষী তাকে সাবধান করে বলেছিলেন যে, সামনে তার মহাবিপদ; ১৫ মার্চ অশুভ দিনটিতেই ঘটতে পারে সেই বিপদ। সে যেন সাবধান থাকে। হঠাৎ করেই সিজারের খেয়াল হলো আজই সেই ১৫ই মার্চ! অশুভ দিন। কিন্ত কেন এই অশুভ দিনের কথা বলা হচ্ছে? কেইবা এই সিজার?
বহুকাল আগে এক লোক ছিল। যে মহাবীর অ্যালেকজান্ডারের মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। স্বপ্ন দেখতো একদিন অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মতো হবে। আসলে সেই স্বপ্নচারী ব্যক্তিই যে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবে কেউ কি তা ভেবেছিল?
রোমে ১০০ খ্রিস্টপূর্বে জন্ম নেয় এক সাধারণ শিশু। শিশুটি মাত্র ছয় বছর বয়সেই শিক্ষাজীবন শুরু করে দেয় তো বটেই, এর সাথে সাথে ভাষণ দিতে তার খুবই ভালো লাগতো। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জীবনেই ট্র্যাজেডি আসে। শিশুটির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। মাত্র ষোল বছর বয়সে সে তার বাবাকে হারান। সম্পূর্ণ পরিবারের দায়-দায়িত্বের ভার পড়ে তার উপর।
প্রাচীন রোম প্রজাতন্ত্রে নিজ সত্ত্বা প্রকাশ করতে খুব বেগ পেতে হতো। তো কি হয়েছে? তবুও শিশুটি বড় হওয়ার পর রাজনেতা হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে দেননি। অ্যালেকজান্ডারের মতো গ্রেট হবার আকাঙ্ক্ষা অভাবের চাপে পিষ্ট হতে দেননি। এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই একদিন সে রোমের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। একের পর এক যুদ্ধে রোমানরা জয় লাভ করতে থাকে। এই জয়ে অন্যতম ভূমিকা পালন করে রোমে জন্ম নেওয়া সেই অসাধারণ শিশু; যার নাম জুলিয়াস সিজার।
জুলিয়াস সিজারের এই অসাধারণ কর্মের জন্য সে সেনাবাহিনীর প্রধানে পরিণত হন। একের পর এক রাজ্য তার আয়ত্তে আসতে থাকে। কার্যতই সিজারের খ্যাতি সারা রোমে ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় আসে যখন সিজার রোমের কাউন্সিলর পদে লড়াইয়ের জন্য দাঁড়ান। মূলত এটি এক বছর মেয়াদি একটি পদ। খুব সহজেই সিজার সেটিতে জয়লাভ করেন।
ছোটবেলা থেকে রাজনেতা হওয়ার স্বপ্ন যে সিজারের পূরণ হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। এরপর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। পম্পেই দি গ্রেটের সাথে যুদ্ধে তার জয়লাভ হয়। ফলস্বরুপ প্রজাতন্ত্র হটিয়ে জুলিয়াস সিজার রাজার আসনে অধিষ্ঠিত হন। পম্পেই দি গ্রেটকে পুরস্কারস্বরুপ মিশরের রাজা হত্যা করে। কেননা সে ভেবেছিল, পম্পেইয়ের সাথে সিজারের যুদ্ধে সিজার মিশরেও তার ক্ষমতার বিস্তার করতে পারে যেটা তার জন্য ক্ষতিকর।
ক্ষমতায় আসার পর সিজার রোমের চেহারা বদলে ফেলে। আধুনিক ইমারত, মন্দির এবং নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন তিনি করতে থাকেন। সিজারের অন্যতম আবিষ্কার হচ্ছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। আমরা আজ যেই ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা সিজারের আদলেই চলছে।
যেই রোম পূর্বে ছিল প্রজাতন্ত্র সেটি আজ একনায়কতন্ত্রের পথ ধরেছে বলে অনেকে মনে করতে লাগলো। সিজারের বিরুদ্ধে আরেকজনের অহংবোধের সৃষ্টি হতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি সিনেটর সদস্য ক্যাসিয়াস।
ক্যাসিয়াস সিজারের আস্থাবান ব্রুটাসকে বুঝাতে চান যে তাদের মাতৃভূমি এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে। ব্রুটাস প্রথমে দ্বিধাবোধ করলেও মাতৃভূমি ও পিতৃতুল্য বন্ধু সিজারের মধ্যে সে মাতৃভূমিকে বেছে নেন।
সিজারের স্ত্রী কালপূর্ণিয়ার সেই বাজে স্বপ্ন যেন এক ধরণের বাস্তবে রুপান্তর নিতে থাকে। আসলেই কি ঘটতে চলেছে এক অজানা বিপদ যেটার ইঙ্গিত এক জ্যোতিষিও করেছিলেন!
হ্যাঁ, শুরু হয় সেই অশুভ দিন। সিজারকে এক বিশেষ সভার জন্য সেদিন ডাকা হয়। কথিত আছে যে, সিজারকে রাজমুকুট পড়ানো হবে বলে সর্বত্র এই গুজব রটানো হয়েছিল। সভাকক্ষে আগ থেকেই অপেক্ষা করছিল সিনেটের সদস্যরা। যাদের মনে ও প্রাণে মঙ্গল ও মর্যাদা বয়ে আনার প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল বিশেষ করে ব্রুটাস এর ক্ষেত্রে।
স্ত্রীর দুঃস্বপ্নকে পরোয়া না করে সিনেটে ঢুকে নিজের আসনে বসলেন সিজার। আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারই সাথে কাজ করা বিশ্বস্ত কর্মীগণ। ক্যাসিয়াস ও তার দল আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো। ব্রুটাস সিজারের হাত চুম্বন করলেন।
ব্রুটাসের সাথে সাথে ক্যাসিয়াস মেটেলাসের ভাইয়ের ফেরানোর জন্য আবেদন করলেন। সিজার কারো আবেদন মানলেন না। তিনি একাগ্রতার প্রশ্নে অটুট এবং অবিচল সেটিই জানিয়ে দিলেন।
হঠাৎ সিজার দেখলেন সবার হাতে ছুরি। যাদের সাথে এতদিন কাজ করেছেন, যারা নাকি আজ রাজমুকুট পড়িয়ে দিবেন তারাই এসব করছে? ক্যাসিয়াস, মেটেলাস, ডেসিয়াস সবাই একের পর এক এগিয়ে এসে ছুরি চালায় বীর সিজারের দেহে।
আঘাতপ্রাপ্ত সিজার এগিয়ে গেলেন বন্ধু ব্রুটাসের দিকে। তার কাছে ছুরি থাকলেও সে কেন জানি সেই মুহূর্তে আর ছুরি চালাননি। তবে কিছুক্ষণ পড়েই সে মাতৃভূমির মর্যাদার কথা ভেবে সিজারের বুকে চালিয়ে দেন সেই ছুরি। সিজার আর্তনাদে বলে উঠলো-
ব্রুটাস শেষমেশ তুমিও?
লুটিয়ে পড়লো শত শত যুদ্ধে জয়লাভ করা সেই বীরের দেহ। সিজারের এই হত্যাকান্ডের মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয় তার একনায়কতন্ত্রী মনোভাব। ক্যাসিয়াস এবং ব্রুটাস ভেবেছিল যে রোমের মর্যাদা বিপন্ন হবে যদি সিজার ক্ষমতায় থাকে। সিজারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য হত্যা ছাড়া তাদের কাছে আর কোন পথ বাকি ছিল না।
সাধারণ মানুষকে ক্যাসিয়াস ও বিরোধীরা দেশের স্বার্থের দোহাই দিয়ে দমন করার চেষ্টা করে। তারা অনেকটা একমতও পোষণ করেন। তবে, সিজারের ঘনিষ্ঠ এন্টনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন-
তোমরা কি সিজারকে মনে করো না?
সেই সিজার যে তোমাদের নামে ওয়াসিয়ত লিখে গিয়েছে!
অর্থাৎ, সিজার তার মৃত্যুর পর সব সম্পদ যেন রোমের মানুষজন পায় সেই ব্যবস্থা করে যান। সিজারের মৃত্যুর পর ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসও বেশিদিন বাঁচেনি। ব্রুটাস মূলত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন আত্নহত্যার পথ বেছে নেন। ব্রুটাস ছিলেন একজন খাঁটি রোমান। তিনি সিজারকে হত্যার পথ বেছে নেন মাতৃভূমিকে রক্ষার স্বার্থেই।
অন্যরা যেখানে ক্ষমতার আকাঙ্খায় সিজারের হত্যার পরিকল্পনায় শামিল হন, ব্রুটাস অংশ নেন ঠিক তার বিপরীত অর্থেই। অপরদিকে ক্যাসিয়াস তার ভবিষ্যত হার এড়ানো বা শাস্তি পাওয়ার জন্য আত্নমর্যাদার খাতিরে আত্নহত্যা করেন। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম! কিন্ত এই জয় যে স্থায়িত্ব লাভ করবে না সেটি সিজার কখনোই হয়তো চিন্তাও করেনি।
প্রজাতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রে হয়তো এমনই ঘটে। নিজের জন্মদিনে সরকারি ছুটি থেকে শুরু করে,স্ব-ঘোষিত জাতির পিতা হিসেবে নিজেকে প্রচার করার মতো জিনিস যে সিজারের দাম্ভিকতা তুলে ধরে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্ত সিজারের মৃত্যুর পর যেই পুরাতন রোমান আত্না আবার ফিরে আসার আশা করা হয়েছিল তা কি আদৌ ফিরেছে? প্রশ্ন রয়েই যায়।
Feature Image: History on this day References: 01. The Assassination of Julius Caesar. 02. Julius Caesar was assassinated by Roman senators: on March 15, 44 B.C. 03. Why was Julius Caesar assassinated? 04. How Did the Assassination of Julius Caesar Unfold?