১৮৬৫ সাল। ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হলো ‘De la Terre à la Lune’ নামে এক বই, যার ইংরেজি অনুবাদকৃত বইয়ের নাম ‘ফ্রম দ্যা আর্থ ট্যু দ্যা মুন।’ মানবজাতির চন্দ্র বিজয়ের একশো বছর আগে প্রকাশিত এই বইয়ে উঠে আসে ‘কলাম্বিয়াড’ নামে এক মহাকাশযানের কথা। বইয়ে দেখা যায়, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে একদল গোলন্দাজ মিলে চন্দ্র অভিযানের উদ্দেশ্যে এক ক্যাননরূপী যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।
আশ্চর্যজনকভাবে চন্দ্র বিজয়ের একশো বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে মানবজাতির চন্দ্র বিজয়ের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। লেখকের ধারণা সঠিক প্রমাণ করে আমেরিকা এপোলো-১১ মহাকাশযান পাঠিয়ে সর্বপ্রথম সফলভাবে চাঁদে মানবজাতির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়।
লেখক যেমন তার বইয়ে এই বিজয়ের পেছনে এক যুদ্ধের অবদানের কথা বলেন, বাস্তবেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গভীর অবদান দেখা যায় এই উদ্যোগের অগ্রগতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু সৈনিক মহাকাশযানটি তৈরিতে অংশগ্রহণ করেন। এপোলো-১১ উৎক্ষেপণ করা হয় ফ্লোরিডার মেরিট আইল্যান্ড থেকে, যা একশো বছর আগে বইয়ে উল্লেখকৃত উৎক্ষেপণ স্থান অর্থাৎ ফ্লোরিডার স্টোন হিল হতে মাত্র ১৩৯ মাইল দূরে।
অবাক আরো হতে হয় যখন দেখা যায়, যে সময়ে মহাকাশ যাত্রার বিকাশই হয়নি, সেই সময়ে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত এই উপন্যাসে যে মহাকাশযানের কথা বলা হয়, তা তৈরিও হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে; যা কিনা পরবর্তীতে তৈরি প্রায় সকল মহাকাশযানের মূল উপকরণ ছিল।
কৌতুহলী না হয়ে উপায় নেই বইটি কে লিখে গিয়েছেন, তার নাম সম্পর্কে। অবিশ্বাস্য মেধাবী এই লেখকের নাম ‘জুল ভার্ন’, যিনি পরবর্তীতে ‘সায়েন্স ফিকশনের জনক’ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনুবাদকৃত লেখকের তকমা পান।
১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের নন্টস নামক শহরে জুল ভার্নের জন্ম। তার পিতার নাম পিয়েরে ভার্ন এবং মাতার নাম সোফি এলোট। নন্টস ছিল এক বন্দর ঘেরা নগর। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই ভার্নের উদ্ভাবনী চিন্তা ও রোমাঞ্চের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। স্কুল জীবন থেকেই ভার্ন ফরাসি ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে পেশায় অ্যাটর্নি পিতার ইচ্ছেতে প্যারিসে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে গমন করতে হয়।
তরুণ ভার্ন আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও, তার সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ থেমে থাকেনি। প্যারিসে তিনি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সান্নিধ্য পেতে শুরু করেন। তিনি তার সাহিত্যচর্চা মূলত ফরাসি ভাষাতেই করেন। ১৮৪৯ সালে ভার্ন আইন বিষয়ক ডিগ্রী অর্জন করেন। কিন্তু শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি প্যারিসে থেকে যান। পরের বছর তার একক নাটক ব্রোকেন স্ট্রস (লেস পাইলস রোম্পুস) পরিবেশিত হয়।
এদিকে ভার্নের পিতা তাকে নন্টসে এসে আইনচর্চা শুরুর জন্য চাপ প্রদান করতে থাকেন। বাঁধা উপেক্ষা করেই ভার্ন তার সাহিত্য সৃষ্টি চালিয়ে যান। আইনচর্চার বদলে তিনি থিয়েটারে সেক্রেটারি হিসেবে একটি স্বল্প বেতনের চাকরি নেন। যদিও এটা থেকেই তিনি ব্লাইন্ড ম্যানস ব্লাফ (লে কলিন-মেলার্ড) এবং দ্যা কম্পানিন্স অফ দ্যা মারজোলাইন (লেস কমপ্যাগননস দে লা মারজোলাইন) এর মতো নাটক তৈরির সুযোগ পান।
১৮৫৬ সালে অনোরিন ডে ভিয়ানের সঙ্গে ভার্নের পরিচয় হয়। শীঘ্রই দুজনে প্রণয়ে আবদ্ধ হন। ১৮৫৭ সালে প্রণয় পরিণয়ে পরিণত হয়। ভার্নের স্ত্রী ছিলেন একজন বিধবা এবং দুই সন্তানের জননী। বিয়ের পর ভার্ন পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা দেওয়ার জন্য স্টক ব্রোকারের কাজ শুরু করেন। এমন অবস্থাতেও তিনি তার লেখালেখি চালিয়ে যান। সেই বছরই তিনি তার প্রথম বই দ্যা ১৮৫৭ স্যালন (লে স্যালন ড্যা ১৮৫৭) প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ভার্ন এবং তার স্ত্রী ২০টি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণের জন্য যাত্রা করেন, যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যচর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ভার্ন দম্পতির একমাত্র সন্তান, মিশেল জিন পিয়ের ভার্ন, জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬১ সালে।
এই সময়কালে জুল ভার্নের সাহিত্য খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। ভার্নের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটে ১৮৬২ সালে, প্রকাশক পিয়েরে হেজেলের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে। ১৮৬৩ সালে ভার্নের পরবর্তীকালে তুমুল খ্যাতি লাভ করা অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ ‘ভয়েজেস এক্সট্রাঅর্ডিনেয়ারস’ এর প্রথম উপন্যাস ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’ (সাইনক সিমেনো বেলো) প্রকাশিত হয় পিয়েরে হেজেলের সহায়তায়।
তারপর থেকে জুল ভার্নকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে প্রকাশিত হতে থাকে রোমাঞ্চঘেরা একেকটি বই। ফ্রম দ্যা আর্থ ট্যু দ্যা মুন (ডে লা টেরে আ লা লুনে), ইন দ্যা সার্চ অফ দ্যা কাস্টওয়েস (লেজোফো দ্যু ক্যাপিতে গ্রোন্তস’), জার্নি ট্যু দ্যা সেন্টার অফ আর্থ (ভয়্যাজো সোন্ত্রো দ্যু লা ত্যে) এর মতো বই প্রকাশিত হয়ে ভার্নের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ভার্ন তার ভ্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন। ব্রিটিশ দীপপুঞ্জ থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বহু স্থানে তিনি যাত্রা করেন। তার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে সাথে ছিলেন তার সহধর্মিনী। ভার্নের সৃষ্ট সাহিত্যে এই ভ্রমণের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে ভার্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভ্রমণ করেন তার ভাইয়ের সঙ্গে। তার ভ্রমণ উপন্যাসগুলো মূলত ‘ভয়েজেস এক্সট্রাঅর্ডিনেয়ারস’ নামক এক সিরিজের অংশ, যা ভৌগোলিক জ্ঞান অন্বেষণের উৎস হিসেবে তুমুলভাবে পাঠকপ্রিয়তা পায়।
জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে ভার্নের সাহিত্য ফরাসি ভাষার গন্ডি ছাড়িয়ে ইংরেজি ভাষাতে অনুবাদ হতে থাকে, পরবর্তীতে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৪০টি ভাষায় দাঁড়ায়। সময়ের সাথে ভার্ন একে একে জন্ম দিতে থাকেন টোয়েন্টি থাউজেন্ড লীগ আন্ডার দ্যা সি ( ভ্যা মিল লিউ স্যু লে ম্যা’), এরাউন্ড দ্যা মুন (অতো’ ডে লা লুন), দ্যা মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড (ল্যু মিস্তেরিউজ), দ্যা সারভাইভরস অফ দ্যা চ্যান্সেলর (লে চ্যান্সেলর), এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ (লে ত্যু ড্যু মন্দ্যা এ ক্যাত্রো-ভাসৌ) এবং আরো অজস্র কালজয়ী সাহিত্য।
১৮৮৬ সাল ভার্নের জীবনে একটি অন্ধকার বছর বলা যায়। তার একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত ভাগ্নে তাকে পায়ে গুলি করে। গুলিটি বাকি জীবনের জন্য তাকে খোঁড়া বানিয়ে দেয়। সেই বছরই ভার্নের সাহিত্য প্রভিতার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক পিয়েরে হেজেল মারা যান। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর জুল ভার্ন তার মাকেও হারান। তার একমাত্র ছেলে মিশেলও ব্যক্তিজীবনে বেশ কিছু বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন। সব মিলিয়ে ভার্নের যুগের এই অধ্যায়ের পর তার সৃষ্ট সাহিত্যে বিষাদের সুর পরিলক্ষিত হয়।
তিনি তার ভ্রমণ ও সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার আরো বেশ কিছু বই যেমন লীগস অন দ্যা আমাজন (লা হাঙ্গাদা), রবার দ্যা কনকারর (রোহ্যু বিউলো কনকিউহা), দ্যা পারচেজ অফ দ্যা নর্থ পোল (সান দেস্যু দেস্যু), প্রোপেলার আইল্যান্ড (লি’ লা এ লিস), মাস্টার অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড (মেতৌ দ্যু মন্ড) প্রকাশিত হয়।
১৯০৫ সালের ২৪শে মার্চ জুল ভার্ন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পরও ছেলে মিশেলের তত্ত্বাবধানে তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। যদিও সেগুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে, তাতে মিশেল মৌলিকত্ব রক্ষা করেননি। মৃত্যুর পর বের হওয়া কয়েকটি বই হলো, দ্যা লাইটহাউজ এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড (লএ ফার দ্যু ব্যুট দে মন্ড), দ্যা গোল্ডেন ভলকানো (লে ভোলকান দ্যের) ইত্যাদি। এছাড়াও, ১৯৮৯ সালে ব্যাকওয়ার্ডস ট্যু ব্রিটেন এবং ১৯৯৪ সালে প্যারিস ইন দ্যা টুয়েনটিনথস সেঞ্চুরি প্রকাশিত হয়। সর্বমোট ভার্ন রচিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ৬৫টি।
জুল ভার্ন তার বইয়ে প্রযুক্তির নবদিগন্ত উন্মোচন করেন। তার লেখা বইগুলোতে সাবমেরিন, রকেট, টেলিভিশন, লিফট, ইন্টারনাল কমবাশন ইঞ্জিনচালিত গাড়ি, ক্যালকুলেটর, ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং আরো বহু প্রযুক্তির ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞান যখনও এই আবিষ্কারের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি, সেই সময়ে কীভাবে ভার্ন এতগুলো প্রযুক্তি সফলভাবে চিন্তা করতে পেরেছিলেন তা আজও এক বিস্ময়ের বিষয়।
বলা হয়ে থাকে, তার সাহিত্য সেই সময়কার বিজ্ঞানীদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। যদিও তিনি নিজে কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করেননি। সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন করার প্রয়াসে তিনি স্বশিক্ষায় এসব বিষয়ে ধারণা লাভ করতেন। তিনি তার সমসাময়িক বহু বিজ্ঞানীদের কাছেও যেতেন জ্ঞান আহরণের জন্য।
কেবলমাত্র বিজ্ঞান নয়, জুল ভার্নের সৃষ্টি ভ্রমণপিয়াসীদের কাছেও অমূল্য। তার সৃষ্ট ‘ভয়েজেস এক্সট্রাঅর্ডিয়েন্স’ সর্বাধিক বিক্রিত ভ্রমণ উপন্যাস সিরিজ। বছরের পর বছর ধরে নেলি ব্লি, উইলি পোস্ট এবং স্টিভ ফসেটের মতো দুঃসাহসীরা ভার্নের কাল্পনিক নায়ক ফিলিয়াস ফগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রেকর্ড ব্রেকিং সময়ে বিশ্বকে প্রদক্ষিণ করার চেষ্টা করেছেন।
ভার্ন সৃষ্ট সাহিত্য লক্ষণীয়ভাবে থিয়েটার, চলচ্চিত্র, রেডিও পরিবেশনায় অভিযোজিত হয়েছে এবং ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘দ্যা মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড’, ‘এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইস’, ‘টুয়েনটি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্যা সি’, ‘জার্নি ট্যু দ্যা সেন্টার অফ দ্যা আর্থ’ এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্র জুল ভার্নের বই থেকে তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪০টি ভাষায় ভার্নের বই অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদকৃত বইয়ের সংখ্যার দিক থেকে তার অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়।
জুল ভার্নের লেখনীর প্রভাব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা দুঃসাহসিক ভ্রমণ থেকেও আরো বহু সুদূরপ্রসারী। তিনি তার সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের বহু লেখককে অনুপ্রাণিত করে গিয়েছেন তীব্রভাবে। রে ব্র্যাডবেরী লিখছেন,
‘আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে, জুল ভার্নের সন্তান।’
ভার্নের সাহিত্য মানুষের সক্ষমতার এক চিরন্তন দলিল, বিস্ময়ের খোরাক। অজানাকে তিনি যেভাবে চিন্তা করে গিয়েছেন তা বহু কাল পর্যন্ত মানবজাতিকে নতুনভাবে চিন্তা করার অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। কালজয়ী এই লেখকের সমাধিস্থল ফ্রান্সের এমিয়েন্স শহর।