জটায়ু আর্থ সেন্টার: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখির ভাষ্কর্য

181
0
image source-Kerala Tourism

ঈশ্বরের নিজের দেশ বলা হয় ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালাকে। আর এই কেরালাই একটি বহু প্রাচীন এবং পৌরাণিক বিস্ময়কর জায়গা হলো জটায়ু আর্থ সেন্টার। জটায়ু আর্থ সেন্টার প্রায় ৬৫ একরের বহু পুরানো এক জমির ওপর বিস্তৃত, যা প্রাকৃতিকভাবে জাঁকজমকপূর্ণ, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এখানকার পৌরাণিক কিংবদন্তির কারণে সমগ্র বিশ্বজুড়ে দর্শনার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

জটায়ু আর্থ সেন্টারের নামকরণ করা হয়েছে মূলত কিংবদন্তি পাখি জটায়ু থেকে, যার কথা মহাকাব্যিক হিন্দু পৌরাণিক গল্পগুলোয় এমনকি রামায়ণেও এসেছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, অপহৃত রাজকুমারী সীতাকে রাক্ষস রাজা রাবণের হাত থেকে বাঁচাতে এই জায়াতু পাখি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল।

ধারণা করা হয়, পৌরাণিক কাহিনীর সাথে রহস্যে ঘেরা এই জটায়ু আর্থ সেন্টারের আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে বেশখানিকটা মিল রয়েছে। তাছাড়া, জায়গাটি বর্তমানে তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের কাছেও একইভাবে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর সমগ্র ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকেরা এখানে ভীর জমান।

ভারতের কেরালায় অবস্থিত পৌরাণিক কাহিনীর রহস্যে ঘেরা জটায়ু আর্থ সেন্টার। Image Source: amit power

অপার প্রাকৃতিক সৌন্দররযের লীলাভূমি কেরালার এই জটায়ু আর্থ সেন্টার, যেটি শুধু নিজেরই নয় বরং কেরালারও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কেরালার শহর তিরুবন্তপুরম থেকে খানিকটা দূরে প্রকৃতির কোলঘেষা এক পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায়, ঘন সবুজ এক নিরিবিলি উপত্যকায় এই জটায়ু আর্থ সেন্টারটি গড়ে উঠেছে।

যেখানে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে ক্যাসকেড, সাথে আছে জলপ্রপাত এবং দূরবর্তী পর্বতমালার মনোরম দৃশ্য দেখাবার সুবর্ণ সুযোগ। জায়গাটির চারপাশের নির্মলতা এবং প্রশান্তি এটিকে প্রকৃতি প্রেমিদের এবং ফটোগ্রাফারদের কাছেও সম্প্রতি সময়ে এসে বেশ অাকর্ষণীয় করে তুলেছে।

জটায়ু আর্থ সেন্টারের সবুজ উপত্যকায় বিরল ঔষধি গাছসহ দেখা মেলে বিভিন্ন উদ্ভিদের, রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থলও। আর্থ সেন্টারে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এখানটায় আগত দর্শনার্থীরা প্রকৃতির সাথে পুনরায় নিজেদের সংযোগ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন।

তাছাড়া, এখানকার কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ যেমন: বৃষ্টির জল সংগ্রহ এবং সৌর শক্তির কার্জকর ব্যবহার জায়গাটিকে একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে সচেতন গন্তব্যে রূপান্তর করেছে।

এমনই চোখধাধানো সবুজের দেখা মিলবে জটায়ু আর্থ সেন্টারে। Image Source: traveltriangle.com

জটায়ু আর্থ সেন্টারের মূল কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল ভাস্কর্য। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ ফুট এবং উচ্চতা আনুমানিক ৭০ ফুটের মতো এবং এটি একটি জটায়ু পাখির ভাস্কর্য। এই দুর্দান্ত ভাস্কর্যটি বিশ্বের বৃহত্তম পাখির ভাস্কর্যও বটে, যা ইতিমধ্যেই গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ডে নাম লিখিয়েছে।

এখানে আগত দর্শনার্থীরা চাইলে এই ভাস্কর্যটির উপরে আরোহণ করতে পারেন এবং সেখানকার চারপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া জটায়ু আর্থ সেন্টার কর্তৃপক্ষ এখানে আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে অ্যাড্রেনালাইন-পাম্পিং কার্যকলাপের জন্য বিশেষ ভাউচার অফার করে, যার মধ্যে রয়েছে রক ক্লাইম্বিং, র‌্যাপেলিং এবং ট্রেকিং। সেই সাথে রয়েছে সব বয়সের অ্যাডভেঞ্চার প্রেমিদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও।

এখানে আগত পর্যটকদের মাঝে যারা আরও প্রকৃতির সন্নিকটে সময় কাটাতে চান তাদের জন্য রয়েছে কেবল কার রাইডিংয়ের ব্যবস্থা। কেবল কারগুলোয় চড়ে চাইলে আপনি পুরো আর্থ সেন্টারে ভ্রমণ সেড়ে নিতে পারেন, যেখান থেকে আপনি পুরো জটায়ু আর্থ সেন্টারের একটি ল্যান্ডস্ক্যাপ ভিউও পেয়ে যাবেন।

তাছাড়া, এই ক্যাবল কারে চড়ে ১.৫ কিলোমিটার ভ্রমণ দর্শকদের জটায়ু আর্থ সেন্টারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার সময় বিশেষ অভিজ্ঞতাও প্রদান করে, যার সাহায্যে এখানে আগত দর্শনার্থীরা খুব সহজেই প্রকৃতির মাঝে নিজেদের হারিয়ে খুঁজেন।

কেবলকার রাইডিংয়ের সাহায্যে জটায়ু আর্থ সেন্টার ভ্রমণ। Image Source: Kerala Tourism

সুস্থতা এবং পুনরুজ্জীবনের প্রচারের জন্য, আর্থ সেন্টারে একটি আয়ুর্বেদিক রিসোর্টও রয়েছে। যেখানে দর্শনার্থীরা এখানকার ঐতিহ্যগত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা এবং থেরাপি নিতে পারেন। চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি ঘেরা এই রিসোর্টটি এখানে আগত অতিথিদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়।

তবে মনে রাখা জরুরি আর্থ সেন্টারটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের জন্যই নয়, কেরালার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এখানে সময়ে সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত,নৃত্য এবং শিল্পকলার প্রদর্শন করা হয়।

দর্শনার্থীরাও উক্ত অনুষ্ঠানগুলোর কেরালার আঞ্চলিক প্রাণবন্ত কথাকলি পারফরম্যান্স, মার্শাল আর্ট ডিসপ্লে এবং লোকনৃত্য দেখতে পারেন, যা কেরালার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বর্হিবিশ্বের নিকট ফুটিয়ে তুলতেও মূখ্য ভূমিকা রাখছে।

লোকনৃত্যের অনুষ্ঠানে। Image Source: tripadvisor.com

জটায়ু আর্থ সেন্টার কর্তৃপক্ষ সবসময়ই এখানে আগত দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।ভারতের লোকালসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীদের সকলের জন্য নির্বিঘ্ন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করণে ইতিমধ্যেই জটায়ু আর্থ সেন্টার কর্তৃপক্ষ নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেছে, যেখানটায় এখানকার যেকোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব, সাইটটি পর্যটকদের জন্যও সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য।

তাছাড়া, জটায়ু আর্থ সেন্টারের অপরিসীম শিক্ষাগত এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্বও রয়েছে। এটি বহুকাল ধরে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় এবং শেখার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে আসছে, যা দর্শনার্থীদেরও কেরালার সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করাতে সক্ষম হয়েছে।

এখানকার কর্তৃপক্ষ নিয়মিত বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার এবং ইন্টারএকটিভ সেশনের আয়োজন করে, যা উপস্থিত দর্শনার্থীদের সেখানকার স্থানীয় শিল্পী, কলাকুশলী এবং পণ্ডিতদের সাথে সাক্ষাৎ করবার সুযোগ করে দেয়, পাশাপাশি এই প্রক্রিয়াটি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা সম্পর্কেও দর্শনার্থীদের ব্যাপক ধারণা দিয়ে থাকে।

আর্থ সেন্টারের প্রবেশপথ। Image Source: wikimedia.commons

তবে শহর থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় এখানটায় আগত দর্শনার্থীদের আগে প্রায়শই খাবারের সমস্যায় পড়তে হতো। তবে বর্তমানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় এই সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান সম্ভব হয়েছে। এখন এখানে অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফে রয়েছে, যেখানে আপনি বিভিন্ন স্বাদের খাবারের পাশাপাশি খাঁটি কেরালার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোও পেয়ে যাবেন।

জটায়ু আর্থ সেন্টার কেরালার রাজধানী শহর তিরুবনন্তপুরম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা। তাছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য বিশাল এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতে রয়েছে গাইডের ব্যবস্থাও। দর্শনার্থীদের এখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য, আর্থ সেন্টারটিতে রয়েছে বিশ্রামাগার, বসার জায়গা এবং ইনফরমেশন এর জন্য রয়েছে তথ্য ডেস্ক।

এখানকার স্টাফ সদস্যরা প্রত্যেকেই খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং জ্ঞানী। তারা আর্থ সেন্টারে ভ্রমণ সকলের জন্য আনন্দদায়ক এবং স্মরণীয় করে তুলতে বিভিন্ন সময়ে দর্শনার্থীদের সহায়তা এবং নির্দেশিকা প্রদান করেন।

কেরালার তিরুবন্তপুরম থেকে ৫০ কিলো দূরে অবস্থিত সম্পূর্ন জটায়ু আর্থ সেন্টার কমপ্লেক্স,Image Source-Kerala Tourism

জটায়ু আর্থ সেন্টার বর্তমানে এটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি অনন্য গন্তব্য হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মানতেই হবে, কেরালার এই স্থানটি নির্বিঘ্নে প্রকৃতির জাঁকজমক উপভোগ, হরেক পৌরাণিক কিংবদন্তি ও তাদের জীবন কাহিনী এবং সেখানকার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে একত্রিত করেছে।

বিশাল জটায়ু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে সমগ্র আর্থ সেন্টারটিতে দুঃসাহসিক ভ্রমণ এবং এখানকার বিখ্যাত নির্মল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, যুগ যুগ ধরে আর্থ সেন্টারের প্রতিটি দর্শনার্থীদের জন্য একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা দিয়ে আসছে, যা এখানে আগত ভ্রমণকারীদের মন, শরীর এবং আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করতেও দারুণ ভূমিকা রাখছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

 

Featured Image: Kerala Tourism 
References:

01. Jatayu Earth’s Center. 
02. Jatayu Earth’s Center - Kerala’s Latest Addiction! 
03. Jatayu Earth's Center.