জেনেসারি বাহিনী: অটোমান সালতানাতের গর্বিত সম্পদ

1644
0

মধ্যযুগের অন্যতম প্রভাবশালী আর প্রতাপশালী সাম্রাজ্যের নাম অটোমান। এই সালতানাতের সামরিক শক্তির প্রভাবই, এদেরকে পুরো ইউরোপজুড়ে দাপট প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। আর সেই সামরিক শক্তিকে ত্রাসে রূপান্তর করেছিল অটোমানদের জেনেসারি বাহিনী। প্রচণ্ড হিংস্র আর ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের হওয়াতে যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক কিংবা অন্য কোনো ক্ষেত্রেই হোক – প্রতিপক্ষের কাছে তারা ছিল সাক্ষাৎ যমদূত। প্রায় ৫০০ বছরের সামরিক ইতিহাসে জেনেসারি বাহিনী হেরেছে – এমন যুদ্ধের সংখ্যা অতি নগণ্য। এই পদাতিক বাহিনীকে তাই অটোমান সালতানাতের গর্বিত সম্পদ বলেই গণ্য করা হয়। 

তুর্কি শব্দ ইয়েনি চেরি থেকেই জেনিসারি শব্দের উৎপত্তি। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায় “New Soldiers” আর বাংলাতে “নতুন সৈন্য”। এটা কেবলই একটা শাব্দিক অর্থ। এমন নয় যে তুর্কি সেনাবাহিনীতে নতুন জোয়ান বা সৈন্যদেরই জেনেসারি বলা হতো। বরং জেনেসারি ছিল আলাদা এক বিশেষায়িত পদাতিক বাহিনী। কিন্তু কথিত আছে, এই পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা এতটাই যুদ্ধবাজ ছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে অঙ্গ হারালেও নিজের জীবনের শেষ সময় অবধি লড়ে যেত। ঠিক এই কারণেই অটোমান সালতানাতদের সাম্রাজ্যের ব্যপ্তি বাড়ছিল দিনকে দিন। 

জেনেসারির উত্থান বা উৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা আছে; এমনকি আছে অনেক উপকথা। তাই প্রকৃত সত্যটা যেন এইসব কুয়াশার আড়ালেই রয়ে গেছে। তবে তুর্কির প্রাচীন ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, সেই সময় পুরোদস্তুর তুর্কির যাযাবররাই যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হতো। আর যুদ্ধের ময়দান থেকে লব্ধ অর্থই ছিল তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস। এই সমস্ত সৈন্যরা বেশ উশৃঙ্খল প্রকৃতির ছিল। লুটের সময় এদের তেমন কোনো হুঁশ থাকতো না। ফলে কে শত্রু আর কে মিত্র, তা নিয়ে প্রায়শই গণ্ডগোল বেঁধে যেত। 

Photos by realmofhistory.com

সেই সময় সালতানাতে ছিলেন উসমানের পুত্র ওরহান। তিনি এসব যাযাবরদের উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ধীরে ধীরে এদের সরিয়ে ভাড়াটে সৈনিক আনতে শুরু করেন। এসব ভাড়াটে সৈনিকদের বড় একটা অংশই ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। এদের মধ্যে পদাতিক বাহিনীকে ইয়ায়া এবং অশ্বারোহীদের মুসোল্লেম বলা হতো। ধারণা করা হয়, ইয়ায়া নামক এই পদাতিক বাহিনীই জেনেসারির পূর্বসূরী। 

ওরহানের মৃত্যু হলে অটোমান সালতানাতের ক্ষমতায় আসেন সুলতান প্রথম মুরাদ। ১৩৬২ থেকে ১৩৮৯ পর্যন্ত তার রাজত্বকালে তিনি এক ধরণের রক্ত করের প্রচলন করেন; যা দেভশিরমে বলে পরিচিত। রক্তের সম্মানে কাজ করা এই কর তখন বেশ কঠোরভাবে পালন করা হতো। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা আনাতোলিয়া এবং বলকান অঞ্চলের খ্রিষ্টানদের উপর এই কর ধার্য করা হয়।

বলকানদের প্রতি ৪০ পরিবার থেকে অন্তত একজন ৮-১৮ বছর বয়সী ছেলে ধরা আনা হতো রাষ্ট্রের সেবার জন্যে – হোক তা সৈন্য হয়ে কিংবা দাস হয়ে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ধরে আনা এইসব বালকদেরকে তুর্কি ভাষা আর সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্মের শিক্ষা দিয়ে কঠিন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই বাহিনীর জন্য গড়ে তোলা হতো। শুরুতে শুধু খ্রিস্টান বালকদের ধরে আনা হলেও পরবর্তীতে মুসলিম বালকদেরও এই বাহিনীতে নেয়া হয়। 

দেভশিরমের চিত্রিত রূপ। Photos by realmofhistory.com

তখনকার সময়ে জেনেসারিতে কাজ করা ছিল অত্যন্ত গর্বের বিষয়। যার পুত্র বা যে পরিবারের সন্তান জেনেসারিতে নিয়োগ পেত তারা সমাজে গর্ব করে বলতো তা। আর সমাজের দৃষ্টিতে তারা সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে গণ্য হতো। তুর্কি ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ছিল জেনেসারিদের জন্য মুখ্য বিষয়। এছাড়াও, অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, যুদ্ধবিদ্যা এমনকি ন্যায়পরায়ণ আর কর্তব্য সম্পর্কেও বিশেষ দীক্ষা দেয়া হতো এদেরকে।

সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ছিল নিত্যদিনকার দায়িত্ব। এছাড়াও এদেরকে প্রতিদিনই যেতে হতো অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। কুস্তি খেলা, ভার উত্তোলন, কঠোর রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস, মল্লযুদ্ধ, অশ্বারোহণ এবং তীর বা বল্লম নিক্ষেপ ছিল তাদের নিত্যদিনকার প্রধান কাজকর্ম। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সকল ধরণের যোগাযোগ বন্ধ রাখার পাশাপাশি আনন্দ-বিনোদন বলতে কিছু তাদের জীবনে ছিল। ব্যারাকই ছিল তাদের বাসস্থান। প্রশিক্ষণ শেষ হলে তাদেরকে টুপি আর সনদপত্র দেয়ার পাশাপাশি জেনেসারি উপাধিও দেয়া হতো। 

জেনেসারি বাহিনী যে কেবল অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীর একটা বিশেষ শাখা ছিল তা কিন্তু নয়। বরং এরা অনেকাংশেই রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারও ছিল। এমনকি জেনেসারিদেরকে “সুলতানের পোষ্য সন্তান” বলার চলও ছিল সেই সময়ে। নিয়মিত বেতন-ভাতা ছাড়াও মহল থেকে উপঢৌকন পাওয়া, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতেও সক্ষম ছিল এই জেনেসারিরা। সেরা যোদ্ধাদের সামরিক পদান্নতি হতো এবং এমনকি মাঝেমধ্যে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আসনও দেয়া হতো। 

জেনেসারিদের চিত্রিত রূপ। Photos by realmofhistory.com

শুরুর দিকে জেনিসারিদের বিবাহ করা এবং দাড়ি রাখা নিষেধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই নিয়ম রহিত হয় এবং জেনেসারির সন্তানরাই বাহিনীতে যোগদান করতে শুরু করে। জেনেসারি বাহিনীর ছিল স্বতন্ত্র পোশাক। বিশাল এক টুপি ছিল তাদের প্রতীক। পোশাকের রঙে ছিল সামরিক পদ অনুযায়ী ভিন্নতা। সবসময় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকতো তারা। শুরুতে তরবারি, বর্শা, ছুরি ইত্যাদি থাকলেও। পরবর্তীতে সামরিক পদ অনুযায়ী বন্দুক এবং পিস্তল দেয়া হতো। একসময় বন্দুক আর পিস্তলই হয়ে গিয়েছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। 

যুদ্ধের ময়দানেও জেনিসারি বাহিনীর প্রধান কর্তব্য ছিল সুলতানের নিরাপত্তা প্রধান। সম্মুখ বাহিনী পরাস্ত হলে যুদ্ধ সামলাতো নিয়মিত বাহিনী; তারাও যদি পরাস্ত হতো তবেই কেবল জেনেসারি বাহিনী শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। জনশ্রুতি আছে যে, ক্রুসেডের এক যুদ্ধে জেনেসারি বাহিনীর রণকৌশল আর হিংস্রতাই মূলত সমস্ত ইউরোপজুড়ে এদের ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।  গল্পটা অনেকটা এমন – হাঙ্গেরির রাজার নেতৃত্বে ইউরোপ জোট একদম কোণঠাসা করে ফেলেছিল তুর্কি বাহিনীকে।

তুর্কি সৈন্যদল যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে ঠিক তখনই যুদ্ধের ময়দানে নামে জেনেসারি বাহিনী। রণকৌশলে পরিবর্তন করে মুহূর্তেই এই দল নিজেদেরকে হিংস্র এক বাহিনীতে পরিণত করে। এমন আকস্মিক আক্রমণ আর হিংস্রতা দেখে ইউরোপের জোটের সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে শুরু করে। কিন্তু জেনেসারি বাহিনীর উপর সেদিন এতটাই হিংস্রতা ভর করেছিল যে পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদেরও ধরে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। মূলত এই ঘটনার পর থেকেই ইউরোপের ত্রাসে পরিণত হয় জেনেসারি। 

Photos by realmofhistory.com

জেনেসারিদের নিয়ে প্রচুর উপকথা প্রচলিত আছে। হয়তো উপরের ঘটনাটা তারই একটা। কিংবা হতে পারে এটাই সত্যিই ঘটনা। সেই তর্কে না গিয়ে আমরা বরং ইতিহাসে ফিরে যাই। ইতিহাস বলে, ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদের নেতৃত্বে বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে কন্সট্যান্টিনোপল দখল করার পেছনে ছিল জেনেসারিদের সুদক্ষ রণকৌশল। আর এই জয় সর্বকালের অন্যতম সেরা সামরিক জয় বলেও ইতিহাসে অভিহিত। এছাড়াও, জেনেসারি বাহিনীর আরেকটা বড় অবদানের কথা স্মরণ করা হয় সেটা হচ্ছে ১৬৮৩ সালের ভিয়েনা অবরোধ।

১৪০০ শতকের শুরুতে জেনেসারিদের সংখ্যা হাজারের কাতারে থাকলেও ১৮০০ শতক নাগাদ সেই সংখ্যা ১,৩৫,০০ হাজারে গিয়ে ঠেকেছিল। যুদ্ধের ময়দান ছাড়া জেনেসারি বাহিনী প্রাসাদ পাহারা, পুলিশি দায়িত্ব, অগ্নি নির্বাপক, অস্ত্র নির্মাণ কাজেও জড়িত ছিল। ইউরোপের প্রথম মিলিটারি ব্যান্ডও তৈরি করেছিল এই জেনেসারি বাহিনী। কথিত আছে, যুদ্ধের ময়দানে এদের বাজানো বাদ্যযন্ত্রের শব্দে প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরে যেত। 

কথায় আছে  – রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয় একটা সময় পরে। জেনেসারিদের ক্ষেত্রেও তাইই ঘটেছিল। ১৪শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জেনেসারিরা প্রথম বিদ্রোহ করে বসে নিজেদের বেতন বৃদ্ধির জন্যে। সুলতান উপায়ান্তর না দেখে তা মেনে নেন। তখন থেকেই মূলত জেনেসারি বাহিনী নিজেদের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের আধিপত্য বিস্তার। একটা সময়ে তারা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলাতে শুরু করে। 

সুলতান দ্বিতীয় উসমান। Photos by Sonia Halliday Photo Library

সুলতান দ্বিতীয় উসমানের মৃত্যুও হয় এই জেনেসারি বাহিনীদের হাতেই। উত্তরোত্তর ক্ষমতা আর প্রভাব বাড়তে থাকে জেনেসারিদের। আর তারা হতে থাকে লাগামছাড়া। সালতানাত এই সম্পর্কে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আর তাই তারা জেনেসারিদের বিপক্ষে এবং সুলতানদের সুরক্ষায় এক নতুন বাহিনী গঠন করতে শুরু করে। ফলে জেনেসারি বাহিনী এবং সালতানাতের মধ্যে এক ধরণের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। 

আর এরই জের ধরে সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদের সময় জেনেসারিরা আবারও বিদ্রোহ করে বসে। সুলতান উপায়ান্তর না দেখে তার গোলন্দাজ বাহিনীকে আদেশ দেন সরাসরি জেনেসারিদের ব্যারাক ধ্বংস করে দিতে। এতে করে প্রচণ্ড এক সংঘর্ষ ঘটে দুই পক্ষে। এতে প্রায় চার হাজারেরও অধিক জেনেসারি মারা যায়। আর আহত হওয়ার সংখ্যা গুনে শেষ করার মতো নয়। যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা পালিয়ে গেল এদিক-সেদিক। আর আহতরা সেবা না পেয়ে সেখানেই মারা যায় ধুকে ধুকে। 

Photos by realmofhistory.com

পরবর্তীতে ১৮২৬ সালে পালিয়ে বেড়ানো অবশিষ্ট বেঁচে থাকা জেনেসারিদের ধরা হয়। বেঁচে থাকা প্রত্যেকটা জেনেসারিকেই শিরচ্ছেদের আদেশ দেয় সালতানাত। আর এই শিরচ্ছেদের মধ্য দিয়েই অটোমান সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড খ্যাত জেনেসারি বাহিনীর নাটকীয় সমাপ্তি ঘটে। থেমে যায় এশিয়া আর ইউরোপ কাঁপানো এক পদাতিক বাহিনীর গৌরবাজ্জ্বল অধ্যায়ের। 

 

Feature Image: realmofhistory.com
তথ্যসূত্রসমূহ:

01. The Rise And Fall Of The Janissaries, The Ottoman Empire’s Elite Military Corps.
02. Janissary.
03. জেনেসারি বাহিনী: ইউরোপজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করা অটোমান অহংকার
04. জেনেসারি: অটোম্যান সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড
05. জেনে নিন অটোম্যান এলিট ফোর্স জেনেসারী সম্পর্কে