বর্তমান সময়ে রুমি নামটি বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাথায় পাগড়ি বাঁধা, মুখে সাদা দাড়ির এক সৌম্য চেহারার ব্যক্তির মুখমণ্ডল। আর যদি কারোর সুফী মিউজিক কিংবা এই সম্পর্কিত সামান্য ধারণাও থেকে থাকে, তাহলে আলখাল্লা আর মাথায় লম্বা টুপির এক অবয়ব ভেসে উঠবে। আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগে এশিয়া মাইনরে জন্ম নেওয়া এক আধ্যাত্মিক সাধক তাঁর বক্তব্য, দর্শন আর কর্মের মধ্য দিয়ে আজও এত জীবন্ত যে কেবল একটি নামেই তিনি আমাদের মধ্যে এতটা প্রভাব ফেলেন। সুফিবাদের সেই প্রধান পুরুষ জালাল উদ্দিন রুমিকে নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
কে ছিলেন রুমি?
জালাল উদ্দিন রুমির জন্ম ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে, বর্তমান আফগানিস্তানের বাল্খে। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় জালাল উদ্দিন বাল্খি। বাল্খি অর্থাৎ বাল্খের অধিবাসী। পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়া অঞ্চল পরবর্তীতে তুর্কীরা জয় করলে সেখানকার ‘রুম’ অঞ্চলের নামানুসারে অনেকেই নিজেদের বা সন্তানদের নাম রুমি রেখেছিলেন; এমনটাই ভাষ্য জালাল উদ্দিন রুমির জীবনী লেখক ফ্রাঙ্কলিন লুইসের। বর্তমানে সারা বিশ্বে তিনি এই নামে পরিচিত হলেও মুসলিম বিশ্বে তিনি ‘মাওলানা’ নামেও পরিচিত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাওলানা বলতেই, ইসলামী জ্ঞানের অধিকারি কোন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়। সহজ করে বললে, জালাল উদ্দিন রুমিও একজন মাওলানা ছিলেন। অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞানের অধিকারি। তাঁর পিতা তৎকালীন সময়ের একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। এবং পরিবার থেকেই রুমি শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান অন্বেষণের চিরন্তন ক্ষুধাটা পেয়েছিলেন। পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের কাছেই তার শিক্ষা শুরু হয়। বাহাউদ্দিন একজন হানাফি ছিলেন এবং রুমিও এই মতানুসারেই শিক্ষিত হন।
মঙ্গলদের আক্রমণের কারণে বাহাউদ্দিন তাঁর পরিবার নিয়ে পশ্চিমে সরে যান এবং কোনিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। কথিত আছে, এই সময়ে রুমির সাথে ফরিদউদ্দিন আত্তারের সাক্ষাৎ হয়েছিল। যদিও বেশিরভাগ রুমি-বিশেষজ্ঞই ব্যাপারটা মানতে নারাজ। তবে এটা ঠিক যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্য এশিয়ার ইসলামী বিশিষ্ট জ্ঞানের সাথে রুমির পরিচয় হয়েছিল এবং অল্প সময়েই রুমি একজন সেরা ‘ফকীহ’ হিসেবে পরিচিত হন। রুমির পিতা বাহাউদ্দিন একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর রুমি যখন এই মাদ্রাসার দায়িত্ব নেন তখন তাঁর বয়স কেবল পঁচিশ; কিন্তু জ্ঞানের কারণে তাঁর এই দায়িত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।
রুমির শিক্ষা ও কর্মজীবন
কোনিয়ায় এসে বাহাউদ্দিন যখন মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন, শুরুতে রুমি সেখানে পিতার ছাত্র হিসেবেই ছিলেন। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা যায় যে, কোনিয়াই মূলত সেই ‘রুম’ শহর; যার নামানুসারে জালাল উদ্দিন বাল্খি নিজের নাম জালাল উদ্দিন রুমি করে নেন কিংবা হয়ে যায়। এখানে বসেই রুমি আরবি ব্যাকরণ থেকে শুরু করে কোরআন, হাদিস, কোরআনের তাফসীরের শিক্ষা নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রুমি ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন এবং আধ্যাত্মিকসহ নানা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে নিজেকে গড়ে তোলেন। সমগ্র কোনিয়া জুড়ে বাহাউদ্দিন এবং জালাল উদ্দিনের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
সুফিবাদে রুমির শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়, রুমি তাঁর পিতা বাহাউদ্দিনের কাছেই এই বিষয়ে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায়, তাঁর পিতার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বা তার কিছু পরেও তাকে কোন সুফি রীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। অবশ্য এই সম্পর্কে ভিন্ন একটি মত আছে। তা হচ্ছে, বাহাউদ্দিনের একজন কৃতি ছাত্র সৈয়দ বুরহান উদ্দিন মোহাক্কিকি তিরমিযী কোনিয়া এসেছিলেন তাঁর সাথে দেখা করতে। কিন্তু ততদিনে বাহাউদ্দিন ইন্তেকাল করেছেন। তখন বুরহান উদ্দিনই রুমিকে সুফিবাদে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নেন। ১২৪০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বুরহান উদ্দিন এই দায়িত্ব ঠিকঠাক মতোই পালন করেছিলেন।
অন্যদিকে, শিক্ষক এবং ধর্মীয় জ্ঞানেও রুমি নিজেকে প্রমাণ করে চলছিলেন। রুমির মাদ্রাসায় সেই সময় অনেকেই শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। এমনকি কেবল কোনিয়া নয়, পূর্ব দিক থেকে অর্থাৎ এশিয়া থেকেও অনেক জ্ঞান অন্বেষণকারী তখন রুমির কাছে শিখতে চাইতেন। এখানে উল্লেখ করা ভালো, জ্ঞান বিজ্ঞানে বাগদাদ যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল অতীতে, সেখানে তখন এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতু হয়েছিল কোনিয়া; যেখানে রুমি একটি বিশেষ আসন তৈরি করেছিলেন। সেখান থেকেই রুমি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন আজ তবে তাঁর পেছনে রয়েছে আরেকটি নাম। শামস তাবরিজী।
রুমির জীবনে তাবরিজী
কেবল জালাল উদ্দিন রুমিই নয়, বরং সুফিবাদের ইতিহাসে শামস তাবরিজী এক অনন্য নাম। তিনি এক রহস্য মানব। রুমিকে নিয়ে বহু গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও তাবরিজীকে নিয়ে আজ অবধি স্পষ্ট কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। তাবরিজী নাম থেকেই বোঝা যায় তিনি তাবরিজের বাসিন্দা ছিলেন। এবং শামস–আদ–দীন তাবরিজী এখন কেবল শামস তাবরিজী নামেই সকলের কাছে পরিচিত। ১২৪০ পরবর্তী সময়ে, সম্ভবত ৪৩/৪৪ সালের দিকে তিনি কোনিয়ায় আসেন এবং রুমির সাথে তাঁর পরিচয় হয়।
শামস সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ধারনাটি হচ্ছে, তিনি রুমির সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং তখনই বুঝতে পারেন রুমির মধ্যে সব সম্ভাবনাই আছে; কেবল একটি আগুনের ফুলকি প্রয়োজন যা রুমির ভেতরকার সত্ত্বাকে জ্বালিয়ে নতুন করে তাঁকে আলোকিত করবে। শামসের সাথে রুমির যখন দেখা হয় রুমির বয়স তখন আটত্রিশ। শামস তাবরিজীর সাথে দেখা হওয়ার পরই রুমির জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। রুমি তাঁর শিক্ষকতা এক রকম ছেড়েই দেন এবং বেশীরভাগ সময়ই শামসের সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন।
একটা সময়ে অবস্থা এমন হয় যে, রুমি বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেন। এমনও জানা যায়, শামস একদিন রুমির সব বই জ্বালিয়ে দেন; কেননা এসব পুঁথিগত জ্ঞান রুমির প্রয়োজন নেই। রুমির প্রয়োজন তাঁর ভেতরকার সত্ত্বাকে আলোকিত করা। তাবরিজী যে সেই কাজটা করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই কেননা তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পরেই রুমির কবি সত্ত্বা জেগে উঠতে শুরু করে। শিক্ষক রুমি একজন পুরোদস্তুর কবি হয়ে ওঠেন।
কিন্তু এখানে সমস্যা তৈরি হয় নতুন করে। রুমি এবং শামসের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন উঠতে শুরু করে। সমকামিতা থেকে শুরু করে শামসের মানসিক অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মধ্যে কথা হতে শুরু করে, যা আজও চলমান। শামস কে ছিলেন বা রুমিকে তিনি কী বলেছিলেন সেই সম্পর্কে জল্পনা আজও কম নয়। এলিফ শাফাকের উপন্যাস ‘দ্য ফরটি রুলস অফ লাভ’ পড়লে মনে হয় শামস এসেছিলেন ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হয়ে। কিংবা শামস জানতেন রুমির মধ্যে এক অন্য সত্ত্বা আছে যা তিনি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।
শামস পরবর্তী রুমি
প্রায় চার বছর রুমির সঙ্গে থাকা এবং রুমিকে নানা শিক্ষা দেওয়ার পর ১২৪৮ এর এক রাতে শামস হারিয়ে গেলেন। যেমন উল্কার মতো এসেছিলেন তেমনই তাঁর চলে যাওয়া। সবচেয়ে বড় রহস্য হলো শামসকে এরপর আর কোনোদিনই দেখা যায়নি। শামস কেন এসেছিলেন আর কেন চলে গেলেন, তা জানা যায় না। কিন্তু তিনি একেবারে বদলে দিয়ে গিয়েছিলেন জালাল উদ্দিন রুমিকে।
শামসের আসার পর থেকেই রুমির মধ্যে আধ্যত্মিকতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আত্মগত থাকতেন এবং লিখতেন কবিতা। পরবর্তী সময়ে অনেক ইউরোপীয় গবেষক দাবী করেছেন রুমির কবিতাগুলো শামসকে উদ্দেশ্য করে লেখা যেখানে প্রেম নিবেদন রয়েছে। কিন্তু সুফিবাদ যারা জানেন তারা বুঝবেন এখানে স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ নিবেদনের কথাই আছে। যেমন তাবরিজী চলে যাওয়ার পর রুমি লিখেছেন,
‘আমি কেন তাঁকে খুঁজব?
সে তো আমার মাঝেই আছে।’
সুফিবাদ হিসেবে এখানে স্রষ্টার প্রতি নিবেদনের কথাই আছে। কিংবা শামসের কথাই যদি হয় সেটা নিছক প্রেমের নয়।
রুমির কাজ এবং শেষ জীবন
রুমির কাজ নিয়ে তেমন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আজকের দিনে রুমির কাজ সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ দুর্লভ। জালাল উদ্দিন রুমি অমর হয়ে আছেন তাঁর অনেক অনেক কবিতার জন্য; যার মধ্যে অনেক কবিতা আজকের দিনে নানা ভাবে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে গান এবং পুনরায় কবিতায় ব্যবহৃত হয়। রুমির সবচেয়ে বড় এবং উল্লেখযোগ্য কাজ অবশ্যই তাঁর ‘মসনবী’, যাকে ‘পারস্যের কোরআন’ বলা হয়। আধ্যাত্মিকতায় এরচেয়ে বড় কাজ পৃথিবীতে আর নেই। এর মধ্য দিয়ে রুমি মূলত তাওহীদ, অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদের কথা বলেছেন। এছাড়া রয়েছে মানুষের জন্য নানা রকম নির্দেশনা যার বেশিরভাগই আধ্যাত্মিক।
রুমি তাঁর বাকি জীবনেও শামসকে ধারণ করেছিলেন নিজের মধ্যে এবং নিজের কাজে। রুমির অনেক শ্লোকই শামসের নামে। অর্থাৎ রুমি নিজে যা লিখেছেন যা, আসলে তা শামসের কথা। হতে পারে শামস আর রুমির মধ্যে যে গভীর আলোচনা হতো তার কিছু হয়ত রুমি তুলে ধরেছিলেন কবিতার মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা বলেন রুমি তাঁর এসব কবিতায় যে কাব্যপ্রতিভা দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে এখনও বিরল।
সুফিবাদকে রুমি নতুন মাত্রায় তুলে নিয়েছিলেন। যা আগে ছিল জটিল তত্ত্বকথা, রুমি তাঁকে কবিতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি নাচের প্রচলন করেন। টার্কিশ সুরের সাথে ‘সামা নৃত্য’ আজ বিশ্বব্যপি রুমি এবং সুফিদের পরিচয়কে তুলে ধরে। ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে রুমি মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমানে রুমি
রুমির কেবল শারিরিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি এখনও বেঁচে আছেন মানুষের মধ্যে। তাঁর মৃত্যুর এতো বছর পরও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করছেন। মুসলিম বিশ্ব এখনও তাঁকে তাঁর কাজের জন্য সম্মান করে। রুমির শিক্ষা, দর্শন এবং অধ্যাত্ম্যবাদ নিয়ে এখনও সব রহস্য উন্মোচন হয়নি। হয়ত কখনও হবে।
Feature Image: twitter.com
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Jalal Uddin Rumi: Persia’s Greatest Mystic Poet. Shambhala Publications.
02. Me and Rumi: The Autobiography of Shams-I Tabrizi. Written by William C. Chittick.
03. The Forty Rules of Love. Written by Elif Shafak.