জন্ম ও বেড়ে ওঠা
জ্যাক মা ১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর চীনের ঝি-জিয়াং প্রদেশের হ্যাং চাও শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে জ্যাক মা ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা-মা ছিলেন পেশাদার গল্পকথক। মানুষকে গল্প শুনিয়ে, গান গেয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে খুব কষ্টে তাদের সংসার চলতো।
তখন চলছিল দূর্যোগের সময়। কমিউনিস্ট চায়না পাশ্চাত্য থেকে আলাদা হয়ে চলার চেষ্টা করছিল। জ্যাক মা-ও আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো ঝিঝি পোকা ধরতেন। তাদের মধ্যে লড়াই করাতেন। তবে মা শুধু ঝিঝি পোকাদের লড়িয়েই শান্ত হোননি। বরং তিনি নিজেও স্কুলে তার চেয়ে বড় ছেলেদের সাথে লড়াই করতেন।
মা ছোটবেলা থেকেই ইংরেজীতে পারদর্শী হওয়ার বেপারে ছিলেন বদ্ধপরিকর। এজন্য তিনি মার্ক টোয়েন-এর বই পড়া থেকে শুরু করে সবকিছুই করতেন। তার বয়স যখন বারো তখন তার মাথায় দারুণ এক বুদ্ধি আসে। তিনি প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠে সাইকেলে চেপে ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে যেতেন। সেখানে বিদেশী পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করতেন।
পর্যটকদের শহর ঘুরিয়ে দেখানোর বদলে তাদের কাছে ইংরেজী শিখতে চাইতেন। এমনই একদিন তার পরিচয় হয় এক অস্ট্রেলিয়ান এক পরিবারের সাথে। এই অস্ট্রেলিয়ান পরিবারটির দাওয়াতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা দেখে খুবই আনন্দিত হোন তিনি। জ্যাক মা এর আসল নাম কিন্তু মা ইউন। এরকমই এক ট্যুরিস্ট তার নাম দিয়েছিল জ্যাক।
শিক্ষা ও চাকরি
মা বেশ ভালোভাবেই জানতেন টাকা এবং মামা-চাচার হাত ছাড়া একমাত্র শিক্ষাই তাকে জীবনে সফল করতে পারবে। কিন্তু তিনি ছাত্র হিসেবে ছিলেন খুবই সাধারণ। ইংরেজীতে বেশ ভালো হলেও গণিতে তিনি ছিলেন খুবই দুর্বল। এমনকি ফেইলও করেছেন কয়েকবার।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সময় প্রথমবার তিনি ১২০ এর মধ্যে পেয়েছিলেন মাত্র ১। তবে জ্যাক মা হাল ছাড়বার পাত্র নন। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় অবশ্য ১৯ পেয়েছিলেন। কিন্তু তার ফলাফল এতটাই খারাপ ছিল যে, তিনি কোনো ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হতে পারছিলেন না। অবশেষে তৃতীয়বারের চেষ্টায় তিনি এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ১৯৮৮ সালে সেখান থেকেই তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেন এবং চাকরির খোঁজ শুরু করেন।
কিন্তু মা-এর জীবন কখনোই সহজ ছিল না। তাই তিনি একের পর এক চেষ্টা করেও চাকরিতে ঢুকতে পারছিলেন না। এমনকি কেএফসি-তেও তাকে কাজ দেওয়া হয়নি। ২৪ জনের মধ্যে সেদিন ২৩ জনকেই হায়ার করা হয়েছিল। শুধু চাকরি জোটেনি মা-এর কপালে।
কোথাও ৫ জন ইন্টারভিউ দিলে হয়তো ৪ জনের-ই চাকরি হতো। হতো না শুধু মা-এর। অবশেষে মা মাত্র ১২ ডলার বেতনে একজন ইংলিশ টিচার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
আলিবাবার শুরু যেভাবে
মা-এর কম্পিউটার বা কোডিং নিয়ে খুব একটা ধারণা ছিল না। মা তখন অনুবাদের কাজ করতেন। ১৯৯৫ সালে একটা পেমেন্টের ব্যাপারে কথা বলতে তাকে আমেরিকা যেতে হয়। সেখানেই এক বন্ধু তাকে ইন্টারনেটের সাথে পরিচয় করান। জ্যাক মা প্রথমেই ‘বিয়ার’ লিখে সার্চ করেছিলেন।
তবে জ্যাক মা চায়নিজ কোনো বিয়ার কোম্পানি বা ওয়েবসাইট খুঁজে পাননি। এরপরই তিনি চীনে একটি ইন্টারনেট কোম্পানি খোলার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তার শহরে তখনও ইন্টারনেট আসেনি। এমতাবস্থায়, যে কেউই হয়তো নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে।
কিন্তু মা-এর ব্যাপারটা ছিল আলাদা। তিনি ‘চায়না ইয়েলো পেজেস’ নামের একটা কোম্পানি শুরু করেন। কিন্তু নিজের সব সঞ্চয় কাজে লাগিয়েও তিনি এই ব্যবসা চালাতে পারেননি খুব বেশীদিন।
১৯৯৯ সালে জ্যাক মা তার ১৭ জন বন্ধুকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ডাকেন। তিনি সবাইকে তার নতুন কোম্পানিতে ইনভেস্ট করতে রাজি করান।
এটিই ছিল বিশ্ববিখ্যাত ই-কমার্স সাইট ‘আলিবাবা’ এর প্রাথমিক যাত্রা। মূলত এই সাইটে সহজেই আমদানিকারকরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে।
প্রথম সপ্তাহে মাত্র ৭ জন কর্মী জোগাড় করতে পেরেছিলেন। তারা নিজেরাই নিজেদের পণ্য কেনাবেচা করতে শুরু করেন। পরের সপ্তাহে কেউ একজন তাদের ওয়েবসাইটে পণ্য বিক্রি করতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো জ্যাক মা তাদের সবকিছু কিনে ফেলেন। তাদের কাছে তখন ছিল টাকা খরচ করে কেনা দুই ঘর ভর্তি জঞ্জাল আর একটা স্বপ্ন।
জ্যাক মা তার এই নতুন কোম্পানির ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া মিটিং তিনি ক্যামেরাবন্দী করেন। আলিবাবা প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই তিনি এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন,
শুধু চীনেই নয়, সারাবিশ্বের এক নম্বর ই-কমার্স সাইট গড়ে তুলতে চাই।
শুধু তো বললে-ই হবে না, কোম্পানি দাঁড় করাতে তার প্রয়োজন ছিল অনেক অর্থের। স্বভাবতই তিনি ইনভেস্টরের খোঁজে নেমে পরেন। জ্যাক মা সিলিকন ভ্যালির ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট পালো আল্টো থেকে ফান্ড রাইজ করার চেষ্টা করেন। ইনভেস্টররা চাচ্ছিল একটা চমকপ্রদ বিজনেস প্ল্যান। কিন্তু অন্য সব বড় কোম্পানীর মতোই জ্যাক মা-এর হাতেও কোনো প্ল্যান ছিল না।
তিনি বিশ্বাস করতেন, প্ল্যান করলেই হার, আর প্ল্যান না করলেই জিত। প্রথমদিকে ইনভেস্টররা জ্যাক মা-এর প্ল্যান পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও মা-এর জাদুকরী ব্যক্তিত্বের কারণেই গোল্ডম্যান স্যাকস শেষ পর্যন্ত ৫ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে রাজি হয়। এত বড় একটি ই-কমার্স সাইটের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার পরও কিন্তু জ্যাক মা এখনো শুধুমাত্র সাধারণ কাজের জন্যই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইমেইল আদান-প্রদান ও ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ছাড়া কম্পিউটার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না তিনি।
আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করেই কিন্তু জ্যাক মা-এর অ্যাডভেঞ্চার শেষ হয়নি। এরপর ২০০৩ সালে তিনি নতুন একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন টাওবাও। এটা চায়নার সবচেয়ে বড় বিজনেস টু কনজিউমার শপিং ওয়েবসাইট। যদিও সবাই তার নতুন ওয়েবসাইট তৈরির ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান ছিল।
কেননা তখনো আলিবাবা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। আবার নতুন ফান্ড রাইজ করতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। কিন্তু সবার সন্দেহকে মিথ্যা করে ২০০৭ সালে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ইবে-কে পেছনে ফেলে আলীবাবা। শেষ পর্যন্ত ইবে চীনে তাদের ব্যবসাপত্র গুটিয়ে ফেলে। ২০০৪ সালে জ্যাক মা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট পেমেন্ট সিস্টেম আলিপে চালু করেন।
জ্যাক মা সবসময়ই মজা করে কাজ করায় বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্য তিনি প্রায়শই আলিবাবার কর্মীদের দিয়ে নানারকম উদ্ভট কাজ করাতেন। টাওবাও নিয়ে কাজ করার সময় কর্মীদের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য তিনি তাদের হাতে ভর দিয়ে উলটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতেন।
তবে মা যেসব অফিস পার্টি আয়োজন করতেন সেসব দারুণ মজার হতো। এক কর্মচারী তো এমন এক পার্টিতে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসেন। জ্যাক মা এসব পার্টিতে বিভিন্ন কস্টিউম পরে গানও গাইতেন।
আলিবাবা প্রতিবছর কোম্পানি ট্যালেন্ট শো হোস্ট করে। এরকমই এক অনুষ্ঠানে মা পাংক রকার সেজে এসেছিলেন। এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষের সামনে পারর্ফমও করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
আলিবাবার সফলতার কারণে মা বেশ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হলেও তিনি এখনো কুং ফু ফিকশন পড়তে পছন্দ করেন। পোকার খেলে, ধ্যান করে এবং টাই চি প্র্যাক্টিস করেই তার অবসর সময় কেটে যায়। জ্যাক মা সবসময়ই তার পারিবারিক জীবন গোপন রাখতেই পছন্দ করেন।
জ্যাক মা একজন শিক্ষিকা জ্যাং ইং-কে বিয়ে করেন। এক মেয়ে এবং এক ছেলের জনক জ্যাক মা। জ্যাং ইং-এর এক আত্মীয় অসুস্থ হওয়ার পর জ্যাক মা পরিবেশ নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেন। তিনি চীনে ২৭ হাজার একর বনায়নের জন্য ফান্ডিং করেছেন।২০১৩ সালে জ্যাক মা আলিবাবার সিইও-এর দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন।
জ্যাক মা সবসময়ই তার খোলামেলা বক্তব্যের জন্য বিতর্কিত। একবার তিনি চীনের ৯-৯-৬ ওয়ার্ক কালচারকে সমর্থন করায় বেশ তোপের মুখে পড়েছিলেন। তবে ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি চীনের অর্থব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার পর দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।
অনেকে ভেবেছিল হয়তো তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে অথবা তিনি হয়তো আর বেঁচে নেই। ২০২৩ এর জানুয়ারীতে আবারো এই বিলিয়নিয়রকে সবার সামনে আসতে দেখা যায়।
জ্যাক মা চীনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। তার সম্পদের পরিমাণ ২৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জ্যাক মা-এর উন্নতির মূল চাবিকাঠি তার অধ্যবসায় ও ধৈর্য্য। পরিশ্রম একজন সাধারণ মানুষকেও যে উন্নতির চরম শেখরে নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন জ্যাক মা।
Featured Image: wallpapersafari.com References: 01. The Inspiring Life Story of Alibaba Founder Jack Ma. 02. The Jack Ma Story Why Thinking Big is More Important than Technical Knowledge. 03. Jack Ma 996 China. 04. Jack Ma Facts. 05. Why did Alibaba's Jack Ma disappear for three months?