হোমিওপ্যাথি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মূল ভিত্তি হলো শরীর তার রোগ নিজেই নিরাময় করতে পারে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি সর্বপ্রথম জার্মানিতে ১৮ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত হয়েছিল। যারা হোমিওপ্যাথি নিয়ে কাজ করেন তারা উদ্ভিদ এবং খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করেন। তারা বিশ্বাস করে যে এইগুলি নিরাময় প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে।
হোমিওপ্যাথি কি?
১৮ শতকে জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান সর্বপ্রথম হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।হোমিওপ্যাথি প্রচলিত ওষুধের বিকল্প বা সংযোজন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
হোমিওপ্যাথি এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যে যদি কোনো পদার্থ কোনো সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গ সৃষ্টি করে, তবে সেই পদার্থের সামান্য ডোজ অসুস্থ ব্যক্তির উপসর্গের চিকিৎসা করতে পারে। কিন্তু এই ধারণা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে খাপ খায় না।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধগুলি সাধারণত উদ্ভিদ, প্রাণি বা রাসায়নিক উপাদান গ্রহণ করে এবং সেই পদার্থটিকে বারবার পানি বা অ্যালকোহলে মিশ্রিত করে তৈরি করা হয়, যাতে প্রায়শই মূল পদার্থের কোনোটিই দ্রবণে না থাকে। এই অতি মিশ্রিত দ্রবণ ট্যাবলেট, তরল এবং ক্রিমসহ বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়।
হোমিওপ্যাথির ইতিহাস
হোমিওপ্যাথি শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘হোমিও’ (সদৃশ) এবং ‘প্যাথোস’ (কষ্ট বা ভোগান্তি ) থেকে এসেছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান কিন্তু প্রথমে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে একজন ডাক্তার হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাকে ভীত করে তোলে।
তখন তিনি এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজে সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি তার পূর্বের চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দেন। অনেক বাধার সম্মুখীন হোন। প্রচুর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। হিপোক্রেটিস, গ্যালেন প্রমুখ প্রাচীন চিকিৎসকরা ব্যবহার করেছিলেন এমন প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি পড়াশুনা করেন।
এভাবে তিনি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন যার ভিত্তি Fundamental Principle এবং এর যার উপজীব্য হলো ‘ল অফ সিমিলিয়া’ বা ‘লাইক কিউর লাইক’ অর্থাৎ, সদৃশ সদৃশের উপশম করে। এভাবে তিনি এই সূত্র অনুসারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
তিনি নিজ দেহেও পরীক্ষা চালান। দক্ষিণ আমেরিকার গাছের বাকল (সিনকোনা) নিয়ে পরীক্ষা করেন যা ম্যালেরিয়া জনিত জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। তিনি নিজে এই বাকল খেয়ে তার প্রথম হোমিওপ্যাথিক পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি দেখতে পেলেন যে বাকল তার মতো একজন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ তৈরি করেছে।
এর থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, যদি একটি পদার্থের অপরিশোধিত ডোজ একজন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে রোগের লক্ষণগুলি তৈরি করে তবে একই পদার্থের একটি অসীম ডোজ সেগুলি নিরাময় করতে পারে। অর্থাৎ, অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা কার্যকর হবে। এভাবে একসময় এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হোন তিনি। ১৭৯০ সালে প্রথম এই চিকিৎসা পদ্ধতি মানবদেহে প্রয়োগ করেন।
তবে হ্যানিম্যান প্রথমে নিজের ওপর, তারপর অন্য মানুষের ওপর বিভিন্ন পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে শীঘ্রই একটি বড় সমস্যা উপলব্ধি করেছিলেন যে তার রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যে পদার্থগুলি দিয়েছিলেন তা প্রায়শই বিষাক্ত ছিল।
এরপরে তিনি আরও গবেষণা করে দেখলেন বিষের যে লক্ষণগুলি তৈরি হয়েছিল তা একই বিষ দিয়ে বিভিন্ন ঘনত্বে নিরাময় করা যেতে পারে। এটিকে ‘সিমিলিয়া সিমিলিবাস কারেন্টুর’ বা ইংরেজিতে ‘লাইক কিউর লাইক’ বলা হয়।
পরবর্তীকালে হ্যানিম্যান এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন যে, তিনি একটি পদার্থকে যত বেশি পাতলা করেন তা তত বেশি কার্যকর হয়। এটি হয়ে ওঠে হোমিওপ্যাথির দ্বিতীয় মৌলিক উপাদান। হোমিওপ্যাথরা প্রকৃতপক্ষে দাবি করেন যে, একটি পদার্থ যত বেশি পাতলা এবং ঝাঁকুনি যত বেশি হয় ততই ওষুধ শক্তিশালী হয় আর এমন একটি প্রক্রিয়াকে বলে পোটেনটাইজেশন।
হোমিওপ্যাথি ওষুধ কীভাবে কাজ করে ?
হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মূল উপাদান ভেষজ, খনিজ বা প্রাণিজ পদার্থ। এই উপকরণগুলি প্রথমে চূর্ণ করা হয় এবং কোনো একটি তরলে দ্রবীভূত করা হয়। এটিকে ‘মাদার টিংচার’ বলে। সাধারণত অ্যালকোহল বা ল্যাকটোজের মতো তরলে উপকরণগুলি যান্ত্রিকভাবে মেশানো হয়, তারপর সংরক্ষণ করা হয়।
অ্যালকোহল বা ল্যাকটোজ টিংচারকে আরও পাতলা করে। অনেক সময় পেশাদার হোমিওপ্যাথরা অনেক বেশি তরল ব্যবহার করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, পদার্থটি যত বেশি পাতলা হবে, তার নিরাময় ক্ষমতা তত বেশি শক্তিশালী হবে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার লক্ষ্য শরীরের নিজস্ব নিরাময় প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করা। হোমিওপ্যাথরা বিশ্বাস করেন যে শারীরিক রোগের লক্ষণের মধ্যে প্রায়ই মানসিক উপসর্গ থাকে। যেমন- জ্বর, উদ্বেগ এবং অস্থিরতা। আর মানসিক উপসর্গগুলো নিরাময় করা তাদের লক্ষ্য থাকে।
ওষুধ সেবনের পাশাপাশি মানসিক উদ্বেগ দূর হওয়ার জন্য যখন রোগী সুস্থ বোধ করে এই প্রক্রিয়াটিই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূল অংশ।আর এই ওষুধ গুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
হোমিওপ্যাথি ওষুধ কতটা কার্যকর?
হোমিওপ্যাথি ওষুধ কতটা কার্যকর তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। কারণ হোমিওপ্যাথি যেকোনো রোগীর স্বাস্থ্যগত অবস্থার চিকিৎসা হিসেবে কার্যকর সেই বিষয়ে তেমন কোনো ভালো প্রমাণ নেই।
হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত কমিটির একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ‘লাইক কিউর লাইক’ নীতিটি ‘তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল’ এবং এটি ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্থির দৃষ্টিভঙ্গি’।
উদাহরণস্বরূপ অনেক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এমন পরিমাণে মিশ্রিত করা হয় যে, চূড়ান্ত ওষুধটির মূল পদার্থের একটি অণুও অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা কম। এই ধরনের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক প্রতিকারে পানি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কিছু হোমিওপ্যাথ বিশ্বাস করেন যে, সাকাশন প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ মূল পদার্থটি পানিতে নিজের একটি ‘ছাপ’ রেখে যায়। কিন্তু এমন কোন জ্ঞাত ব্যবস্থা নেই যার দ্বারা এটি ঘটতে পারে।
তাছাড়া যে কেউ যেকোনো বয়সে হোমিওপ্যাথ হিসাবে অনুশীলন করতে পারে, কোন যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতারও দরকার হয় না। কারণ এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, এক্স-রে, অপারেশন ইত্যাদি নেই।এজন্য কোনো রোগীর এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যর্থ।
কিন্তু এত বিতর্কের পরও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জনপ্রিয়তা কমেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হোমিওপ্যাথিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চিকিৎসা বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন ওষুধ তৈরি ও চিকিৎসা নিয়েও গবেষণা চলছে। আর বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এত জনপ্রিয়তার কারণে মানুষের মনেও হোমিওপ্যাথির প্রতি অনাস্থা তৈরি হয় না। হয়তো হোমিওপ্যাথির ওষুধের কার্যকারিতা আছে!
তাছাড়া কোনো হোমিওপ্যাথ একজন রোগীকে দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, সাধারণ সুস্থতা, মানসিক অবস্থা, জীবনধারা, অতীত রোগের ইতিহাস এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। এভাবে তারা রোগীকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শেখায়।
যা রোগীর ‘হিলিং পাওয়ার’ তথা উজ্জীবিত হওয়ার শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াটি প্লাসিবো প্রভাব নামেও পরিচিত। এর ফলে রোগী তার স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতি দেখতে পারে যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত।
আর হোমিওপ্যাথি ওষুধের আরেকটি বড় সুবিধা হলো এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বা কিছু ক্ষেত্রে খুব সামান্য হয়।ফলে অন্য রোগের সৃষ্টি কম হয়। এখন যদি হোমিওপ্যাথির মতো এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা বেছে নেওয়া হয় যা রোগীর উপর শুধুমাত্র প্লাসিবো প্রভাব ফেলে, তাহলে রোগী অন্যান্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে পারে যা তার জন্য আরও কার্যকর।
তাই হোমিওপ্যাথির পক্ষে ডাক্তারের দ্বারা নির্ধারিত কোনও চিকিৎসা বা টিকা দেওয়ার মতো পদ্ধতিগুলি বন্ধ করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত।
Feature Image: healthline.com References: 01. What is Homeopathy? 02. Homeopathic Medicine Description. 03. Scientific Evidence Homeopathy.