বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ১৯৭৯ সালের প্রথমদিকে পাহলভী বংশের পতন। এই পতনের মধ্যে দিয়েই ইরানি বিপ্লব শুরু হয়। যা ইসলামিক বিপ্লব নামেও পরিচিত। ইরানি বিপ্লব ছিল মূলত পশ্চিমাপন্থী রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্টা করা।
এই বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান একটি ইসলামী রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। তাই ইসলামের আধুনিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অনেকখানি। পৃথিবীর ইতিহাসে রুশ বা ফরাসি বিপ্লবের পর ইরানি বিপ্লব হলো অন্যতম যুগান্তকারী বিপ্লব।
ইরানি বিপ্লবের পটভূমি
পাহলভী রাজবংশ ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরানের শাসন ক্ষমতায় ছিল। ১৯২৫ সালে রেজা শাহ পাহলভী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পারস্য নামেই পরিচিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এই ভূখন্ডটি। মূলত রেজা শাহ ইরান নামকরণ করেন এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে মনোযোগ দেন।
তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো পুরোপুরিভাবে শেষ করতে পারেননি। এর ফলে দেশের জনগণ তার বিপক্ষে চলে যায়। তার পদত্যাগের জন্য আন্দোলন শুরু করে দেয়। এমতাবস্থায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হোন। মূলত তার শাসনামল ১৯৪১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
এরপর তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ ক্ষমতায় বসেন। ধীরে ধীরে জনমতের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেইসাথে ‘টুডে পার্টি’ নামক রাজনৈতিক দল ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক জয়লাভ করেন। জয়লাভ করে তিনি ইরানের তেলসম্পদগুলো জাতীয়করণের চেষ্টা করেন।
এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। জাতীয়করণ করলে এই দুই দেশকে তেল দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। যার ফলে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
এতে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় মোহাম্মদ রেজা শাহ’র। দেশের শাসনব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগ নিয়েই তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির ভাবধারায় মেতে উঠেন। এতে করে পশ্চিম সংস্কৃতির প্রভাব ইরানে পড়তে শুরু করে। কিন্তু ইরানের মুসলিম জনগণ এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে।
আন্দোলন শুরু করে দেয় মোহাম্মদ রেজা শাহের পতনের জন্য। কারণ রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। নারীরা স্বাধীনভাবে ঘুরতে শুরু করে। পোশাক-পরিচ্ছেদে কোন শালীনতা ছিল না। যা ইরানের মুসলিম লোকজন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
পরবর্তীতে যা মুসলিম বিপ্লবে রুপ নেয়। এই আন্দোলনের প্রধান রুপকার ছিলেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। যিনি একজন ইরানি রাজনৈতিক নেতা ছিলেন।
তিনি ১৯৬৩ সালে শেত্ব বিপ্লবের বিরোধীতা করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া তিনি ঘোষণা করেন যে, শাহ ইরানে ইসলামের ধ্বংস সূচনা শুরু করেছেন। তাকে গ্রেফতারের পর তিনদিনের বড় দাঙ্গা ইরানে ছড়িয়ে পড়ে। আটমাস পর খোমেনিকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি শাহের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন শুরু করেন।
এতে করে ১৯৬৪ সালের দিকে খোমেনিকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে দীর্ঘ ১৫ বছরের মতো নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের দিকে আরেকজন আধুনিকতাবাদী ইসলামিক নেতা আলী শরিয়তি-এর আর্বিভাব হয়। কিন্তু শাহ ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করে ফেলে।
ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday)
১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, আয়াতুল্লাহ খোমেনী পনের বছর পর নির্বাসন থেকে মুক্তি পেয়ে মহাসমাবেশের ডাক দেন শাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আয়াতুল্লাহ খোমেনীর এই মহাসমাবেশে প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়। এতে শাহ অনেক বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তিনি কল্পনাও করেননি এত মানুষ যোগ দেবে। এই মহাসমাবেশে শিয়া-সুন্নী সকল মুসলিম শ্রেণী যোগদান করে।
তাদের দাবি ছিল, শাহ পাহলভীর পদত্যাগ এবং পশ্চিমা-সংস্কৃতির সবকিছুই বাদ দিয়ে ইসলামিক পন্থায় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। এতে শাহ পাহলভী দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না।
পরবর্তীতে শাহ পাহলভী সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই সমাবেশে গুলি করা শুরু করে। নির্বিচারে অসংখ্য বিপ্লবী মানুষদের হত্যা হয়। এজন্য ইতিহাসের পাতায় এই দিনটা কুখ্যাত ব্ল্যাক ফ্রাইডে Black Friday বা কালো শুক্রবার নামে পরিচিত এবং আজও এই দিনটা স্মরণীয়।
শাহ পাহলভী অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে সমাবেশ দমন করেন। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনি দমে যাননি। তিনি আবার জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন এবং যেভাবে হোক, ইরানকে মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এই লক্ষে খোমেনী কাজ শুরু দেন। কিন্তু শাহ পাহলভী ষড়যন্ত্র করে তাকে আবার গ্রেফতার করার চেষ্টা করে।
কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। যার ফলে আয়াতুল্লাহ খোমেনবী ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি শাহের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দেন। এক ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ যোগ দেয়। গণ-অভ্যুত্থানের বেগ ঠেকাতে শাহ পাহলভী আগের মতোই তার সেনাবাহিনীদের নিয়োগ করেন।
কিন্তু তার সেনাবাহিনী এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। শাহ পাহলভীর সেনাবাহিনী যখন পরাস্ত হয় তখন তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আশ্রয়ের জন্য তিনি দেশে যান, কিন্তু কোথাও আশ্রয় পাননি। পরবর্তীতে তিনি মিশরে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
আয়াতুল্লাহ খোমেনী হাত ধরেই ইরানের মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি দেশের মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হন। যার ফলে সহজে শাহের বিরুদ্ধে জয় সম্ভব হয়।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবকে আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের পতন হয়। ব্রিটিশ ও মার্কিনদের কাছ থেকে আয়াতুল্লাহ খোমেনী ইরানের তেল সম্পদ পুরোপুরিভাবে জাতীয়করণ করে ফেলেন।
আস্তে আস্তে ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। তাছাড়া বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ইরানকে রাজতন্ত্র থেকে ইসলামিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা হয়। সেই সাথে ইসলামিক শরিয়াহ আইন অনুযায়ী অনেক সাংবিধানিক পরিবর্তনও করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হলো ইরান।
Feature Image: muckrock.com References: 01. Iranian-revolution 02. The Iranian-Revolution 03. The War Peace of Iran 04. The Iran-Revolution (Group Presentation)