সাল ১৯১৪, পুরো ইউরোপ জুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! কিন্তু তৎকালীন সময়ের পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, তখনো নীরব। রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ঘোষণা করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকবে নিরপেক্ষ এই যুদ্ধে। কিন্তু পরবর্তীতে আমেরিকার এই মত পরিবর্তন হয় এবং জড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
পাল্টে যায় যুদ্ধের মোড়। যুক্তরাষ্ট্র পালন করে বিরাট ভূমিকা। যুদ্ধের ভারসাম্য রক্ষায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ফায়ার পাওয়ার, সম্পদ এবং সৈন্য, তাদের মিত্রদের অনেক বেশি সাহায্য করে। এককথায়, পুরো যুদ্ধের গতিবিধি পরিবর্তন হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্ভুক্তিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসূত্রের আছে জানা অজানা গল্প। সেগুলো নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু
প্রতিষ্ঠিত অনেক সাম্রাজ্যের পতন, নতুন দেশের সৃষ্টি ও প্রায় সাত কোটি সেনাদের অংশগ্রহণসহ অনেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার সাক্ষী এই যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের আভাস মূলত অনেক আগে থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। এই যুদ্ধের পটভূমি, বহু বছরের, বহু ঘটনার ফল।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা। এছাড়া, বিভিন্ন ছোট ছোট যুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিধি সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করে পরাশক্তিরা। ফলে রাশিয়া, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি ইত্যাদি দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের সৃষ্টি হতে থাকে।
তখনকার সময়ের সৃষ্ট ছোট ছোট সমস্যাগুলো পরাশক্তিরা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী ছিল না। তারা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাধানের দিকে বেশি প্রাধান্য দিতো। দিন দিন সংকট বেড়েই চলছিল। এবং পরিস্থিতি এতই খারাপ হচ্ছিল যে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছিল।
অবশেষে বহু বছরের পুরনো এই যুদ্ধের বীজের পূর্ণ অঙ্কুরোদগম হয়। ১৯১৪ সালে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রীর হত্যার মাধ্যমে। হত্যাকারী ছিল বসনিয়ার সার্ব জাতীয়তাবাদী। তাই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় এক মাসের মধ্যেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানরা বসনিয়া আক্রমন করে।
বলে রাখা ভালো যে, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষ, অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি নামে পরিচিত ছিল। অক্ষশক্তির দেশগুলোর মধ্যে ছিল জার্মানি, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া এবং বুলগেরিয়া। অন্যদিকে, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও সার্বিয়া ছিল মিত্রশক্তির দেশসমূহ। এবং পরবর্তীতে এদের সাথে আমেরিকা যোগদান করে।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়দের সার্বিয়ার উপরে আক্রমনে খুব স্বাভাবিকভাবেই অক্ষশক্তির দেশগুলো সমর্থন করে। সাথে সাথে মিত্রশক্তির দেশগুলো এর বিরোধিতা করে। এক এক করে শুরু হতে থেকে ইউরোপের পরাশক্তি দেশগুলোর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক এক যুদ্ধ, এক ধ্বংসযজ্ঞ।
আমেরিকার নিরপেক্ষতা
The United States must be neutral in fact, as well as in name, during these days that are to try men’s souls.
৪ আগস্ট যখন বিশ্বযুদ্ধ পুরো ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন রাষ্ট্রপতি উইড্র উইলসন ঠিক এই মন্তব্যটির মাধ্যমে যুদ্ধে আমেরিকার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেন। ওই সময় কোন গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও ঝুঁকি মার্কিনীদের কাছে পরিলক্ষিত হয়নি। তাই তারা প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের সমর্থন দান করে।
কিন্তু আমেরিকা কি পুরোপুরি নীরব থাকতে পেরেছিল? না, আসলে। যুদ্ধে যদিও তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু ওই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর প্রচুর অভিবাসীদের আশ্রয় দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি তাদের অনেক সংস্থা এবং কোম্পানি যুদ্ধে কাঁচামাল, যুদ্ধসামগ্রী, খাদ্য ইত্যাদি সরবারহ করত। যদিও, আমেরিকার থেকে এসব সুবিধা অক্ষশক্তির দেশগুলোর চেয়ে মিত্রশক্তির দেশগুলো বেশী পেতো।
সিঙ্কিং অফ দ্য লুসিটানিয়া
শান্তিপ্রিয়, নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের নেপথ্যে মূলত যে কয়টি কারণ ছিল তার মধ্যে লুসিটানিয়া অন্যতম। মূলত ১৯১৫ সালের দিকে, আমেরিকা, মিত্রবাহিনীর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করে। জার্মানি তখন ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে পারেনি। তখন তারা মিত্রশক্তির জলপথের এই সখ্যতা ভাঙ্গার চেষ্টা করে।
এই চক্রান্ত করে জার্মানি তাদের ডুবোজাহাজ ‘ইউবোট’ দিয়ে, মিত্রবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বাণিজ্যিক জাহাজ, সামরিক, বেসামরিক জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল যাত্রীবাহী জাহাজ লুসিটানিয়া। এই হামলায় মার্কিন ১২৮ জনসহ মোট প্রায় বারোশো মানুষ নিহত হয়েছিল।
এই ঘটনা রাষ্ট্রপতি উইলসনসহ সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে জার্মানি বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করে। এরই ধারাবাহিকতায় উইলসন জার্মানিকে অঘোষিত সাবমেরিন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব দিতে বাধ্য হোন।
যুদ্ধে আমেরিকার প্রবেশ
১৯১৬ সাল। অক্ষশক্তির কোন দেশ, বিশেষ করে জার্মানি মার্কিনদের জন্য উস্কানিমূলক কোন কাজ করেনি। তাই আমেরিকা নীরবেই যুদ্ধের সময়গুলো পার করে। কিন্তু, ১৯১৭ সালের শুরুর দিকে জার্মানি পুনরায় সাবমেরিন যুদ্ধ শুরু করে। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষিপ্ত করে দেয়।
উপরন্তু, ১৯১৭ এর জানুয়ারীতে, জিমারম্যান টেলিগ্রাম নামে খ্যাত, জার্মানির এক টেলিগ্রাম বার্তা আটকে দেয় ব্রিটিশরা। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জিমারম্যান, মেক্সিকোতে থাকা জার্মান মন্ত্রী হেনরিখ ভন একহার্টেরকে বার্তাটি পাঠায়।
টেলিগ্রাম বার্তাটিতে জার্মানি মেক্সিকোকে, আমেরিকা-মেক্সিকো যুদ্ধে হারানো অঞ্চলগুলো ফিরে পেতে সাহায্য করবে বলে জানায়। যদি আমেরিকা মিত্রদের সাথে বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর বিনিময়ে জার্মানি চেয়েছিল মেক্সিকো জাপানকে রাজি করাবে যুদ্ধে জার্মানির পক্ষে জোগদানের জন্য।
টেলিগ্রামটি ১৯১৭ সালের পয়লা মার্চ রাষ্ট্রপতি উইলসনের কাছে পৌঁছায়। এই ঘটনা আমেরিকার যুদ্ধে যোগদান করাকে অবধারিত করে দেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালের ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট উইলসন যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান বিরোধী যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, ‘The world must be made safe for democracy’। এরপর ৬ এপিল, মার্কিন প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার সেনা মিত্রদের সাথে যোগ দেয়। এরই মাধ্যমে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে প্রবেশ করে।
দ্য ফোরটিন পয়েন্টস
১৯১৮ সাল, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ। পৃথিবীর সব পরাশক্তিরা একে অপরের দিকে ছুঁড়ে চলছে বিশাল বিশাল বন্ধুদের গোলা, বোমা বারুদ, মিসাইল। আমেরিকার জন্য এই যুদ্ধের গতিপথ কেমন ছিল?
বিধ্বংসী এই বিশ্বযুদ্ধ ছিল অনেক বেশি খরচের। যুদ্ধের এক বছরে, আমেরিকার প্রায় ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল। সাথে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার মার্কিনি নিহত হয়েছিল। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট উইলসন চেয়েছিল যুদ্ধ শেষ হোক।
এমতাবস্থায়, যুদ্ধ বন্ধ ও বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৮ সালের ৮ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট উইলসন বিখ্যাত চৌদ্দ দফা প্রবর্তন করেন। এরই মাধ্যমে তিনি হয়ে যান পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি তার যুদ্ধের লক্ষ্য সরাসরি প্রকাশ করেছিলেন।
উইলসন মূলত চেয়েছিলেন ইউরোপ, আমেরিকাসহ বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং মেলবন্ধন। সর্বপ্রথম তার এই বিখ্যাত ১৪ পয়েন্টের মাধ্যমেই ‘লীগ অফ নেশনস’ প্রতিষ্ঠার কথা ফুটে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিনতি
সভ্য যুগের অসভ্য ও নৃশংসতম এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। মিত্রশক্তি এবং জার্মানির মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরিসমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ চার বছর স্থায়ী মর্মান্তিক এই যুদ্ধের। মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তি পরাজয় বরণ করে। ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহতম যুদ্ধের ফলাফল কতটা ভয়ানক ছিল?
এই বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দুই কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল। যাদের মধ্যে ৯০ লাখ যোদ্ধা ও নিরীহ মানুষের সংখ্যা ছিল এক কোটির মতো। এই যুদ্ধে আরো প্রায় তিন কোটি সামরিক ও বেসামরিক মানুষ আহত হয়েছিল। দেখা দিয়েছিল অনেক দুর্ভিক্ষ, অভাব-অনটন। গৃহহীন হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ।
এছাড়াও, এই বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার মতো এরই খরচের হিসাবটাও ছিল ব্যাপক। প্রত্যক্ষভাবে এই যুদ্ধে খরচ হয় প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পুরো বিশ্ব রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। রোমান, জার্মান, অটোমান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিও এই চারটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পুরোপুরি পতন ঘটে। এর ফলে অটোমানদের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে।
পরিসমাপ্তিতে পরাজিত অক্ষশক্তির দেশগুলোর উপরে মিত্রশক্তির দেশগুলো অবৈধ অনেক নিয়মনীতি চাপিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা প্রকট হতে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় দীর্ঘ চার বছর ধরে চলা এই বর্বরতম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল ভয়াবহ।
মানুষে মানুষে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের ইতিহাস মানব সভ্যতার মতোই পুরনো। বিভিন্ন কারণে ঘটা এত সব যুদ্ধের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম বিভীষিকাময় ও নৃশংসতম যুদ্ধের মধ্য একটি। প্রথমবারের মতো স্থল পথ ছাপিয়ে আকাশপথেও বিস্তৃত হয়েছিল এই মরনখেলা। জাপান থেকে আমেরিকা, পৃথিবীর এমন কোন পরাশক্তি নেই, যারা তখন লিপ্ত হয়নি ভয়াবহতম এই যুদ্ধে। ফলাফল, কোটি কোটি মানুষের মরন, অনাহার, দুর্ভিক্ষ, বাস্তহীনতা।
আপাতদৃষ্টিতে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলেও এর রেশ রয়ে যায় বহু বছর ধরে। এভাবেই ইতিহাসের পাতায় এক চিরস্থায়ী কালো অধ্যায় হয়ে থেকে গেছে, ১৯১৪ সালের এই দ্য গ্রেট ওয়ার।
Feature Image: STPL Reference Slidell References: 01. The U.S.A. In The World War 1. 02. First World War. 03. U.S Participation In World War 1.