ইমাম গাজালি: বিলাসী খ্যাতিময় জীবন থেকে হুজ্জাতুল ইসলাম

729
0

তাকে বলা হয় ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ তথা ইসলামের প্রামাণ্য অবয়ব। স্বীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় আজ এক হাজার বছর পরে এসেও তিনি চর্চিত। এমনকি মুসলিম সাধক হয়েও ইউনেস্কোর সেরা ১০০ মনীষীর শিক্ষাবিষয়ক ভাবনাতেও তার চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটে। পুরো নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসী আল-গাজালি। তিনি দর্শনশাস্ত্রের কিংবদন্তী, ইমাম গাজালি (রঃ)।

ইমাম গাজালি (রঃ) ছিলেন প্রসিদ্ধ সুফিসাধক ও শিক্ষাবিদ। নিজের প্রজ্ঞা দ্বারা ইসলামকে করেছেন সৌন্দর্য্যমন্ডিত। শুধু সাধনাই নয়, নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনন্য দর্শন যা ইসলামের ইতিহাসে তাকে চিরস্থায়ী আসন গড়ে দিয়েছে। নিজের লেখা বই দ্বারাও তিনি বিখ্যাত। তার চিন্তাভাবনাকে ধরা হয় মুসলিম ধর্মচিন্তার বিবর্তন হিসেবে। সমকালীন দার্শনিকদের অপরাগতার জবাব দিয়ে বলেন ‘দর্শনচিন্তা কখনো ধর্মীয় চেতনার ভিত্তি হতে পারে না।’

ইমাম গাজালি (রঃ) খোরাসান তথা ইরানের তুস নগরীর তাবরান শহরে ১০৫৮ খ্রীস্টাব্দে (৪৫০ হিজরী) জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু হামিদ ইবনে মুহাম্মদ আল-তুসী আল-শাফী আল-গাজালি। তার বাবা ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত সুতা ব্যবসায়ী। পারিবারিকভাবে সুতার ব্যবসা থাকায় তিনিও গাজালি বা গাজ্জালি নামে পরিচিত হন। কারণ গাজ্জাল শব্দের অর্থ সুতা বা সুতাজাতীয় পণ্য।

আবার ভিন্ন মত অনুসারে, তার চেহারায় হরিণের সৌন্দর্য্য ফুটে উঠায় বাবা-মা তাকে গাজ্জালী বলে ডাকতেন। প্রসঙ্গত, গাজ্জাল শব্দের অন্য অর্থ হরিণ। তবে রুপ কিংবা পারিবারিক ব্যবসার খাতিরে নন, ইমাম গাজালি (রঃ) পরিচিত হয়েছেন নিজের পরিচয়ে।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন নিজের শহরের স্থানীয় শিক্ষকদের কাছে। এরপর তিনি কাস্পিয়ান সাগরের তীরে জুরজান এলাকায় এসে ইমাম আবু নাসর ইসমাইলীর অধীনে পড়াশোনা শুরু করেন। সেই সময়ের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল অনেকটা বর্তমানকালের নোট/শীট ব্যবস্থার মতো। শিক্ষক বক্তব্য দিতেন, ছাত্ররা নোট করে রাখতেন। তরুণ গাজালি অনায়াসেই নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মাধ্যমে সেসব আয়ত্ত করতে পারতেন। তার এই সংকলন নিয়ে ডাকাতদল সম্পর্কিত ঘটনাও রয়েছে।

ইমাম আবু নাসর-এর থেকে জ্ঞানপিপাসা মিটিয়ে নিজের জ্ঞানচর্চা বাড়াতে তিনি তখন নিশাপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময় নিশাপুরে বাস করতেন ইমাম আল হারামাইন; যিনি কি না স্বীয় যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিলেন। নিজের মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানচর্চায় ইমাম গাজালি ইমাম আল হারামাইন এর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন।

নিজের গুরুর প্রতিষ্ঠানেই মুয়ীদ হিসেবে শিক্ষাদান শুরু করেন ইমাম গাজালি image source – pai unida Gontor

এরপর তিনি সেখানেই মুয়ীদ বা সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। শিক্ষকের সহায়তায় তিনি বই লিখতে শুরু করেন এবং খুব অল্প সময়েই তার খ্যাতি চারদিকে ছড়াতে শুরু করে। ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইমাম আল হারামাইন-এর মৃত্যু হয়। আর উস্তাদের মৃত্যুর মাধ্যমেই গাজালির নিশাপুর অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। নিজেকে আরো বিকশিত করতে তিনি রওনা করেন বাগদাদের উদ্দেশ্যে।

বাগদাদে এসে ইমাম গাজালি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান নিজামিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। গাজ্জালীর মেধা, বাকপটুতা, বিচক্ষণতা দেখে নিজামুল মুলক স্বয়ং তার প্রশংসা করেন। অতি দ্রুতই গাজ্জালী বাগদাদের পন্ডিতসমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন।

তারই ধারাবাহিকতায় ১০৯২ খ্রীস্টাব্দে মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই ইমাম গাজালি নিজামিয়ার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন যা তৎকালীন সময়ে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ ছিল। তার খ্যাতি ও প্রভাব সর্বত্র বিস্তৃতি পেতে লাগল এমনকি রাজপরিবারেও তার কথার প্রভাব দেখা যেতে লাগল। বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে লাগলেন তিনি। তবে বেশিদিন নিজেকে দুনিয়ার মোহে টিকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। ইমাম গাজালি নিজের আত্মজীবনী ‘ফর সিক্স মানথস’ এ লিখেন,

I was in a state of tremendous anxiety until I could not speak, nor eat, nor teach. Eventually I became ill, physicians declared me untreatable.

বিলাসবহুল জীবনে থেকেও তার এমন কেন মনে হয়েছিল? মূলত আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আগ্রহ থাকায় সেই সাধনাই তাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল পার্থিব জগৎ সামান্য মোহ ছাড়া কিছু নয়। প্রায় সার্বক্ষণিক তিনি নিজের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতেন, কেন তিনি এত বিলাসিতায় থেকেও অসুখী!

তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন। আর নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে অনুধাবন করলেন ইসলামের তীব্রতম সত্যটি। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, পরকালীন জীবনে শান্তির জন্য প্রয়োজন তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি। আর এর জন্য অবশ্যই দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে হয়। দুনিয়াবি লোভ-লালসা থেকে মুক্ত না হলে স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়া যায় না।

স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে কঠোর জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত হন ইমাম গাজালি (রঃ) Image source – Quora

নিজের কর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, তার বক্তব্য বা কাজের উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মর্যাদা ও খ্যাতির জন্য যা তাকে চূড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। আর তাই তিনি বাগদাদ ত্যাগ করে স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জনে কাজ করতে চেয়েছিলেন। তিনি যখন বাগদাদ ত্যাগ করতে চান, স্বাভাবিকভাবেই বাঁধা পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের জ্ঞানের প্রগাঢ়তা তাকে আটকে রাখতে দেয়নি। তিনি সিরিয়া গমন করেন।

দামেস্কে একাকি সাধনায় লিপ্ত হলেন ইমাম গাজালি। তিনি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আত্মশুদ্ধিতে কাজ করতেন। গ্র‍্যান্ড উমাইয়া মসজিদের পশ্চিম মিনারে তিনি দীর্ঘ ধ্যানে  সময় কাটাতেন। তিনি সেখানেও শিক্ষকতা করতেন। দুই বছর কঠোর ধ্যান ও শিক্ষা অনুশীলনের পর তিনি জেরুজালেমে আসেন এবং তার কিছুদিন পরই তিনটি প্রতিজ্ঞা করেন।

জেরুজালেম থেকে নিকটেই খলিফ শহরে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কবরের সামনে তিনি তিনটি প্রতিজ্ঞা করেন।

১. কখনো রাজসভায় যোগ দেবেন না।
২. কখনো কোনো রাজ উপহার গ্রহণ করবেন না।
৩. কখনোই কারোর সাথে তর্কে লিপ্ত হবেন না।

ভাবা যায়, যে জ্ঞানী ব্যক্তির প্রভাব বাগদাদের সিংহাসনেও ভূমিকা রাখত, যুগশ্রেষ্ঠ বিতার্কিক ছিলেন যিনি, কতটা প্রখরতায় নিজেকে আবদ্ধ করলে এমন প্রতিজ্ঞা করা যায়! নিজেকে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।

এরপর তিনি হজ্জ্ব করতে যান। দীর্ঘ দশ বছর ধরে তিনি সাধনা করে গেছেন সত্যের। পাহাড়, মরুভূমি, জঙ্গল-প্রতিটি স্থানেই গমন করেছেন, সাধকদের সমাধিস্থলেও কাটিয়েছেন সময়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি শুধু নিজের জ্ঞানই বাড়াননি, ছাত্রদের পড়িয়েছেন, শিখিয়েছেন। বিভিন্ন বিখ্যাত বইও লিখেছেন। তার রচিত বইগুলো সংকলন করেন মাওলানা শিবলী নুয়ামানি।

৪০টি খন্ডে প্রায় ৬৭টি বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন তিনি। যদিও আরো অনেক বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়নি পরে।
ইমাম গাজালি (রঃ) এর বিখ্যাত কিছু গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-‘ইহইয়া উলুম আল দ্বীন-ধর্মীয় বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন’, ‘কিমিয়া সাদাত’-কল্যাণের সারাংশ’, ‘মিনহাজ উল আবিদীন’ ইত্যাদি।

লেখক হিসেবেও বিখ্যাত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) image source – Wardah books

ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে তিনি যখন বাগদাদে ফিরলেন, সকলে সানন্দে নিজামিয়ার দায়িত্ব দিয়ে বরণ করেছিলেন এই মহীয়ানকে। ধারণা করা হয় এখানেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ-The Revival of Religious Sciences. ইসলামিক স্কলারশীপের অন্যতম ক্লাসিক এটি। নিজের শহর তারবানে ফেরার আগে নিজামিয়ায় অল্পসময় শিক্ষকতা করেন তিনি। এছাড়াও সেখানে তিনি একটি সেমিনারি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন।

৫০৫ হিজরী তথা ১১১১ খ্রীস্টাব্দে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই সুফি সাধক। নিজের মৃত্যুকালীন সময়েও স্বীয় জ্ঞানের মহিমা দেখিয়েছিলেন তিনি। তার ছোট ভাইয়ের মারফতে জানা যায়, সেদিন ছিল সোমবার। ইমাম গাজালি ফজরের নামাজের জন্য উঠেন, অজু করে নামাজ আদায় করে নিজেই কাফনের কাপড় চেয়ে নিয়ে তাতে চুম্বন করে পরিধান করলেন এবং বললেন,

আমি আমার প্রভুর আদেশ সাগ্রহে মেনে নিচ্ছি।

এরপর তিনি শুয়ে পড়লেন এবং পৌছে গেলেন চিরস্থায়ী দুনিয়ায়।

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. Al-Ghazālī. 
02. The Life and Works of Imam Al-Ghazali.