গ্রিনল্যান্ডে সবুজের দেখা পাবেন না আর আইসল্যান্ডে শুভ্র বরফের। কিন্তু দুটো স্থান প্রাণ প্রাচুর্য আর অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দুটো স্থানেরই আলাদা রীতিনীতি, বৈশিষ্ট্য, খাবার দাবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, ধর্মীয় বিশ্বাস সব কিছু আছে। আবার মিলও আছে অনেক। এখন, ভাবুনতো আপনি পরিব্রাজক হিসেবে কোথায় যাবেন, যদি নাই জানেন সে দেশ নিয়ে? আজকে আমরা আপনাদের জানাব, আইসল্যান্ড এবং গ্রিনল্যান্ড নিয়ে কিছু জানা-অজানা গল্প।
আইসল্যান্ড নাম কীভাবে এলো?
আইসল্যান্ডের প্রথম নাম ছিল স্নো ল্যান্ড। একজন নরওয়েজিয়ান স্নো ল্যান্ডে যখন পা রাখেন, তখন স্নো ফল হচ্ছিল। পরবর্তীতে একজন সুইডিশ ব্যক্তি Garoar Svarasson এই দেশের নামকরণ করেন নিজের নামে। বর্তমানের নামটিও একজন নরওয়েজিয়ানের দেয়া।
৯ম শতাব্দীতে হরাফনা ফ্লোকি নামের এক জলদস্যু ছিলেন এই নামকরণের পেছনে। তিনি কাকের সাহায্যে এই দ্বীপে পৌঁছান। যে সময়ে তিনি তার দলবল নিয়ে পৌঁছান তখন বেশ গরমকাল ছিল। তারা কেউ শীতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ আসা শীতে তাদের খাদ্য মজুদ নষ্ট হয়ে যায়।
তারা ফিরেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় ফ্লোকি একটা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেন। সেখান থেকে দেখতে পান পুরো এলাকার একটা দৃশ্য। সেখানে সমস্ত অঞ্চল প্রায় বরফ আচ্ছাদিত ছিল। সেই কারণেই এই দেশের নাম দেয়া হয় আইসল্যান্ড। ফ্লোফি আইসল্যান্ডে ফিরে এসে মৃত্য পর্যন্ত এখানেই ছিলেন।
গ্রিনল্যান্ড নাম কীভাবে এলো?
গ্রিনল্যান্ড এর দক্ষিণাংশ আসলেই সবুজে পরিপূর্ণ। এখানে প্রথম যারা আসেন, তারা এসেছিলেন সবুজাঞ্চলেই। তারাই করেছিলেন এই নামকরণ। শোনা যায়, এখানেও নরওয়েজিয়ান জলদস্যু এসেছিলেন। ১০ শতাব্দীতে এরিক দ্য রেড নামের এই জলদস্যুকে আইসল্যান্ড থেকে খুনের দায়ে বিতাড়িত হন। এখানে এসে আবাস গড়েন।
বরফহীন অঞ্চল খোঁজ করতে করতে একসময় সবুজ অঞ্চলের দেখা পান। সেখানেই বেঁচে থাকার জন্য রসদ তৈরি করতে থাকেন। তিন বছর পর, আইসল্যান্ডে ফিরে গিয়ে বেশ বড় দলবল নিয়ে ফিরে আসেন গ্রিনল্যান্ডে। বসতি সেখানেই গড়ে ওঠে, যেখানে সবুজের দেখা বেশি মেলে।
আইসল্যান্ড এবং গ্রিনল্যান্ড সমাচার
সত্যি কথা বলতে, আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতিটি দেশেই আছে সৌন্দর্য সম্ভার। গ্রিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ড দুটো দেশই প্রকৃতির বিস্ময়। দুটো দেশই শীতপ্রধান, দুটো দেশই উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। সারাবছর শীতকাল থাকে, তারপরও আইসল্যান্ডে শীতের তীব্রতা গ্রিনল্যান্ডের চাইতে কিছুটা কম। এই অঞ্চলে গরমকাল খুব স্বল্প সময়ের জন্য থাকে, এবং এটায় ঘুরতে যাবার জন্য সেরা সময়।
পর্যটকগণ এই সময়ে কায়াকিং, হাইকিং এর মতো দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে পারেন। মজার ব্যাপার হলো, আইসল্যান্ড বলুন আর গ্রিনল্যান্ড বলুন, দুটো দেশেই পাবেন নর্দান লাইটসের দেখা। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত সুধা ঢেলে দিয়েছে নিজের হাতে। গ্রীষ্মে আইসল্যান্ডের তাপমাত্রা থাকে ৫০ ডিগ্রি থেকে ৬০ ডিগ্রি, যেখানে গ্রিনল্যান্ডে তাপমাত্রা থাকে ৪০ ডিগ্রি থেকে ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এদিকে আইসল্যান্ডে গ্রিনল্যান্ডের চাইতে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা বেশি। বিশেষত বসন্তকালের বৃষ্টি ঝরনাগুলোর সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আইসল্যান্ডে বাতাসের প্রবাহ ও বেশি। এদিকে গ্রিনল্যান্ডের বাতাসের আর্দ্রতা বেশ কম এবং জলাবায়ু শুষ্ক।
গ্রিনল্যান্ড সবুজ নয়, আইসল্যান্ডে নাই বরফ নামে বেশ প্রচলিত কথা আমরা সবাই জানি কম বেশি। গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৭৯% বরফের নীচে আচ্ছাদিত। এই বরফের পরিমান নেহাত কম নয়। হিসেবে দেখা যায়, আন্টার্কটিকার পরেই গ্রিনল্যান্ডে বরফের পরত এটি।
আবহাওয়ার দিক থেকে দেখতে ফেলে নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ এই বরফের দেশটি। বৈপরীত্যে পরিপূর্ণ এ দেশের উত্তর দিকে আর্কটিক মরুভূমি, দক্ষিণে আছে সবুজ চারণভূমি। ভাবুন তো, একই দেশে প্রকৃতির কত আশীর্বাদ।
এদিকে আইসল্যান্ডে যে কেবল সবুজ আছে, বরফ নাই সেটাও ভুল। পুরো দেশটির প্রায় ১১% বরফে আচ্ছাদিত। কিন্তু মৃদ্যু জলবায়ু এবং আদ্রতার তারতম্যের দরুণ আইসল্যান্ডে গ্রীষ্মকালে প্রচুর পরিমানে সবুজের দেখা মেলে।
নর্দান লাইটস
নামের ভিন্নতা থাকলেও নর্দান লাইটসের ক্ষেত্রে গ্রিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ড-এর নর্দান লাইটসের তুলনা করা সম্ভব নয়। বিশ্বের অন্য যে সকল দেশে এই আলোর দেখা মিলবে, তাদের অধিকাংস লাইটসই, এই দু দেশের কাছে সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
দুটো দেশের আছে বিশেষ ‘the invisible aurora belt’, যার কারণে রাতের আকাশে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায়। সৌরকণা যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে, তখন এই আলোর খেলা দেখা যায়। কিছু কিছু মানুষ জানিয়েছেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা walrus বা সিন্ধুঘোটকের মাথা দিয়ে এই আলোকচ্ছটায় ফুটবল খেলতেন।
নামে, পরিবেশের মতো নর্দানলাইটের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো গ্রিনল্যান্ডে নিজের বাসার জানালা দিয়ে নর্দান লাইটস দেখতে পারবেন, বিশেষত যদি (Nuuk) নুক বাসিন্দা হোন। গ্রিনল্যান্ডে আলোর দূষণ কম হবার কারণে এই অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। এই আলোতে আপনি হাঁটাহাঁটিও করতে পারবেন অনায়াসে।
অবস্থান এবং আয়তন
দুটো দেশই আর্কটিক এবং আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত। ডেনমার্ক প্রণালী বিভক্ত করেছে এই দুটো দেশকে। ভৌগলিকভাবে, গ্রিনল্যান্ড নর্থ আমেরিকায় এবং আইসল্যান্ড ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার টেকটোনিক প্লেটে অবস্থিত।
আইসল্যান্ডের আয়তন ১,০৩,০০ বর্গকিলোমিটার যেখানে ২.১৬৬ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। একা কিংবা দলবলে, সৌন্দর্য উপভোগ করতে গ্রীষ্মকালে ঘুরতে যেতে পারেন এই দুটো দেশে। তবে এই দুটো দেশে যেতে হলে, গামবুট, রেইনকোট, গরমকোট সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন।
গ্রিনল্যান্ড বনাম আইসল্যান্ড
যারা একটু এডভেঞ্চার প্রিয়, নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভালোবাসেন কিংবা প্রকৃতির বন্যতা কে ভালবাসেন আপন করে নিতে চান, নিত্য নতুন জায়গাতে নিজেকে আবিষ্কার করতে চান, তাদের জন্য আইসল্যান্ড সেরা।
কারণ এখানকার অনেক অঞ্চল এখন অনাবিষ্কৃত রয়েছে। অন্যদিকে গ্রিনল্যান্ড আক্ষরিক অর্থে প্লেনের দুরুত্ব, গ্রিনল্যান্ডের ভ্রমণের প্যাকেজও পেয়ে যেতে পারেন সুযোগ পেলে।
দুটো দেশেই বরফ কিংবা সবুজের দেখা মিলবে, মিলবে বৈপীরত্বের দেখা। খাদ্য আয়তন, মানুষ, প্রাণীকুল, গাছপালা , ফসল, রীতিনীতি আছে মিল-অমিল। আয়তনের পার্থক্য, জনসংখ্যার পার্থক্য ও চোখে পড়ার মত। সৌন্দর্যে কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দেয়নি। প্রকৃতির অপার সুধা ঢেলে দিয়েছে এই দুটো দেশে।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলে, গ্রীষ্মকালকে বেছে নিতে হবে। অন্যসময় যে ভ্রমণ করা যাবে না এমন টা নয়। তবে এই দুই “ল্যান্ড” তাদের সৌন্দর্যের ডালা উজাড় করে দেয় এই মাসে। তবে যখন ভ্রমণ করেন না কেন সাথে রেইনকোট, গামবুট, পানি নিরোধক সামগ্রী সাথে রাখবেন। আর নর্দান লাইটসের সৌন্দর্য কোন ভাবেই মিস করা উচিৎ হবে না, যদি আরো কোন সৌন্দর্য দেখতে নাও চান।
Feature Image: pinterest.com References: 01. https://www.celebritycruises.com/blog/iceland-vs-greenland? 02. https://visitgreenland.com/articles/greenland-vs-iceland-the-arctic-travel-battle. 03. https://fullsuitcase.com/iceland-vs-greenland.