প্রকৃতির শক্তির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলুদ নদী যা চীনে প্রবাহিত হয়, এটি বিশ্বের বৃহত্তম নদীগুলির মধ্যে একটি। এই বৃহত্তম নদীটি পৃথিবীর কাছে দুঃখের নদী হিসেবে পরিচিত। চীনের এই হলুদ এবং দুঃখের নদীটির আসল নাম হোয়াংহো নদী। এটি চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে, সবশেষে বোহাই সাগরে এসে মিশে।
চীনের প্রাচীন লোকগল্প অনুযায়ী, কুয়া ফু নামের এক দৈত্য তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই নদীটির নিষ্কাশন করেছিল। মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে এই নদীর গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। প্রাচীন চীনে শুধু হোয়াংহো নদীকে হো নামে ডাকা হতো। চীনা ভাষায় হো মানে নদী। তখন অন্যান্য নদীকে ‘ছুয়ান’ বা ‘শুই’ বলা হতো। ছুয়ান মানে পর্বতের নদী, যা সাধারণ নদীর চেয়ে ছোট। আর শুই মানে পানি।
লোক বিশ্বাস
আবার, প্রাচীন চীনের কিছু লোক-কাহিনীতে দূঃখ-দূর্দশার কারণরূপে হোয়াংহো নদীর নাম পাওয়া যায়। হোয়াংহো নদীর তীরবর্তী ইয়েদি নামক গ্রামের অধিবাসীরা সি মেন পাও এর কাছে তাদের সব থেকে বেশি দুঃখের কারণ হিসেবে হোয়াংহো নদীর কথা উল্লেখ করেন। তারা মনে করতেন হোয়াং হো নদীর দেবতা নদীতেই থাকে; প্রতি বছর দেবতা নতুন স্ত্রী চায়।
স্থানীয় অধিবাসীরা যদি দেবতার জন্য প্রতি বছর স্ত্রী যোগাড় না করে দেয় তবে তিনি ক্ষুব্ধ হবেন এবং গোটা অঞ্চলের অধিবাসীদের বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেবেন। আর তাই দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় সরকার ও ডাকিনীরা সোতসাহে হোয়াংহো দেবতার জন্য তথাকথিত স্ত্রী বেছে নেয়ার কাজ করতেন এবং এই সুযোগে অধিবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন। হোয়াংহো নদীর বন্যার ভয়ে চীনের মানুষ যে কতটা সন্ত্রস্ত ছিল তার ইঙ্গিত এমন অনেক লোক-কাহিনীর মধ্যে নিহিত রয়েছে।
চীনের নদী
বাংলাদেশের ন্যায় চীন একটি নদী বহুলদেশ। চীনের নদীর সংখ্যা প্রায় ১৫০০, স্থলভাগের মোট আয়তনের ৬৪ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এসকল নদ-নদী। এই ১৫০০ নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।
চ্যাং জিয়াং
এটি চীনের দীর্ঘতম নদী। এর মোট দৈর্ঘ্য ৬৩০০ কিলোমিটার। নীল নদ আর দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীর পর চ্যাং জিয়াং বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম নদী।
কিয়ানতং নদী
চীনের আনহুই এবং জিয়াংজি প্রদেশের সীমান্ত থেকে এই নদী উৎপন্ন হয়ে জেজিয়াং প্রদেশের রাজধানী জিয়াংগসি শহরের পাশ দিয়ে হাংঝোউ উপত্যাকা পার হয়ে পূর্ব চীন সাগরে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪৫৯ কিলোমিটার।
হোয়াংহো নদী
এটি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। পশ্চিম চীনের কিংঘাই প্রদেশের বেয়ান হার পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে চীনের নয়টি প্রদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রায় ৫৪৬৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বোহাই সাগরে পতিত হয়েছে। আকাশ থেকে দেখলে হোয়াংহো নদীটিকে চীনা অক্ষর ‘ঢ়’-এর মতো দেখায়।
মেকং
উৎপত্তির বিচারে এটি চীনের নদী। কিন্তু আন্তর্জাতিকতার বিচারে এটি ৬টি দেশের নদী। এই দেশগুলো হলো— চীন, মায়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েৎনাম। দৈর্ঘ্যের বিচারে পৃথিবীর ১২তম এবং এশিয়ার ৭ম দীর্ঘ নদী। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,৩৪০ কিলোমিটার।
ইয়ালোং
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশের একটি দীর্ঘ নদী। এর মোট দৈর্ঘ্য ৮২২ মাইল (১,৩২৩ কিলোমিটার)। চীনের উত্তর-পূর্ব কিংঘাই অঞ্চলের তিব্বত-কিংঘাই অঞ্চলের উচ্চ মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সিচুয়ান প্রদেশে চ্যাং জিয়াং (ইয়াংজি) নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।
হোয়াংহো নদীর নামকরণ
হোয়াংহো নদী উত্তর চীনের সর্বপ্রধান নদী, ৫৪৬৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট হোয়াংহো চীনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী (চ্যাং জিয়াং তথা ইয়াং ৎসি চিয়াং নদীর পরেই) ও বিশ্বের ৬ষ্ঠ দীর্ঘতম নদী। চীনা ভাষায় হোয়াংহো কথাটির অর্থ ‘পীত (হলুদ) নদী’। নদীটির পানি কর্দমাক্ত হলুদাভ বলে এই নাম দেওয়া হয়েছে।
কেন চীনের দুঃখ
হোয়াংহো নদীকে ‘চীনের দুঃখ’ বলা হতো। প্রাচীন চীনে প্রায়ই হোয়াংহো নদী ছাপিয়ে উঠে সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিত বলে এই নদীর নাম ছিল ‘চীনের দুঃখ’। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ছাব্বিশবার এই নদীর গতিপথ বদল হয়েছে। এর ফলে প্রত্যেকবারই চীনের জনগণের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুঃখদুদর্শা।
দুঃখের ঘটনা
হলুদ নদী বিশ্বের ষষ্ঠ-দীর্ঘতম নদী এবং এটি সবচেয়ে বেশি পলি মাটি বহন করে। হোয়াংহো নামেও পরিচিত, এটি কিংহাই প্রদেশে উদ্ভূত হয়েছে, লোস মালভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যেখানে পলি মাটি বহন করে যা এর জলকে তাদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত হলুদ রঙে রূপ দেয়। তারপর এটি হলুদ সাগরের একটি অংশ বোহাই সাগরের আগে সমতল উত্তর চীন সমভূমি জুড়ে প্রবাহিত হয়।
এই নদীর আছে অনেক দুঃখের গল্প যার জন্যই একে ডাকা হয় দুঃখের নদী। এই দুঃখের নদীর কিছুর দুঃখের ঘটনা হল-
১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালীন দুর্যোগ
১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালীন দুর্যোগের পরে, গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি সবসময়ই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে, হাজার হাজার গ্রামের মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৯৩৮ সালের হোয়াংহো নদীর বন্যা এবং তৎকালীন যুদ্ধ ছিল এক ভয়াবহ অবস্থা। জাপানিরা যখন পশ্চিম এবং দক্ষিণ চীন আক্রমণ করছিল, তখন তাদের আরও চলাচল বন্ধ করার জন্য নদীর বাঁধগুলি খুলে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে গ্রাম এবং ৮ মিলিয়ন মানুষ ধ্বংস হয়েছিল।
১৮৮৭ সালে বন্যা বিপর্যয়
আরেকটি বন্যা বিপর্যয় ছিল ১৮৮৭ সালে। এটি ছিল চীনের ইতিহাসে প্রথম প্রাকৃতিক বন্যা বিপর্যয় যাতে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়।
দুঃখের নদীতে ফসলের ক্ষতি
বন্যা বিপর্যয় এবং ক্রমাগত মাটি ক্ষয়ের ফলে কৃষি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফসল এবং বিভিন্ন কৃষি জমির ক্ষতির জন্য প্রতি বছর হোয়াংহো নদী দায়ী। সেচের জন্য নদী ব্যবহার করা সত্ত্বেও বন্যায় ক্ষতি হয়েছে। প্রতি বছর ফসল বৃদ্ধি না হওয়ার জন্য এই নদীর পলি মাটিও দায়ী।
নদী নিয়ন্ত্রণের নিরর্থক প্রচেষ্টা
হলুদ নদী সমস্যার সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা বৃথা হয়েছে বরাবরই। সর্বশেষ প্রচেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা করা হয়েছিল যেটি ছিল আধুনিক প্রকৌশল ব্যবহার করে সানমেনক্সিয়াতে একটি বাঁধ নির্মাণের করেছিল। তবে, হলুদ নদীতে পলি জমার তীব্রতা সম্পর্কে প্রকৌশলীদের জ্ঞানের অভাবের কারণে, প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছিল।
হোয়াংহো নদীর অববাহিকার পশুচারণ ভূমি বেশ উর্বর ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। এই নদীর অববাহিকাতে চীনের প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই নদীর অববাহিকা চীনের সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভূমি। আর তাই চীনের মানুষ এখন আর হোয়াংহো নদীকে দুঃখের কারণ না বলে চীনা সভ্যতার সূত্রকার হিসেবে চিন্তা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।
Feature Image: youngisthan.in References: 01. The Yellow River has been known as ‘China’s sorrow’ 02. Which River Is Called "China's Sorrow" And Why? 03. Huang He Valley 04. Why Yellow River Is known as the “River Of Sorrows”?