সম্রাট বাবরের পর ভারতে মুঘল বংশের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে মসনদে বসেছিলেন হুমায়ূন। ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মার্চ হুমায়ূনের জন্ম। হুমায়ূন শব্দের অর্থ সৌভাগ্য। বাবর তার পুত্রকে সৌভাগ্যের সূচনা হিসেবে দেখেছিলেন। তাই পুত্রের নাম রেখেছিলেন সৌভাগ্যবান। বাবর নিজেকে নিয়তির দ্বারা চালিত বলে মনে করতেন। ছোট বেলায় হুমায়ূন অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবর আল্লাহর কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে হুমায়ূনের জীবন কামনা করলে হুমায়ূন সুস্থ হন এবং বাবর মারা যান। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যিই ঘটোনা।
জ্যোতিষ বিশ্বাসী হুমায়ূন
অনেক সম্রাটই নানা রকম অদ্ভুত বিশ্বাস রাখতেন। বাবর এবং হুমায়ূনেরও সেরকম অনেক বিশ্বাস ছিল। বিশেষ করে হুমায়ূনের ক্ষেত্রে বলা হয়, তিনি জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন। অতি কৌতূহলী হুমায়ূন সম্রাট সত্যি সত্যি জ্যোতিষ বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। জ্যোতিষ চর্চার জন্য নক্ষত্রের গতিবিধির নকশা তিনি পড়াশুনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আকাশের তারার মাঝে সব প্রশ্নের উত্তর আছে। ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে তারা। হুমায়ূন ছিলেন খেয়ালী এবং বেশ কৌতূহলী। হিন্দুস্তানের সংস্কৃতি তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলেছিল। সেই সঙ্গে দরবারের অমাত্যরা তার কৌতূহলের সুযোগ নিয়ে তাকে আরও প্রভাবিত করেছিল।
জ্যোতিষ বিদ্যায় আগ্রহী হুমায়ূন একসময় ভাবতে শুরু করেন যে, একমাত্র নক্ষত্রগুলোই তাকে সাহায্য করতে পারে। তাই তিনি দরবারে এক নতুন নিয়ম চালু করলেন। গ্রহ-নক্ষত্র আঁকা কার্পেট স্থাপন করলেন দরবারে। নিয়ম হলো যে দিন যেই গ্রহের সাথে সম্পর্কিত সেইদিন সেই অনুসারে কাজ পরিচালিত হবে। যেমন: তিনি নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট গ্রহ অনুসারে পোশাক পরতেন এবং জ্যোতিষ বার্তা অনুসারে কাজ করতেন।
মাদকাশক্তি এবং সেখান থেকে মুক্তি
বাবরের মৃত্যুর আগেই হুমায়ূন দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বাবার সাথে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন। সেইসব যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তবে হুমায়ূনের আগ্রহ ছিল জ্ঞান অর্জনে। বাবরের ডাইয়েরি পড়তে খুব ভালবাসতেন হুমায়ূন। অবসর সময়ে ভাবনা চিন্তা করে কাটাতেন। এতে শাসন কাজ থমকে গিয়েছিল। ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ভাবালু সম্রাটকে ভুল পথে চালিত করছিল অনেকেই। তাঁর হাতে মদ তুলে দিয়েছিল তার কাছের মানুষেরা। হুমায়ূনও মদ খেতে থাকতেন এবং গল্প গুজবে সময় কাটাতেন।
হুমায়ূন ক্রমেই শাসন ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যের প্রধান হিসেবে তার করণীয় দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেন। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার তখন উদ্ভট সব নিয়মে তার দরবার ভরপুর হয়ে ওঠে। এবং এসব কিছু থেকে লাভবান হয় গুটিকয়েক মানুষ। মূলত তিনি সেই সময়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। একটা সময়ে বাবরও প্রচুর সুরা পান করতেন। এক সময় তিনি নেশা থেকে সরে এসে শক্ত হাতে তলোয়ার ধরে ছিলেন। মাদকের প্রভাব মুঘলদের উপর সব সময়েই ছিল। হুমায়ূনও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এই সময় তাঁর ফুফু খানজাদা বেগম তাঁকে বুঝিয়ে মদ পান করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। হুমায়ূন ধীরে ধীরে মাদকাশক্তির আসক্তি কাটিয়ে ওঠেন।
শের শাহ্র সাথে যুদ্ধ
মাদকাসক্ত সম্রাট অনেক চেষ্টার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু শের শাহ্ নামক এক যোদ্ধা তখন প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। সাধারণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি করে এক সময় বাংলা-বিহার অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়ান।
শের শাহ্কে পরাজিত করতে বিশাল বাহিনী নিয়ে হুমায়ূন যাত্রা করেন। নদী তীরে শিবির স্থাপন করে যখন মুঘল বাহিনী ঘুমিয়ে ছিল। তখন বৃষ্টির সুবিধা নিয়ে শের শাহ্র সেনারা মুঘল শিবির আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হুমায়ূনের সাথে আসা মহিলাদের তাঁবু। শের শাহ্ চালাকি করে এই তাঁবু আক্রমণ করে যুদ্ধ শুরুর আগেই হুমায়ূনকে পরাজিত করলেন। তখন হুমায়ূনের সেরা যোদ্ধা বৈরাম খান যুদ্ধ করে শের শাহে্র সেনাদের হাত থেকে মুঘল নারীদের রক্ষা করেছিলেন। তারপর একটি দ্রুতগামী নৌকায় আগ্রা পাঠিয়ে দেওয়া হয় নারী সকলকে।
কিন্তু শের শাহে্র হাত থেকে হুমায়ূন বাঁচতে পারেনি। ১৫৩৯ সালে আবার যুদ্ধ হয়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে হাজির হওয়া শের শাহ্ সুযোগ নিয়ে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূনকে নাস্তানাবুদ করেন। আহত হুমায়ূনকে লড়াইয়ের মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে এক কিশোর। সে হুমায়ূনের শিবিরে ভিস্তিওয়ালার কাজ করত। ছাগলের চামড়ার মশক ফুলিয়ে আহত হুমায়ূনকে নদী পার করে তার অমাত্যদের কাছে পৌঁছে দেয় সে। এই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে হুমায়ূন তাকে এক দিনের সম্রাট করার প্রতিশ্রুতি দেন।
হুমায়ূন ইরানে
শের শাহে্র কাছে পরাজিত হয়ে হুমায়ূন তাঁর দলবল নিয়ে ইরানের দিকে গিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইরানের শাহ্ তাঁকে সাহায্য করবেন। এর মধ্যে পথ চলতি সময়ে তাঁর ছেলে আকবরের জন্ম হয়। ছেলেকে তাঁর ভাই কামরান পরে অপহরন করেছিলেন। আকবরকে রেখেই তাই হুমায়ূন ইরানে গিয়ে শাহ্ এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন।
ইরানের শাহ্ হুমায়ূনের সব কথা শুনে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। হুমায়ূনকে তিনি যথেষ্ট টাকা পয়সা দেন। সেই সাথে দিয়েছিলেন অনেক সৈন্য যা দিয়ে হুমায়ূন শের শাহকে পরাজিত করতে পারে। কিন্তু এই সাহায্যের জন্য ইরানের শিয়া শাহ্ হুমায়ূনকে শিয়া মতের প্রতি সমর্থন দিতে প্রভাবিত করেছিলেন।
ভাইদের ষড়যন্ত্র
হুমায়ূনের বাবা বাবর তাঁকে বলেছিলেন হুমায়ূন যেন ভাইদের সাথে কখনো কঠোর না হয়। হুমায়ূন সারা জীবন সেই কথা মেনে চলেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা বারবার তাঁর সাথে প্রতারনা করেছে। হুমায়ূনকে ধোঁকা দিয়েছে। এদের মধ্যে কামরান সবচেয়ে বেশি উগ্র ছিল। বাবরের এই সন্তান হুমায়ূনের চেয়ে যোগ্য ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। কামরান নিজে সিংহাসনের প্রতি লোভী ছিল এবং সে বারবার ষড়যন্ত্র করেছে। শের শাহের কাছে হুমায়ূনকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও সে দিয়েছিল।
এছাড়া আকবরের জন্মের পর এক সময় হুমায়ূনের আরেক ভাই আসকারী তাঁকে অপহরন করে বন্দী করেছিল। অপহরণ করার পর অবশ্য কামরানের কাছেই রাখা হয়েছিল। তৃতীয় ভাই হিন্দাল প্রথমে হুমায়ূনের বিরোধী থাকলেও পরে হুমায়ূনের সাথেই যোগ দিয়েছিলেন। হিন্দাল নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। অবশ্য অনেকে মনে করে হুমায়ূনের স্ত্রী হামিদা আসলে হিন্দালের প্রেমিকা ছিল। সেই কারণে হিন্দাল হুমায়ূনের পক্ষে গিয়েছিলেন।
যাই হোক, বারবার এই ষড়যন্ত্র করার কারণে হুমায়ূন তাঁর ভাইদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু বাবরের আদেশের কারণে তিনি কঠোর হননি। ইরানের শাহের সাহায্য নিয়ে হিন্দুস্তানে ফেরার পর হুমায়ূন কামরান এবং আসকারিকে কয়েদ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কাউকে মৃত্যু দেননি। তবে কামরানকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন।
রাজ্য পুনরায় উদ্ধার
ইরান থেকে সৈন্য এবং অর্থ সাহায্য এনে হুমায়ূন আবার দিল্লীতে নিজের অধিকার ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি শের শাহ্কে পরাজিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ততদিনে শের শাহ্ নিজেই একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন হুমায়ূন সহজেই দিল্লি জয় করে নেন। অবশ্য এই সময়ও তাঁর ভাই কামরান নানা রকম ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছিলেন।
হুমায়ূন প্রথমে দিল্লি জয় করেছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে অন্য সব অঞ্চলে ক্ষমতা প্রচার করেছিলেন। এই সময়ে বৈরাম খান তাঁকে অনেক সাহায্য করেন। বৈরাম খানের সেনাপতি হওয়ার কারণে তাঁর সাহসে আর যুদ্ধে অনেক কিছুই হুমায়ূনের জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কামরানের কাছ থেকে আকবরকেও উদ্ধার করতে সফল হন হুমায়ূন। কিন্তু ইরানে যাওয়া এবং ফেরত আসার সময়ের মধ্যে অনেক কাছের মানুষকে তিনি হারিয়েছেন। এর মধ্যে একজন হলেন তাঁর ফুফু খানজাদা। অন্যজন ছোট ভাই হিন্দাল। একজন মরুঝড়ে মারা যান। অন্যজন আততায়ীর হাতে মারা যান। কিন্তু রাজ্য উদ্ধার করেও বেশিদিন তা ভোগ করতে পারেননি হুমায়ূন। ১৫৫৬ সালে তিনি লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান।
কেমন ছিলেন হুমায়ূন
সম্রাট হুমায়ূনকে অনেকেই ভবঘুরে, মাতাল ইত্যাদি বলে থাকেন। কিন্তু আসলে তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। সম্রাট হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতেন। এক সময় মাদকাসক্ত হলেও পরে তিনি সেসব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি সুশাসক হয়েছিলেন। আর তিনি ভালো যুদ্ধ করতেন তা বাবরের সময়েই প্রমাণ হয়েছিল। সবচেয়ে বড় গুন ছিল তিনি কথা দিয়ে কথা রাখতেন। যে ছেলেটি ভিশতি দিয়ে হুমায়ূনের জীবন রক্ষা করেছিল, হুমায়ূন কথা দিয়েছিলেন তাঁকে এক দিনের জন্য সিংহাসনে বসাবেন। ছেলেটি যখন সম্রাটের কাছে সেই দাবী নিয়ে হাজির হয়েছিল, হুমায়ূন সেই দাবী পূরণ করেছিলেন।
কামরানকে তিনি অন্ধ করেছিলেন বলে লোকে তাঁকে সমালোচনা করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কামরানের অনেক ষড়যন্ত্র তিনি সহ্য করেছিলেন। শেষে তাঁকে হত্যাও করেননি, অন্ধ করেছিলেন। আসকারিকে তিনি মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাকেও কোন গুরুতর শাস্তি দেননি। তিনি হিন্দালের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন বলে অনেকে তাঁর সমালোচনা করে। কিন্তু দেখা যায় হামিদা বানুকে তিনি ভালোবাসতেন। হুমায়ূনের চরিত্রে দোষ ছিল না।
হুমায়ূন পড়াশোনা করতে পছন্দ করতেন। তাঁর শিবিরে সব সময় অনেক বই থাকত। তিনি অবসর পেলেই সেইসব বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন। জ্যোতিষের সাতে সাথে দর্শন, বিজ্ঞান, ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা তিনি মন থেকে একজন সহজ সরল মানুষ ছিলেন। এই কারণে অনেকে তাঁকে ভুল বুঝলেও আসলে তিনি মুঘল আমলের একজন মহান সম্রাট ছিলেন।
Feature Image: newsnation.com
তথ্যসূত্র:
০১. হুমায়ূননামা: গুলবদন বেগম। প্রকাশনী: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র।
০২. মোগল সম্রাট হুমায়ূন: হরিশঙ্কর শ্রীবাস্তব। প্রকাশনী: ঐতিহ্য।
০৩. Humayun, Mughal Emperor of India.