ঋতু বদলের পালা শেষে কড়া নাড়তে নাড়তে অবশেষে দোরগোড়ায় হাজির হয়েই গেল শীতকাল। বিরূপ রুক্ষ শুষ্ক প্রকৃতি, নিষ্প্রাণ চারিদিক, এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। কিন্তু শীত ঋতুর সাথে আরো জড়িয়ে আছে বিভিন্ন পিঠা পুলি, নতুন গুড়ের পায়েস এ যেন তার নিষ্প্রাণ প্রকৃতির সাথে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।
তবে শীতকাল যেন একইসাথে আনন্দ এবং বেদনার ঋতু। এই শীতে যেমন বাতাসে উৎসবের আমেজ থাকে তেমনই থাকে ঠান্ডায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়।
এই ঋতুতে প্রায় সব রোগই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের কারণে। শীতকালে প্রচলিত আর্দ্রতার মাত্রা কমে যাওয়া আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার একটা অন্যতম কারণ।
শীতের এই উত্তেজনাপূর্ণ দিকটি উপভোগ করার জন্য আপনাকে সুস্থ এবং ফিট থাকতে হবে। আজকের আয়োজন সাজানো হয়েছে শীতে সুস্থ থাকার ১২টি সেরা উপায় নিয়ে। তাহলে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য বা সুষম খাদ্য খান
গোটা শস্য, চর্বিহীন মাংস, মাছ, মুরগি, লেবু, বাদাম এবং বীজ, ভেষজ এবং মশলাসহ প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল এবং শাকসবজিসহ একটি সুষম খাদ্য খাওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। কারণ এটি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে এবং আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্ন নিন
ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক শীতের অন্যতম বিপদ। ঠাণ্ডা আবহাওয়া ত্বকের ক্ষতি করে যার ফলে ত্বক শুষ্ক এবং চুলকানি, ফাটা ঠোঁট এবং ফাটা গোড়ালির মতো বিড়ম্বনা দেখা দেয়। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা এবং একটি ভালো ময়েশ্চারাইজার-এর ব্যবহার আপনাকে এই সমস্যাটি মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে।
চমৎকার ফলাফলের জন্য ময়েশ্চারাইজার ক্রিম এবং কোল্ড ক্রিম নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত। শীতকালে নিয়মিত ত্বকের যত্ন আপনার ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত হাইড্রেশন, শীতকালীন ক্রিম এবং ময়েশ্চারাইজিং আবশ্যক করে নিন এবং হাড়কাঁপানো শীতেও ধরে রাখুন ত্বকের ঔজ্জ্বল্য।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
শীতকালে সাধারণত পানি কম খাওয়া হয় যার জন্য হজমসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান করুন এবং হাইড্রেটেড থাকুন। পানি আমাদের সিস্টেম পরিষ্কার করতে এবং টক্সিন অপসারণ করতে, শরীরের কোষগুলিতে পুষ্টি বহন করতে এবং শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
নিয়মিত আপনার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
শীতকালীন সতর্কতার মধ্যে রয়েছে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থার উপর নজর রাখা। যেহেতু ঠাণ্ডা আবহাওয়া হাঁপানি, ফ্লু, গলা ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় তাই এগুলোর দিকে বিশেষ নজর রাখা উচিত। কম তাপমাত্রা রক্তচাপ বাড়ায় এবং হার্টে আরও চাপ সৃষ্টি করে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলো শীতের রোগ থেকে বাঁচার এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও সুস্বাস্থ্য উপভোগ করার সর্বোত্তম উপায়।
প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন
শীতে সুস্থ থাকার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ করা। আমাদের শরীরের ভিটামিন ডি প্রয়োজন-যা স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এমনকি এটি মেজাজ নিয়ন্ত্রণের জন্যও অপরিহার্য।
শীতের উপযোগী পোশাক পরুন
যেহেতু বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা বাইরে যাওয়ার সময় আপনাকে উষ্ণ রাখার জন্য ভারী পোশাক পরুন। উলের পোশাক হতে পারে আপনার অন্যতম পছন্দ।
প্রচুর প্রোটিন খান
নিজেকে সুস্থ রাখতে প্রোটিন একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার সারাদিন আপনার শক্তির মাত্রা বাড়াতে পারে। প্রোটিন টিস্যু, হাড় গঠনে সাহায্য করে এবং শরীরের বিপাক ক্রিয়াও বাড়ায়। প্রচুর পরিমাণে মাংস, মুরগির খাবার, দুগ্ধজাত পণ্য, বাদাম এবং বীজ আপনাকে শীতকালে প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে এবং আপনাকে উষ্ণ রাখতে পারে।
ডায়েটে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন
ওমেগা-৩ হলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিড যা বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া যায়, বিশেষ করে মাছ এবং গাছপালাগুলিতে। এই স্বাস্থ্যকর চর্বি চোখের স্বাস্থ্য, ত্বকের স্বাস্থ্যে অবদান রাখে এবং একটি প্রদাহ বিরোধী হিসাবে কাজ করে। এটি শীতকালে জয়েন্টের ব্যথা এবং জয়েন্টের শক্ততা কমায়। এগুলি শীতকালে আপনার ত্বকে কোমলতা প্রদান করে। তাই শীতকালে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখুন প্রচুর পরিমাণে মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ।
খাবার তালিকায় রাখুন প্রচুর ফল এবং সবজি
ফল এবং শাকসবজি বিভিন্ন ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ এবং ফাইবার সমৃদ্ধ। এগুলো আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। পালং শাক, কমলা, গাজর ইত্যাদি সবই সুস্বাদু খাবার যা আপনি শীতকালে উপভোগ করতে পারেন। শীতকালে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের মতো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী খাবার বেশি বেশি খাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
শীতের দিনে অনেকেই অলস বোধ করেন। কিন্তু শীতকালে নিয়মিত ব্যায়াম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনাকে উষ্ণ থাকতে সাহায্য করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মৌসুমী ফ্লু এবং সর্দি-কাশির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
আপনি যা করতে উপভোগ করেন তাই আপনার ব্যায়াম হিসেবে বানিয়ে নিন। আপনি একটি ফিটনেস ক্লাসে যোগ দিতে পারেন, ওজন তুলতে পারেন বা একটি সাধারণ নাচ যা কিছু ক্যালোরি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম
পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল দূর করে এবং ক্যালরি পোড়ায়। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম শরীরকে ঠান্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে এবং শীতকালে সারাদিন উদ্যমী থাকে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্বাস্থ্যকর পোড়া, ক্যালোরি এবং স্ট্রেস হরমোন দূর করতে সাহায্য করে। তাই চেষ্টা করবেন কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর।
সময়মতো আপনার ফ্লু শট নিন
শীতের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সময়মতো ফ্লু ভ্যাক্সিন নিন। শীতের আগে ফ্লু শট নেওয়া আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। এটি নেওয়ার আদর্শ সময় হলো শীতের শুরুর ঠিক আগে। আপনি আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে এই টিকাটি নিয়ে নিতে পারেন।
Feature Image: heartfoundation.org References: 01. https://www.indushealthplus.com/best-ways-to-stay-healthy-in-winter.html. 02. https://pharmeasy.in/blog/10-best-ideas-to-stay-healthy-and-fit-during-winter/. 03. https://www.heartfoundation.org.au/blog/7-tips-for-staying-healthy-over-winter.