জুলিয়াস সিজার, যাকে আমরা চিনি একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, সেনাপতি ও জনপ্রিয় রোমান সম্রাট হিসেবে। রোম প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও রোম সাম্রাজ্যের বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া, লাতিন ভাষায় রচিত তার লেখা গদ্যসাহিত্যও তাকে বিশেষ খ্যাতি দিয়েছে। তাকে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বলে বিবেচনা করা হয়।
সিজার রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান এবং রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সূচনা করেছিলেন। তবে তিনি সম্রাট হিসেবে একজন স্বৈরশাসক ছিলেন এবং সামরিক বাহিনী ও রোমের নিম্ন শ্রেণীর কাছে জনপ্রিয় ছিলেন না। জুলিয়াস সিজারের জীবনের নানা দিক নিয়েই আজকের আলোচনা। একজন সাধারণ রোমান সেনানায়ক যখন রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে উঠেছিল এবং তার শেষ পরিণতি কী ছিল সেসব বিষয় নিয়েই আজকের আর্টিকেলটি সাজানো।
জন্ম ও পরিচয়
জুলিয়াস সিজার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২ জুলাই ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। প্রাচীন রোমের সুবুর শহরের এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম তার। ইতিহাসবিদ গোল্ডসওয়ার্দি লিখেছেন সিজারের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন প্যাট্রিশিয়ান, যার অর্থ ছিল রোমের প্রাচীনতম অভিজাত শ্রেণীর সদস্য, যারা প্রারম্ভিক প্রজাতন্ত্রে একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী ছিল, অনেক বেশি সংখ্যক প্লেবিয়ানদের উপর শাসন করতো। যদিও সিজারের জন্মের সময় তার পরিবার বিশেষভাবে শক্তিশালী ছিল না; তবে তার পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ রোমান প্রজাতন্ত্রে সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তার পিতা গাইয়ুস জুলিয়াস সিজার ছিলেন একজন রোমান সিনেটর; যিনি এশিয়া প্রদেশ শাসন করতেন। আর মায়ের নাম ছিল অরেলিয়া কোট্টা, যিনি তখনকার সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ছোট বেলায়ই তিনি গৃহশিক্ষক এন্টোনিওর কাছে রোমান আইন বিষয়ে ধারণা পান। তার বাবা যখন মারা যায় তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। এরপরে পরিবারের হাল ধরেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিয়ে করেন তার ফুপা মারিয়াসের মিত্র এক ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদের মেয়েকে। যার নাম ছিল কর্নেলিয়া। সিজার এবং কর্নেলিয়ার একটি ছেলে ছিল, জুলিয়া নামে একটি মেয়েও ছিল।
সেনানায়ক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার গল্প
সিজারের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা
জুলিয়াস সিজার একজন পুরোহিত বা ধর্মযাজক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। জুলিয়াস সিজার যখন কর্নেলিয়াকে বিয়ে করেন তখন রোমের শাসক ছিলেন সুলা। এসময় তার ফুপা মারিয়াস এবং রোমান শাসক সুলার মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাছাড়া, সুলার সঙ্গে সিজারের পরিবারের ভীষণ শত্রুতা ছিল। যখন রোমান শাসক সুলা নিজেকে স্বৈরশাসক ঘোষণা করেন, তখন তিনি তার শত্রুদের এবং বিশেষ করে যারা জনপ্রিয় মতাদর্শে ধারণ করেন তাদের দল থেকে বিতাড়িত করা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় সিজারকেও শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
পরবর্তীতে সুলা গৃহযুদ্ধ জিতেছিলেন এবং সিজারকে কর্নেলিয়ার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের আদেশ দেন। তাকে পুরোহিতের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তার স্ত্রীর যৌতুক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সে এসব করতে রাজি হননি। তাই রোম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে তিনি সুলার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন কিন্তু ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যান আবারো।
যেহেতু তার মায়ের পরিবার ছিল প্রভাবশালী তাই তার মায়ের পরিবারের মধ্যস্থতার মাধ্যমে তার শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তবে শাসক সুলার প্রভাব থেকে দূরে থাকতে তরুণ বয়সেই সিজার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং রোম ছেড়ে চলে যান। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি নিজেকে একজন কার্যকরী সৈনিক হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন, এমনকি যুদ্ধে জীবন বাঁচানোর জন্য সিভিক ক্রাউন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। জাহাজের একটি বহর সুরক্ষিত করার জন্য বিথিনিয়াতে সিজারকে সামরিক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুলা মারা যাওয়ার পর সিজার রোমে ফিরে আসতে সক্ষম হন। এরপর তিনি আধুনিক তুরস্কের কাছে একটি দ্বীপ রোডসে আইন অধ্যয়নের জন্য চলে যান। তার যাত্রার এক পর্যায়ে তিনি জলদস্যুদের দ্বারা বন্দী হয়েছিলেন। যখন জলদস্যুরা তার মুক্তিপণের জন্য ২০ ট্যালেন্ট (ঐ সময়ের রৌপ্য মুদ্রা) মুক্তিপণ দাবি করেছিল, তখন সিজার তাদেরকে উপহাস করে বলেছিলেন তার জন্য অন্তত ৫০ ট্যালেন্ট মুক্তিপণ চাওয়া উচিত। পরে সিজার জলদস্যুর হাত থেকে মুক্তি পান কিন্তু তাদেরকেও শাস্তি হিসেবে গর্দান নিয়ে নেন।
কনসাল ও জেনারেল নির্বাচিত
৭৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে ফিরে আসার পর সিজারের রাজনৈতিক কর্মজীবন ধীরে ধীরে বড় হয় এবং তিনি তার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার পরিবারের সম্পদ এবং দক্ষতা ব্যবহার করেন। এরপর সিজার সামরিক ট্রাইবিউন নির্বাচিত হোন। যেহেতু সিজার ছিলেন একজন বাগ্মী। তাই তিনি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিকে রাজনৈতিক লাভে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যখন তার প্রথম স্ত্রী কর্নেলিয়া ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান, তখন সিজার পুরনো ঐতিহ্য ভেঙে তার ব্যক্তিগত সমর্থন বাড়াতে কর্নেলিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় একটি বক্তৃতা দেন যা জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এরপরে জুলিয়াস সিজার সম্রাট সুলার ধনী অপ্টিম নাতনি পম্পেইকে বিয়ে করেন। রোমে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে সিজার জেনারেল বা সেনানায়ক পদের জন্য পম্পেই দ্য গ্রেটের কার্যকর সমর্থন আদায় করেন। এই সময়ে তিনি রোমের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রাসাসের সাথেও বন্ধুত্ব করেন। মনে করা হয় ক্রাসাস প্রধান যাজক (পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস) পদে নির্বাচনের জন্য সিজারকে আর্থিক সহায়তা করেছিল যে কারণে তিনি ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জিতেছিলেন।
৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি প্রেটার নির্বাচিত হোন। এই সময় স্ত্রী পম্পেইকে একটি কেলেঙ্কারিতে অন্য একজনের সাথে জড়িত হওয়ায় তাকে তালাক দেন। ৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়ার প্রোপ্রেটর (গভর্নর) হিসাবে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সিজার ৬১ থেকে ৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত আইবেরিয়ার অংশ নিয়ন্ত্রণকারী রোমান গভর্নর হিসাবে নির্বাচিত হন, যেখানে তিনি একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যারা রোমান শাসনের বিরোধিতাকারী উপজাতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
সিজারের গভর্নরশিপ ছিল একটি সামরিক সাফল্য এবং তিনি রোমান শাসনকে প্রসারিত করতে সক্ষম হোন। এরপর সিনেটদের সিদ্ধান্তে ৪০ বছর বয়সে জুলিয়াস সিজার কনসাল নির্বাচিত হোন। কনসাল ছিল রোমান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদমর্যাদা যা একজন রাষ্ট্রপতির সমানই ছিল বলা চলে।
ট্রায়ামব্রাট বা জোট গঠন
জুলিয়াস সিজারের মতো রোমান সেনানায়ক যখন রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তখন তাকে আরও সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। রোমের উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সিজার জোটের মাধ্যমে আরও রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে সেরা দুটি জোট খুঁজে পেয়েছিলেন যা তাকে সাফল্যের পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।
তিনি প্রথমে রোমান জেনারেল পম্পেইর সাথে এবং এরপর শক্তিশালী রোমান রাজনীতিবিদ ক্রাসাসের সাথে জোটবদ্ধ হোন। তাছাড়া, পম্পেইর সাথে সিজারের একমাত্র মেয়ে জুলিয়ার বিবাহের মাধ্যমে পম্পেইর সাথে সিজারের মিত্রতা আরও শক্তিশালী হয়েছিল। এই জোটটি সিজারের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছিল কারণ তিনি পম্পেইর কাছ থেকে সম্পদ এবং সামরিক শক্তি পেয়েছিলেন। এই জোট ট্রায়ামব্রাট নামে পরিচিত।
ট্রায়ামব্রাট প্রতিষ্ঠার পরপর কনসাল হিসাবে তার মেয়াদের শেষের দিকে, সিজার গল প্রদেশের গভর্নর হোন। যা ছিল উত্তর ইতালি ও আধুনিক ফ্রান্সের একটি অঞ্চল। সেখানে থাকাকালীন তিনি রোমান সেনাবাহিনীর চারটি দলকে ব্যবহার করেন রোমান প্রজাতন্ত্র জয় করতে। আসলে সিজার এবং তার সেনাবাহিনী আধুনিক ফ্রান্স, জার্মানি এবং বেলজিয়াম জুড়ে উপজাতিদের পরাজিত করেছিল।
সিজার একজন অত্যন্ত কার্যকরী গভর্নর এবং জেনারেল ছিলেন। তিনি সমস্ত গল জয় করেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সম্মান অর্জন করেছিলেন এবং পম্পেইর পাশাপাশি শীঘ্রই রোমান সেনাবাহিনীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেনানায়ক বা জেনারেল হিসাবে বিবেচিত হন।
গৃহযুদ্ধ ও পম্পেইর পতন
এরপর আরও অঞ্চল জয় করার জন্য সিজার ব্রিটেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ঐ সময় তার মেয়ে জুলিয়া মারা যায়। এর ফলে প্রথম জোট বা ট্রায়ামব্রাট দুর্বল হয়ে পড়ে। ৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্রাসাসের মৃত্যু এবং পম্পেইর সাথে সিজারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কন্যার পুনরায় বিয়ে হওয়ায় এই ট্রায়ামব্রাট আরও দুর্বল হয়ে পড়ে ও সমাপ্তি ঘটে। রোমে বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও সিজার গলেই ছিলেন এবং গ্যালিক উপজাতিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কয়েকটি যুদ্ধে হারলেও শেষ যুদ্ধে গ্যালিক উপজাতিদের পরাজিত করেন তিনি। এরপর রোম এবং পম্পেইতে তার মনোযোগ দেন।
সিজার গলে থাকাকালীন, পম্পেই কার্যকরভাবে রোমান সিনেটের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। জুলিয়াস সিজারকে রোমে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়ার জন্য পম্পেই ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, কনসাল হিসাবে সিজারের মেয়াদ শেষ হয়েছিল।
সিজার পম্পেইর অভিপ্রায়ে সন্দিহান ছিলেন, কারণ পম্পেই সিজারকে ফিরে আসার আগে গলে তার সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পম্পেই রোমান সিনেটে আনুষ্ঠানিকভাবে সিজারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনেন। যার ফলশ্রুতিতে রোমান প্রজাতন্ত্রে ক্ষমতার জন্য একটি নতুন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার পম্পেইর চ্যালেঞ্জে সাড়া দিয়ে তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে ইতালির উত্তর সীমান্তে রুবিকন নদী অতিক্রম করে রোমে চলে যায়। এরপর পম্পেইর বিরুদ্ধে আক্রমণ করে এই গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রী বাহিনীকে পরাজিত করেন সিজার। পম্পেই মিশরের কিশোর ফারাও ত্রয়োদশ টলেমি-এর সমর্থন পাওয়ার আশায় মিশরে পালিয়ে যান।
ক্লিওপেট্রা ও মিশর
সিজার পম্পেইর খোঁজে মিশরে যান। সেখানে মিশরীয় রানী ক্লিওপেট্রার সাথে সিজারের পরিচয় হয়। ত্রয়োদশ টলেমির ক্লিওপেট্রা সপ্তমের সাথে সহ-শাসন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তাকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেন এবং পরিবর্তে ক্লিওপেট্রা নির্বাসনে থাকাকালীন তিনি একাই শাসন করেন।
টলেমি পম্পেইকে সাহায্য করার পরিবর্তে হত্যা করে এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে সিজারের কাছে তার মাথা পেশ করে। টলেমি আশা করেছিলেন যে সিজার তার শত্রুকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে, কিন্তু সিজার খুশি ছিলেন না। ক্লিওপেট্রাকে মিশরের সহ-শাসক হিসাবে তার অবস্থান গ্রহণ করার আদেশ দিয়ে সিজার প্রায় এক বছর মিশরে অবস্থান করেছিলেন। জবাবে টলেমি সিজার এবং ক্লিওপেট্রার সাথে লড়াই করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিহত হন।
এই সময় ক্লিওপেট্রা এবং সিজার কাছাকাছি আসেন। ফলস্বরূপ তিনি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। শিশুটি সত্যিই সিজারের ছিল কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে এবং সিজার কখনই শিশুটিকে নিজের বলে স্বীকার করেননি।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠা
পম্পেইর মৃত্যুর পর ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার রোমে ফিরে আসেন সিনেটের সমর্থনে হয়ে যান রোমান প্রজাতন্ত্রের একমাত্র শাসক। একজন রোমান সেনানায়ক যখন রাষ্ট্রপ্রধান হলেন সেই সাথে তিনি পেলেন বিশ্বের সবেচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তকমা। রাষ্ট্রনায়ক হলেও সিজার কখনই নিজেকে রাজা বা সম্রাট উপাধি দেননি। এত ক্ষমতাধর হলেও কিন্তু তার যুদ্ধ শেষ হয়নি, পম্পেই মারা গেলেও তার কিছু অনুগত বাহিনী ছিল এবং কিছু রোমান সিনেটর সিজারের শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল।
সিজার উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেনে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল যুদ্ধ করেছিলেন। কৃষ্ণ সাগরের একটি রাজ্য পন্টাসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ হয়েছিল, যা পম্পেই কয়েক দশক আগে পরাজিত করেছিল। কিন্তু সিজার যতই বিজয়ী হোক না কেন, রোমে তখনও এমন অনেকেই ছিলেন যারা সিজারের বিরোধিতা করেছিলেন। যা তার জন্য পরবর্তীতে ক্ষতির কারণ হয়ে হয়ে দাঁড়ায়। সিজার তার শাসনামলে দমনমূলক ছিলেন না এবং তিনি অনেক প্রাক্তন শত্রুকে ক্ষমা করেছিলেন।
সিজারের কৃতিত্ব
নিজ হাতে শাসনভার নেয়ার পর সিজার পুরো রোম শহরকে বদলে দেন। তিনি রোমে অসংখ্য বড় বড় অট্টালিকা ও গির্জা নির্মাণ করেন। রোমের নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সুবিধার্থে সিজার বেশ কয়েকটি কঠোর সংস্কার শুরু করে। তিনি দরিদ্রদের মধ্যে আরও ভূমি পুনর্বন্টন, প্রবীণ সৈনিকদের জন্য ভূমি সংস্কার যা অন্যান্য নাগরিকদের স্থানচ্যুত করার প্রয়োজনীয়তা দূর করে, সরকারি ঋণ হ্রাস, সেই সাথে রাজনৈতিক সংস্কারসহ অনেক সংস্কারের সূচনা করেছিলেন।
তিনি একটি পুলিশ বাহিনী তৈরি করেন, কার্থেজের পুনঃনির্মাণের নির্দেশ দেন এবং অন্যান্য অনেক আইনের মধ্যে ট্যাক্স ব্যবস্থা বাতিল করেন। স্বৈরশাসক হিসাবে তার সময়কে সাধারণত রোমের জন্য একটি সমৃদ্ধশীল সময় হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার রোমে একটি নতুন ক্যালেন্ডার পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন, যাকে এখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বলা হয়। যা ছিল বছরে ৩৬৫ দিন এবং প্রতি চার বছরে ফেব্রুয়ারিতে একটি অতিরিক্ত দিন বৈশিষ্ট্যযুক্ত। সিজার এই ক্যালেন্ডার গণনার পদ্ধতি আলেকজান্দ্রিয়াতে শিখেছিলেন যা রোমান ক্যালেন্ডারকে প্রকৃত ঋতুর কাছাকাছি নিয়ে আসে। এজন্য যে মাসে সিজারের জন্ম হয়েছিল সিজারের সম্মানে শেষ পর্যন্ত সেই মাসের নামকরণ করা হয় জুলাই।
সিজারের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু
তবে জুলিয়াস সিজারের এসব সংস্কার সিনেটের কাছে পছন্দনীয় হয়নি। তিনি সিনেটকে বিবেচনা না করেই আইনগুলি পাস করেন। আর সিনেটররা ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি খুব শক্তিশালী হয়ে উঠছেন এবং শীঘ্রই সম্পূর্ণরূপে রাজা হিসাবে শাসন করার জন্য সিনেটকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে পারেন।
৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শুরুতে, জুলিয়াস সিজারকে (ডিক্টেটর পারপেটিউস) একনায়ক উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এই শিরোনামটি রোমান মুদ্রায় প্রদর্শিত হতে শুরু করে এবং তাকে রোমে অন্য সকলের উপরে স্থান দেয়. জনগণের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি তাকে রেক্স (রাজা) হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করে।
কিন্ত সিজারের খ্যাতির কারণে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাসের নেতৃত্বে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বের ১৫ মার্চ, সিজার সিনেটে প্রবেশ করামাত্রই তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা হয়। প্রায় ২৩টি ছুরিকাঘাতের পর অবশেষে না ফেরার দেশে চলে যান এই মহান সম্রাট।
একজন সাধারণ রোমান সেনানায়ক হয়েও জুলিয়াস সিজার হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাকে অনেক মানুষ মানব প্রকৃতির গভীর অন্তর্দৃষ্টিসহ এক মহান নেতা হিসাবেও বিবেচনা করে। তার অনেক বিখ্যাত উক্তির মধ্যে একটি হচ্ছে –
আমি এসেছি, আমি দেখেছি, আমি জয়লাভ করেছি।
Feature Image: brittanica.com References: 01. Caesar’s Army | Weapons and Warfare. 02. Julius Caesar - Play, Quotes & Death - HISTORY. 03. The Roman Empire: in the First Century. The Roman Empire. Emperors. Julius Caesar . 04. Julius Caesar | Biography, Conquests, Facts, & Death.