অজানা কোন কিছু জানতে হলে আমাদের মুখ থেকে অনায়াসেই বের হয়ে পড়ে যে ‘গুগল করো!’ গুগল এমন এক নেট ব্রাউজিং টুলস যাকে সবাই দৈনন্দিন কোন না কোন কাজে ব্যবহার করে থাকেই। এই মেগা টুলস যে সাধারণ একটি রিসার্চ প্রজেক্ট থেকে শুরু হয় তা কি জানেন? হয়তো সেই প্রজেক্ট করার সময়ও এর উদ্ভাবকরা আঁচ করতে পারেননি যে এটি ইন্টারনেট দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি সাইট হবে। যার মোট রেভিনিউ বিশ্বের অনেক দেশের মোট জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যাবে।
আজকে আমরা সেই গুগলের ইতিহাস জানার চেষ্টা করবো, যেই গুগল দিয়ে আমরা বিশ্বের অন্যসব ইতিহাস জেনে থাকি। জানব কিভাবে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুজন ছাত্রের রিসার্চ প্রজেক্ট বিশ্বের অন্যতম টেক জায়ান্টের জন্ম দিল।
গোড়াপত্তন
সালটা ১৯৯৫। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ল্যারি পেইজ এবং সার্জেই ব্রিন নামক দুই তরুণের পরিচয় ঘটে। ল্যারি পেইজ যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান থেকে আগত একজন ছাত্র যার বাবা-মা দুইজনেই কম্পিউটার সায়েন্সের প্রফেসর ছিলেন। অপরদিকে সার্জেই ব্রিন ছোটবেলায় রাশিয়া হতে আমেরিকায় আগত একজন অভিবাসী যার বাবা-মা যথাক্রমে গণিতের প্রফেসর এবং নাসার গবেষক ছিলেন। অভিভাবকদের এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে যেন পেইজ এবং সার্জেই স্ট্যানফোর্ডে ‘ম্যাথমেটিক্স এন্ড কম্পিউটার প্রোগ্রামিং’ এ পিএইচডি করতে আসেন। এভাবেই সূচনা ঘটে এক নতুন অধ্যায়ের, এক নতুন বিপ্লবের।
১৯৯৬ সাল। ইতোমধ্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (WWW) জন্ম হয়ে গেছে। একে নেভিগেট করার জন্য ব্রাউজারও আবিষ্কার হয়েছে। ‘আল্টা ভিসতা’ (Alta Vista) নামক একটি সার্চ ইঞ্জিন তখনকার সময়ে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছিল।
ল্যারি পেইজ এবং সার্জেই ব্রিন যেহেতু একই বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন তাই তারা সেই সময়ের সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে আলোচনা করেন। তারা খেয়াল করেন যে সেই সার্চ ইঞ্জিন প্রাসঙ্গিক রেজাল্ট দিতে পারে না। অর্থাৎ, মূল ডেটাগুলো অন্যান্য ডেটার মধ্যে লুকায়িত থাকতো। এর ফলে ব্যবহারকারীকে সেই ডেটাগুলো থেকেই তার খোঁজকৃত রেজাল্ট বের করতো খুঁজে খুঁজে। এককথায়, সার্চ করার যেই উদ্দেশ্য সেটি পূর্ণ হতে পারতো না। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ল্যারি পেইজ ও সার্জেই ব্রিন তাদের প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন।
পেজ র্যাংক
পেজ র্যাংক হলো একটি উদ্ভাবনী প্রোগ্রামের নাম। ধরুন আপনি সাকিব আল হাসানের নাম সার্চ দিলেন। এখন সাকিব সম্পর্কে অনেক রেজাল্ট আপনার কাছে তুলে ধরা হবে। যার মধ্যে কিছু রেজাল্ট প্রাসঙ্গিক, কিছু স্বল্প প্রাসঙ্গিক এবং অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক। পূর্বের সার্চ ইঞ্জিন গুলোতে রেজাল্ট কোন ক্রম ছাড়া দেখাতো।
তাই সাথে সাথে প্রাসঙ্গিক রেজাল্ট পাওয়া যেত না বরং খুঁজতে হতো। কিন্ত পেজ র্যাংক সার্চ কোয়েরির (Search Query) এর মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যকে র্যাংক করতো। এই র্যাংক করার ক্ষেত্রে যেই লিংক সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা হতো (Accessible) তাকে নির্ধারণ করা হতো। বর্তমানে বিষয়টিকে অনেক সাধারণ একটি বিষয় মনে হলেও সেই সময় এটি বৈপ্লবিক উদ্ভাবনীয় ধারার দ্বার উন্মোচন করে। এই প্রোগ্রামের ভিত্তিতে সার্চ ইঞ্জিনের নাম দেওয়া হয় ‘Backrub.’ অর্থাৎ, গুগল এর নাম শুরু থেকেই গুগল ছিল না।
গোগল থেকে গুগল
Backrub নামটি পরিবর্তন করে একটি আকর্ষণীয় নাম খুঁজতে থাকেন ল্যারি পেইজ ও সার্জেই ব্রিন। তারা ‘Google Plex’ নামটি পছন্দ করেন। যার অর্থ দাঁড়ায় – Huge Number of Website. এর পরে তারা এই নামটিকে ছোট করে ‘Googol’ করে। নামটির ডোমেইনও তখন ব্যবহারযোগ্য ছিল। কিন্ত ভুলক্রমে নাম দেওয়ার সময় Googol এর পরিবর্তে তারা Google সার্চ দিয়ে ফেলে। অর্থাৎ গুগল পূর্বের থেকেই গুগল ছিল না তা তো বটেই, এর সাথে সাথে নামটি একটি ভুলবশত সার্চের মাধ্যমে সৃষ্টি। যা আজ প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষের নিত্যকার একটি টুলস হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
উত্থান
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ল্যারি পেইজ এবং সার্জেই ব্রিন তাদের পিএইচডি সম্পন্ন করতে স্ট্যানফোর্ডে এসেছিলেন। তাদের এই প্রজেক্টের মাধ্যমে গুগল প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্ত তারা দেখল যে দিন দিন গুগলের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। যার জন্য তাদের আরো বেশি কম্পিউটার হার্ডওয়ারের দরকার ছিল।
কিন্ত সেই চাহিদা পূরণ করতে তাদের কাছে ফান্ড ছিল না। তাই তারা সার্চ ইঞ্জিনের এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখতে সেই সময়ে থাকা অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতে থাকেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে গুগলকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্ত দেখা যায় কেউই কোম্পানিটিকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
প্রথমে ল্যারি পেইজ ও সার্জেই ব্রিন ‘আলটা ভিসতা’ (Alta Vista) এর কাছে বিক্রির প্রস্তাব রাখেন। তাদের আর্কিটেক্ট পল ফ্লাহার্টিকে তারা বলেন যে, গুগলকে আল্টা ভিসতা কিনে নিলে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন দুনিয়ায় রাজত্ব করবে। কিন্ত আল্টা ভিসতা তাদেরকে বলেন যে, তারা বাইরের কোন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে আগ্রহী নয় এবং সেটি তাদের লক্ষ্যের মধ্যেও পড়ে না।
এরপর গুগলকে ল্যারি ও ব্রিন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত টেক কোম্পানি ‘ইয়াহু’র (Yahoo) কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেন। মূলত ঐ সময়ে ইয়াহু বিভিন্ন ধরণের খবর, ইমেইল, বিনোদন এবং স্বল্প পরিসরে সার্চের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল। ইয়াহুর লক্ষ্য ছিল মানুষ শুধুমাত্র তাদের ওয়েবসাইটেই নিজস্ব সময় কাটাবে। অন্য কোন লিংক বা সাইটে নয়! এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহু গুগলকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। বরং তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ‘ডেভিড ফিলো’ (David Filo) ল্যারি এবং ব্রিনকে কিছু সময় বিরতি নিয়ে গুগলকে বিক্রি না করার পরামর্শ দেন।
অবশেষে গুগলকে ল্যারি এবং ব্রিন বিক্রি করতে ব্যর্থ হন। আসলে এটিকে সফল ব্যর্থতা বললেও ভুল হবে না। কেননা, আজ গুগলকে বিক্রি করলে বর্তমান অবস্থা এতো ভালো হতে নাইবা পারতো। কিন্ত প্রশ্ন থেকে যায়, এরপর গুগল ফান্ডিং এর ব্যবস্থা কোথা থেকে করলো?
ফান্ডিং
যখন গুগলকে কেউ সহায়তা করতে আসছিল না তখন আন্ড্রেয়াস বেখটোল্সহাইম নামক এক জার্মান ইনভেস্টর তাদেরকে ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করে দেয়। গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের আইডিয়া নিয়ে তিনি ল্যারি ও ব্রিনের সাথে আলাপ করে এটিকে অনন্য একটি আইডিয়া বলে মনে করেন। ল্যারি ও ব্রিন তাকে বলেন যে, গুগল ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে মানুষকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সার্চ ইঞ্জিনের অভিজ্ঞতা দিতে চায়। এবং এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই তারা তাদের রেভিনিউ বৃদ্ধি করবে।
অর্থাৎ, মানুষ যেই লিঙ্কে বেশি ভ্রমণ করবে সেটিকে ব্যবহার করে সেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। আন্ড্রেয়াস বেখটোল্সহাইম তৎক্ষণাৎ গুগলকে ১ লক্ষ ডলারের ফান্ডিং দেন। এই ফান্ডিং এর মাধ্যমে ল্যারি ও ব্রিন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহযোগিতাই নয় এর সাথে সাথে একটি নৈতিক সাহায্যও পায়। এরপরে গুগলকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই গুগল জাপানে তাদের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল অফিস খুলে। এবং তার তিন বছরের মধ্যেই তারা ৮০০ কর্মী নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের হেড কোয়ার্টারের সূচনা করে যাকে আমরা এখন ‘Googleplex’ নামে জানি। এভাবেই গুগল দিন দিন নতুন সার্ভিস যেমন – জিমেইল, ম্যাপ, ব্লগার, ট্রান্সলেটর, ক্যালেন্ডার, তাদের অপারেটিং সিস্টেম এন্ড্রয়েড, ক্রম ব্রাউজার ইত্যাদি চালু করতে থাকে।
মজার বিষয় হচ্ছে, আজ আপনি যেই ডিভাইসে এই আর্টিকেলটি পড়ছেন সেটিও গুগলেরই সার্ভিস, গুগলেরই অবদান। এক কথায়, গুগল আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেছে। গুগল ছাড়া আমাদের যেন চলাই দায়!
Feature Image: 1000logos.net
তথ্যসূত্রসমূহ: