গুগল ছাড়া জীবন কেমন ছিল তা মনে আছে কি? খবর পড়তে, গবেষণার কাজে কিংবা কোন অজানা পথে বেরিয়ে পড়লে তখন কিসের সাহায্য নিতেন? ভাবতেই পুরানো সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই না? আবার হয়তো কিশোর বয়সের কেউ গুগল ছাড়া জীবন কেমন তা ভাবতেই পারছেন না!
হ্যাঁ! এই অসম্ভব এক উদ্ভাবন আমাদের এতটাই প্রভাবিত করেছে যে আমরা গুগলকে নিজের অজান্তেই জীবনের একটা অংশ বলে মনে করি। গুগল ছাড়া জীবন কেমন? প্রশ্নটি না করে ভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে একজন গবেষক ২০০৭ সালে বলেছিলেন যে, ‘গুগল কি?’
এর উত্তর তখন কেউ দিতে পারেনি। হয়তো তখন মানুষের কাছে এটিকে অন্য গ্রহের কিছু মনে হয়েছিল। তবে এই ধারণা পালটে যায় কয়েক বছরেই। যে গ্রামের কৃষকটি গুগল সার্চের বদলে শুধুমাত্র মাঠে চাষ করা সম্পর্কে অবগত ছিল তিনিও আজ গুগলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
অথচ এই গুগল শুরু হয়েছিল একটা ওয়েবপেজ এর সেবা দিতে। আবার অনেকেই গুগলকে পৃথিবীর প্রথম সার্চ ইঞ্জিন মনে করে থাকে। আসলে এটি প্রথম, দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় সার্চ ইঞ্জিন নয়। এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ বলা যায়, যে এটি অন্যান্যদের চেয়ে ভালো র্যাঙ্কিং করতে পারতো।
সে যাইহোক, গুগল আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ছাপ রেখেছে। আর এটি সফল হতে কাজে দিয়েছে মানুষের কৌতূহলপ্রবণ আচরণ। পূর্বে তথ্য পেতে মানুষকে অনেক কিছুর সহায়তা নিতে হতো।
তবে আজ জরুরী বা অপ্রয়োজনীয়, সব ধরণের তথ্য সে গুগলের মাধ্যমে জানতে পারছে। পত্রিকা না কিনে শুধু গুগল করেই যেকোনো কিছু জানছে তো বটেই তার সাথে সাথে গুগল তাকে অনেক উত্তরও জানাচ্ছে।
ঢাকা থেকে আগত কোন ব্যক্তি চট্টগ্রামের সেরা রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানতে হয়তো পূর্বে তার পরিচিতদের ফোন দিয়ে বা অন্য কোন উপায়ের সাহায্য নিতো।
কিন্তু এখন গুগলকে বললেই রেস্টুরেন্টের তালিকা তো দিচ্ছেই আবার তাদের ফিডব্যাক কেমন সেটাও জানাচ্ছে। অর্থাৎ গুগল তথ্যকে সবার কাছে সহজতর করেছে।
আফ্রিকার দেশ ঘানার কথাই ধরা যাক। ঘানাতে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা গ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। গুগল উদ্ভাবনের পূর্বে সেখানে কৃষকরা চিরাচরিত ব্যবস্থায় চাষ এবং বিক্রি করতো। যদিও এই ব্যবস্থাটিও যে সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে হতো তা বলা যায় না। কারণ আফ্রিকার দেশগুলো সবসময় কোন না কোন দেশের কলোনি হয়ে অবহেলার মুখ দেখেছে।
কিন্ত বর্তমানে গুগল আসার পর ঘানার কৃষক এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, ৫৩ শতাংশ ব্যক্তি পরস্পর টেক্সট ম্যাসেজিং করছেন।
এছাড়াও অর্থ আদান প্রদানের জন্য ৬০ শতাংশ মানুষ গুগলের সহায়তা নিচ্ছেন, সাথে ৬১ শতাংশ ব্যক্তি কোন না কোন ভিডিও দেখে থাকেন। এই ভিডিও হয়তো নানা তথ্য কিংবা তাদের কর্মের প্রাসঙ্গিকতা বহন করে।
উপরের তথ্য দেখে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, টেক্সট ম্যাসেজিং করতে গুগল কি আবশ্যক? আসলে গুগল আপনি যেই মোবাইলে ব্লগটি পড়ছেন সেটি থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে আপনার অনলাইন শপিং, সবকিছুতেই তাদের ছায়া রেখে দিয়েছে।
কেননা আপনি যেই স্মার্টফোনটি ব্যবহার করছেন সেটি গুগলের অপারেটিং সিস্টেমেই চলছে। বলা চলে, বিশ্বের সব বড় বড় টেক জায়ান্ট গুগল ছাড়া অসহায়।
চীনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, গুগল উদ্ভাবনের পূর্বে সেখানের গ্রামগুলোতে বয়স্ক ব্যক্তিরা চিকিৎসা সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ দেখাতেন না। কেননা, সেটি ছিল দুস্কর একটি বিষয়।
তবে এখন ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সেবা তথা গুগলের মাধ্যমে তারা নানা সমস্যার সমাধান পাচ্ছে। পুরাতন একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, ৩৩ শতাংশেরও বেশি বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদের সমস্যাগুলো অনলাইনে সার্চ করে থাকেন যা ক্রমেই বৃদ্ধির দিকে।
গুগল ট্রান্সলেটর
গুগল ট্রান্সলেটর অনেক জনপ্রিয় একটি অ্যাপ্লিকেশন। সার্চ ইঞ্জিনের বাইরে গিয়ে গুগল আমাদের জীবনের খুঁটিনাটিতে চোখ দিয়েছে। শহর কিংবা গ্রাম, আপনি যে জায়গায় থাকুন না কেন গুগলের এই ফিচারের পূর্বে কিভাবে অনুবাদ করতেন মনে আছে কি?
২০০৬ সালে গুগল ট্রান্সলেটর উদ্ভাবন হওয়ার পূর্বে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ঘরে ঘরে দেখা যেতো। তবে সেটির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিভিন্ন ভাষার জন্য আলাদা করে ডিকশনারি কেনা ছাড়া উপায় ছিল না।
কিন্ত আজ গুগল সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে দিয়েছে। ট্রান্সলেটর অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে আপনি শুধু ইংরেজি নয়, একশত ত্রিশের অধিক ভাষায় অনুবাদ করতে পারছেন।
গুগলের এই উদ্ভাবন যে শুধুমাত্র গবেষক বা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে পরিবর্তন করেছে তা কিন্ত নয়। নিরক্ষর এবং বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিগণও আজ এই সেবার আওতায় এসে ট্রান্সলেটরের ভয়েস ফিচার ব্যবহার করে সহজেই অন্য ভাষার অর্থ জানছেন।
অ্যানালিটিকস
একবিংশ শতাব্দির অক্সিজেন হচ্ছে তথ্য। আর এই অক্সিজেন উৎপাদন করতে প্রয়োজন বিগ ডেটা। কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসাকে এই বিগ ডেটা অ্যানালাইসিসের মাধ্যমেই পরিচালনা করেন। এই অ্যানালাইসিস আসে গুগলের অ্যালগরিদমের মাধ্যমেই।
মিলেনিয়ালরা তাদের ব্যবসা গুগল ছাড়া চিন্তাই করতে পারে না। ছোট কিংবা বড় সব ধরণের ব্যবসাই চলছে গুগলের সেই অ্যালগরিদমের উপর ভিত্তি করেই।
আপনি আজ যেই ওয়েবসাইটটি তৈরি করলেন, সেটি যদি গুগল র্যাংকে না থাকে তাহলে ওয়েবসাইটটির কোন মূল্য থাকে না।
ভাবুন তো, ২০০৪ সালে যে কোম্পানিতে কোন বিনিয়োগকারী আগ্রহ দেখায়নি, আজ সেই কোম্পানিটিই অন্যান্য বিলিয়ন ডলার কোম্পানির অক্সিজেন।
অথচ টেক জায়ান্ট কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বে গতানুগতিক ধারায় চলতো। শেয়ার বাজারের অবস্থা শুধুমাত্র নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকেই পরিচালনা হতো। এখন কোন শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাবে বা কমবে অথবা কোন শেয়ার কিনলে ভবিষ্যতে লাভবান হওয়া যেতে পারে তার সবকিছুই গুগল অনুমান করে দিচ্ছে। এই সেক্টরে গুগলের একচেটিয়া আধিপত্য সম্পূর্ণ সিস্টেমের পরিবর্তন করেছে মাত্র দুই দশকেই।
গুগল ম্যাপ
গুগল ম্যাপের দরুণ আজ খুব সহজেই যেকোনো জায়গায় পাড়ি দেওয়া যায়। পাহাড়ে ট্র্যাকিং কিংবা অচেনা শহরে, যেকোনো স্থানেই গুগলের ম্যাপ আপনাকে পথ দেখাবে যা পূর্বে কাগজের মানচিত্রের মাধ্যমেই সম্ভব হতো।
ম্যাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হচ্ছে এটি আপনাকে আপনার বর্তমান লোকেশন অফলাইনেও জানাতে সক্ষম যা ১৫ বছর পূর্বে চিন্তার বাইরে ছিল। এছাড়াও রিয়েল টাইম ট্রাফিক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সহজতর পথটি বেছে নিতেও গুগল আপনাকে সেবা দিচ্ছে।
গুগল স্যুট
গুগল স্যুট ইন্টারনেট ব্যবহারে বিপ্লব এনেছে। গুগলের জিমেইল থেকে শুরু করে ক্লাসরুম, কি নেই এর ভিতরে? অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা অফিসের জন্য স্লাইড বানানো, মুহূর্তের মধ্যে ইমেইল পাঠিয়ে কিংবা জ্যামবোর্ডে খুব সহজেই কলিগদের আপনার ধারণা বুঝিয়ে দেওয়া সব কিছুই এর মধ্যে আছে।
গুগলের ডক, শিটস, ফর্ম সব কিছুই আজ মাইক্রোসফটের জায়গা নিয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এই অ্যাপসগুলোতে একসাথে কয়েকজন ব্যক্তি রিয়েল টাইমে কাজ করতে পারেন যা হয়তো একসময় অসম্ভব এক বিষয় ছিল।
অপরদিকে গুগলের ইউটিউব অনেকের কাছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ নিয়েছে। হাজার হাজার কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের বিনোদনমূলক ভিডিওর সাথে সাথে অনেক বড় বড় নিউজ চ্যানেল এবং স্পেশালিস্টরা এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে বিশ্বের আনাচে কানাচে তথ্য সরবারহ করে আসছে।
গুগলের পূর্বে বিনোদনের জন্য ডিভিডি এবং তথের জন্য টক শো কিংবা বই ছাড়া উপায় ছিল না বলা চলে। আজ গুগলের আশীর্বাদে পৃথিবীর সব শ্রেণির মানুষ কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই তথ্য পাচ্ছে।
গুগল পৃথিবীর সম্পূর্ণ চিত্রকে বদলে দিয়েছে। তবে ‘অল দা ফ্যাক্টস: অ্যা হিস্টোরি অব ইনফরমেশন ইন ইউনাইটেড ষ্টেট’ এর লেখক জেমস কর্ডাটা বলছেন যে গুগলের এই পরিবর্তন আনা নতুন কিছু নয়। বরং এটি মানুষের তথ্য পাওয়ার প্রবণতাকে অব্যাহত রেখেছে।
কিন্তু কয়েনের উলটো পিঠ দেখলে বুঝা যায় যে, গুগল আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটিকে অনেকে ‘কালেক্টিভ মেন্টাল ক্রাচ’ ও বলছেন। কেননা, আজ গুগল আছে বলেই আমরা তথ্য মনে করতে চাই না। কোন কিছু দরকার পড়লেই বলে ফেলি-
‘গুগল ইট!’
এটি এখন আমাদের চিন্তার একটি ধরণে রুপ নিয়েছে। বলা চলে নিজের মস্তিষ্কের বদলে গুগলই আমাদের মস্তিষ্ক। গুগলের সেবাগুলো নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানান। কেননা এটি আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়ার মাধ্যমেই সেবাগুলো দেয়। এখানে প্রশ্ন জাগে- ‘কোন সেবা তথ্য প্রদান ছাড়া পাওয়া যায়?’
সে যাইহোক, গুগল এখন একটি সাধারণ সার্চ ইঞ্জিন তো নয়ই বরং এটি ইংরেজি ব্যাকরণের ক্রিয়াপদ (Verb) হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর আর কোন মাল্টিবিলিয়ন কোম্পানি নামপদ থেকে ক্রিয়াপদে পরিণত হবে কিনা সেটি নিয়ে বিরাট প্রশ্ন থেকেই যায়। এর জন্যই হয়তো জোনাথান টপলিন বলেন-
‘এটি গুগলের দুনিয়া, আর আমরা এতে বাস করি।’
Feature Image: OutlookIndia References: 01. how google changed our life. 02. How Google Changed The Way We Do Things. 03. How Google Changed Our Lives? 04. Has Google Changed The World? 05. Is Life Without It Even Possible Anymore? 06. 20 Years Of Google Has Changed the Way We Think. 07. How Google has changed our lives? Know its Origin and History.