পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত, দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে জনবহুল শহর। একসময় ৮০০ জনের বেশি লোকের নিছক মাছ ধরার গ্রাম ছিল। কিন্তু দুবাই সময়ের সাথে সাথে একটি বিশ্বব্যাপী মহানগর এবং মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে আমিরাতের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি দুবাই শহরের মধ্যে বসবাস করে। আজকে আমরা আলোকপাত করবো, দুবাই-মরুভূমি থেকে কীভাবে স্বপ্ননগরী হলো!
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
দুবাইয়ের ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বা ব্রোঞ্জ যুগের। খ্রিস্টীয় ৫-৭ শতকের সময়, দুবাই একটি বিখ্যাত বাণিজ্য রুট হয়ে ওঠে। সেই সময়ে দুবাইয়ের মানুষের জীবিকা ছিল মুক্তা, মাছ ধরা এবং নৌকা তৈরি করা। বাণিজ্য রুটগুলি খুব বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং যার ফলে শীঘ্রই ইউরোপীয় এবং পর্তুগিজদের কাছ থেকে সাড়া পেতে শুরু করে।
কয়েক শতাব্দী পরে ১৭৯৩ সালে, দুবাইয়ের বানি উপজাতি লোকের সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার কারণে তারা দুবাইয়ের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজত্ব করতে সক্ষম হয়েছিল। এটি দুবাইয়ের অন্যান্য উপজাতিদের অবস্থান এবং অনুভূতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। তাই এই সময়কালে দুবাইয়ের অনেক উপজাতিদের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, ব্রিটিশরা তাদের শাসন প্রসারের জন্য পথ খুঁজছিল। ফলশ্রুতিতে তারা স্থানীয় শাসকদের সাথে বন্ধনের চেষ্টা করে। ব্রিটিশরা দুবাই শেখদের সাথে সামুদ্রিক যুদ্ধবিরতি করতে সফল হয়েছিল। অনাদিকাল থেকেই দুবাই মুক্তার জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল। যার কারণে, শহরটি সারা বিশ্বের লোকেদের আকর্ষণ করার একটি কারণ ছিল।
পরবর্তীতে, বানি ইয়াস উপজাতির নেতা মাকতুম বিন বুট্টি তার কয়েকজন উপজাতির সাথে শিন্দাঘা উপদ্বীপে চলে যান। এই ঘটনাটি দুবাইয়ের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। কারণ এই ঘটনা থেকেই আবুধাবির উদ্ভব হয়েছিল। ধীরে ধীরে দুবাইয়ের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েই চলে। শীঘ্রই, দুবাইকে উপসাগরীয় উপকূলের প্রধান বন্দর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রায় ১৮ শতকের দিকে, দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল এবং দুবাইয়ের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ১৯০২ সালে, দুবাইয়ে আরবরা বসতি স্থাপন করে এবং ইরানী ব্যবসায়ীদের ব্যাপক প্রবাহ দেখা দিয়েছিল। যার ফলে ক্রমেই দুবাইয়ের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রায় ১৯৫০-এর দশকে, ট্রুসিয়াল স্টেটে তেল আবিষ্কৃত হয়েছিল।
১৯৬৬ সালে দিকে, ফতেহের তেলক্ষেত্রে তেল পাওয়া যায়। তবে সাধারণ চিন্তার বিপরীতে, দুবাইতে তেল আবিষ্কার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। তবে দুবাইয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে, অল্প সময়ের মধ্যে এসব জায়গা থেকে প্রচুর তেল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছিল। যা দুবাইয়ের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
ভাষা
দুবাইয়ের অফিসিয়াল ভাষা আরবি। তবে কর্মক্ষেত্রে এবং বাইরের বেশিরভাগ লোকেরা ইংরেজিতে যোগাযোগ করে। কারণ দুবাইতে বিভিন্ন দেশের লোক রয়েছে। তাই ইংরেজি ভাষাই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বেশিরভাগ রাস্তা, দোকানের চিহ্ন, রেস্তোরাঁর মেনু ইত্যাদি ইংরেজি এবং আরবি উভয় ভাষায়ই লেখা থাকে।
দুবাই সংস্কৃতি
দুবাইয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইসলামি আদর্শে গঠিত। দুবাই মধ্যপ্রাচ্যের বিনোদন রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত। এটি সারা বিশ্বের পর্যটক প্রেমীদের আকর্ষণ করে, বিশেষ করে যারা শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জায়গাতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ধনী।
যদিও দুবাই পর্যটকদের জন্য এই চিত্রটি গড়ে তুলেছে। তবে বর্তমানে দুবাইয়ে ইসলামিক নাগরিকদেরকে অনেক বিনোদন পরিষেবায় লিপ্ত হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এছাড়া, এই পরিষেবাগুলো প্রায়ই আবাসিক এলাকার পরিবর্তে পর্যটন এলাকায় অবস্থিত।
দুবাইতে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ নয়; তবে এটি হোটেল, বার বা নাইটক্লাবের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। স্থায়ী বাসিন্দারা চাইলে তাদের বাড়িতে বসে মদ্যপান করতে পারবেন। তবে তাদের কাছে কর্তৃপক্ষের দ্বারা জারি করা অ্যালকোহল লাইসেন্স থাকা লাগবে। রাস্তায় বা সর্বজনীন স্থানে মদ্যপান করা অবৈধ।
শুয়োরের মাংস পর্যটন ও প্রবাসীদের খাওয়ার জন্য পাওয়া যায়। পর্যটক এবং প্রবাসীরা তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতির অভ্যাসগুলো রাস্তায় দেখাতে পারবে না। আইন ভঙ্গ করলে কঠিন শাস্তি রয়েছে। দুবাই শহরের লোকজন ঐতিহ্যগতভাবে তাদের উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য বেশ পরিচিত, এবং অতিথিদের নাস্তা দেওয়ার সময় তারা খুব উদার হয়।
আধুনিক দুবাই শহরের যাত্রা
১৯৬৬ – দুবাই তার নিজস্ব তেল আবিষ্কার করে। এজন্য ব্যবসায়ীরা দুবাইতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করে।
১৯৬৮ – দুবাই তেল রপ্তানি শুরু করে এবং কোষাগারে প্রচুর পরিমাণে ডলার জমা হয়।
১৯৭৩ – দিরহামকে দুবাইয়ের সরকারী মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৮০ – দুবাইয়ের তেলের বার্ষিক আয় কমে ৩ মার্কিন ডলার হয়।
১৯৮৫ – এমিরেটস এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯০ – প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় শেখ রশিদ মারা যাওয়ার কারণে তার পুত্র শেখ মাকতুম দুবাইয়ের শাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৬ – দুবাই শপিং ফেস্টিভ্যাল এবং দুবাই ওয়ার্ল্ড কাপ চালু হয়। পরবর্তীতে যা খুবই জনপ্রিয় বার্ষিক ইভেন্টে পরিণত হয়।
১৯৯৯ – বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হোটেলগুলির মধ্যে একটি বুর্জ আল আরব নির্মাণ হয়। যা পর্যটকদের গন্তব্যস্থান হিসাবে দুবাইয়ের খ্যাতি আরও বাড়িয়ে দেয়।
২০০৩ – দুবাইকে একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংক দ্বারা আর্থিক কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত দেওয়া হয়। এছাড়া হঠাৎ করে ফ্রিহোল্ড সম্পত্তি প্রবর্তনের কারণে দুবাইয়ের সম্পত্তির বাজার মূল্য বেড়ে যায়।
২০০৬ – শেখ মোহাম্মদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাশাপাশি তিনি দুবাইয়েরও শাসক ছিলেন। তিনি তার মাকতুম পূর্বপুরুষদের উদার নীতিগুলি গ্রহণ করেন এবং দুবাইকে আরও উন্নত করেন।
২০০৭ – শেখ মোহাম্মদ দুবাইকে কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৫ হিসেবে ঘোষণা করেন, সেই সাথে দুবাই স্টুডিও সিটির উদ্বোধন করেন। দুবাই বিশ্বকাপের প্রাইজমানি ১০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয় এবং দুবাইকে ইন্টারন্যাশনাল সিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০০৮ – দুবাই স্পোর্টস সিটি এবং দুবাই ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল তিন (৩) এর সাথে নতুন করে মাকতুম ব্রিজ চালু করা হয়। পরবর্তীতে আটলান্টিস, দ্য পাম হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট চালু করা হয়।
২০০৯ – বিশ্বের বৃহত্তম শপিং মল দুবাই মল উদ্বোধন করা হয়। সেই সাথে রেল লাইন (দুবাই মেট্রো) কার্যক্রম শুরু করে। তাছাড়া, দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়।
২০১০ – বিশ্বের উচ্চতম আকাশচুম্বী ভবন বুর্জ খলিফা নির্মাণ করা হয় এবং আল মাকতুমকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা এবং চালু করা হয়।
২০১১ – দুবাই মেট্রো গ্রীন লাইনের পাশাপাশি পাম ডিরা স্টেশন নিমার্ণের পরিচালনা শুরু করা হয়।
২০১২ – প্রিন্সেস টাওয়ার এবং জেডব্লিউ ম্যারিয়ট মারকুইস দুবাই ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০ এর জন্য দুবাই বিড হিসাবে নির্মিত হয়।
২০১৩ – দুবাই ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০ এর জন্য বিড জিতে এবং শেখ মোহাম্মদ দুবাইকে ওয়াটার ক্যানেল ঘোষণা করেন।
২০১৪ – মল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, বিশ্বের বৃহত্তম মল এবং ইনডোর থিম পার্ক ঘোষণা করা হয়। সাথে অপেরা গ্র্যান্ড, দুবাই অপেরা হাউস ডিস্ট্রিক্টের প্রথম হাই-রাইজ খোলা হয়েছে।
২০১৫ – সংযুক্ত আরব আমিরাত হোপ নামে মঙ্গল গ্রহ অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু করে।
২০১৬ – শেখ মোহাম্মদ দুবাইক ওয়াটার ক্যানেলর উদ্বোধন করেন।
২০১৭ – দুবাই সাফারি পার্ক জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
২০১৮ – বিশ্বের বৃহত্তম ফ্রেম, দুবাই ফ্রেম ২০১৮ সালে চালু করা হয়।
২০১৯ – বুর্জ জুমেইরাহ নির্মাণকাজ শুরু হয়।
২০২২ – দ্য মিউজিয়াম অফ দ্য ফিউচার, একটি প্রদর্শনী স্থান হিসেবে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ কার্যক্রম শুরু করে।
দুবাই শহর বছরের পর বছর ধরে উন্নয়নের চেষ্টা করেছে। যারই ফলশ্রুতিতে অনুর্বর ভূমি থেকে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল এবং জনপ্রিয় শহরগুলোর মধ্যে একটি হলো দুবাই। প্রথমে শহরটি মুক্তার জন্য বিখ্যাত স্থান ছিল। কিন্তু বর্তমানে অতি আধুনিক স্থাপত্য এবং সর্বোত্তম সুযোগ-সুবিধাসহ একটি মহাজাগতিক শহরে পরিণত হয়েছে।
Feature Image: archdaily.com References: 01. The-history-of-Dubai. 02. The History. 03. Dubai History. 04. The Dubai.