হউতুওয়ান: জেলেদের নগরী গ্রাস করেছে প্রকৃতি

485
0

প্রকৃতির মাঝে মানুষের বসবাস। সেই প্রকৃতির জায়গা দখল করে নিয়েই গড়ে তোলে আবাসস্থল। আবার এই মানুষ যখন প্রকৃতি ছেড়ে যায়, তখন প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই জায়গা পুনরুদ্ধার করে নেয়৷ তেমনভাবেই প্রকৃতি গ্রাস করে নিয়েছিল চীনের এক গ্রামকে।

চীনের এক প্রাচীন গ্রাম হউতুওয়ান। ফিশিং ভিলেজ হিসেবে পরিচিত এই গ্রামটি একসময় বেশ জমজমাট ছিল। সময়ের পরিক্রমায় কমতে শুরু করে মানুষ, একটা সময় পরিত্যক্ত এক গ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে যায়। আজকের আলোচনায় থাকছে এমনই এক গ্রামের গল্প।

চীনের শেংশান দ্বীপের একটি গ্রাম হউতুওয়ান, যা একসময় জনপ্রিয় ছিল মাছ ধরার গ্রাম হিসেবে। শেংশান দ্বীপ ৪০০ শেংশাই দ্বীপপুঞ্জগুলোর একটি দ্বীপ। সাংহাই থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হউতুওয়ান গ্রাম।

পাখির চোখে পরিত্যক্ত গ্রাম। Image Source: JOHANNES EISELE/AFP/AFP/Getty Image

ফিরে দেখা সেই প্রাণবন্ত হউতুওয়ান

১৯৫০ সালের দিকে চীনে মৎস্য শিল্প এবং মাছের ব্যবসার প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। তখন জীবিকার তাগিদে এই গ্রামে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জমজমাট এক মাছ শিকারের গ্রামে পরিণত হয়ে ওঠে। সাংহাই থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রামটিতে তখন ছিল মানুষের সক্রিয় বসবাস। 

মৎস্য শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকায় এখানে জেলে পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রায় ২ হাজারের অধিক জেলে এবং তাদের পরিবার বসবাস করতো এই গ্রামে। ১৯৮০ সালের দিকে এটি একটি সমৃদ্ধ মাছ ধরার সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল এবং তখন প্রায় ৩ হাজার লোকের বসবাস ছিল। গ্রামের অর্থনীতি প্রাথমিকভাবে মাছ ধরা এবং এই সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে ছিল। এখানের বাসিন্দারা তাদের জীবিকার জন্য সামুদ্রিক খাবারের উপর নির্ভর করতো।

হউতুওয়ান: এক পরিত্যক্ত নগরী

‘৯০ দশকের শুরুর দিকে ক্রমবর্ধমান এই মৎস্য শিল্পের প্রসারতা কমতে শুরু করে। এবং মৎস্য শিল্পের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হতে শুরু করে হউতুওয়ান গ্রাম। যার ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে মানুষের সংখ্যা। জীবিকার তাগিদে এবং উন্নত জীবনের সন্ধানে এই গ্রামের বাসিন্দারা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। এভাবে উন্নত জীবনের আশায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়াটা চীনের ছোট ছোট গ্রামগুলোর জন্য একটি সাধারণ বিষয়। 

হউতুওয়ানের পরিত্যক্ত গ্রাম। Image Source: thebroadlife.com

ধীরে ধীরে গ্রামের প্রতিটি ঘরই পরিত্যক্ত হতে শুরু করে এবং কিছু সংখ্যক বাসিন্দা এখানে রয়ে যায়। মাছই ছিল এখানকার মানুষের অর্থ উপার্জনের প্রধান উপায়। কিন্তু, তখন সাংহাইয়ের মতো বড় শহর কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে অনেক মানুষ মাছ ধরার চেষ্টা করছিল।  

জীবিকা নির্বাহের জন্য মাছের যে পরিমাণ চাহিদা ছিল, তা তখন এই গ্রাম থেকে মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু, লোকেরা কতটা মাছ ধরতে পারে সেই সম্পর্কিত নিয়ম ছিল, কিন্তু সেগুলি ভালোভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। এতে তাদের পর্যাপ্ত খাবারের জোগান দেয়াটাই কঠিন হয়ে পড়ে।  

এই সমস্ত সমস্যার কারণে, অনেক লোক ভালো পরিষেবা পেতে হউতুওয়ান গ্রামটি ছেড়ে দিয়ে সাংহাইয়ের মতো আধুনিক শহরে চলে গেছে। গ্রামটি প্রায় সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা এবং খাদ্য বিতরণের সমস্যা। ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই গ্রামটি জনশূন্য করা হয়েছিল। 

পরিত্যক্ত গ্রাম। Image Source: JOHANNES ELE/AFPISE/AFP/Getty Images

গত দুই দশক ধরে সবুজে আচ্ছাদিত হয়েছে এই গ্রামের প্রতিটি ঘর। তাদের বসবাসের জায়গা, আসবাবপত্র যেভাবে তারা রেখে গিয়েছিল তেমনই আছে। আর সেসবের উপরে জায়গা করে নিয়েছে সবুজ গাছপালা।

ভুতুড়ে নয় বরং অদ্ভুত সুন্দর

মানুষের আনাগোনা কমে যাওয়াতে জায়গাটি ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। তবে এই ভুতুড়ে জায়গাটিই অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় পরিণত হয়েছে। মানুষ চলে গেছে, আর প্রকৃতি দখল করতে শুরু করেছে, সবুজে ঘরবাড়ি ঢেকে দিয়েছে।

শেংশান দ্বীপের এই গ্রামটি বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত এবং জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। ভিন্নভাবে আবার এও বলা যায় যে, বিশ্বের সবচেয়ে সবুজ এবং অত্যাশ্চর্য সবুজ একটি গ্রাম হলো হউতুওয়ান। 

বাড়িঘর ছেড়ে যারা চলে গিয়েছে, সেই জায়গাগুলো যেভাবে রেখে গিয়েছিল, সেভাবেই পড়ে আছে। মানুষের বিচরণ কমে যাওয়াতে সেসব বাড়ির দেয়াল জুড়ে বেড়ে উঠেছে সবুজ গাছপালা। এভাবে গোটা গ্রামের বাড়িঘরগুলোকে ঢেকে নিয়ে সবুজ অরণ্য।

হউতুওয়ানের সৌন্দর্য। Image Source: thebroadlife.com

পরিত্যক্ত হলেও প্রকৃতি তার আপন হাতে সাজিয়ে তুলেছে হউতুওয়ান গ্রামটিকে। দেখে মনে হয়, খুব যত্ন সহকারে সাজিয়েছে কেউ এই গ্রামটিকে। প্রতিটি ঘরই ঢেকে আছে সবুজ অরণ্যের আড়ালে। আর এই সুন্দর মনোরম পরিবেশ ঘুরে দেখতে ভীড় জমাচ্ছে পর্যটকেরা। প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার জিনিসপত্র পুনরুদ্ধার করে এবং সবুজ জনবসতিহীন গ্রামটিকে গ্রাস করে।

জরাজীর্ণ বাড়িগুলো সবুজে আচ্ছাদিত হয়ে ওঠে।  তৎকালীন জনপ্রিয় মাছ ধরার গ্রামটি এখন সবুজে আবৃত এবং লতানো লতা দ্বারা আবৃত। ভূতের শহর এখন পাখির কিচিরমিচির, মশার গুঞ্জন এবং সমুদ্রের হাওয়া ছাড়া এক ভয়ঙ্কর নীরবতায় পূর্ণ।

হউতুওয়ানের অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্য এটি বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিত্যক্ত স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০১৫ সালের দিকে এই একাকী গ্রামের কিছু মনোমুগ্ধকর ছবি ভাইরাল হয়েছিল। যার ফলে চীনা নাগরিকদের মধ্যে হউতুওয়ান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

হউতুওয়ানের পরিত্যক্ত গ্রাম। Image Source: JOHANNES EISELE/AFP/AFP/Getty Images

গ্রামে এখন গুটিকয়েক বাসিন্দা থাকা সত্ত্বেও এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রতিদিনই শত শত পর্যটক হউতুওয়ান গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে। ছোট ছোট ফুটপাতের মধ্য দিয়ে হেঁটে উপভোগ করে জীর্ণ কুটির পাতায় আচ্ছন্ন সবুজ এই গ্রামটি।

যারা এখনও এই গ্রামে রয়ে গিয়েছে, তারা আয়ের আরেকটি উপায় খুঁজে পেয়েছে। তারা এখানে আসা পর্যটকদের নিকট পানি বিক্রি করে। যতদূর চোখ যায় দৃশ্যগুলি সবুজ, এটি একটি বিস্ময়কর দৃশ্য এবং ফটোগ্রাফারের স্বর্গ।

হউতুওয়ান যাবার উপযুক্ত সময়

হউতুওয়ান এখন পরিণত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রে। পরিত্যক্ত এই গ্রামটি এখন প্রকৃতি গ্রাস করে নিয়েছে, যা আকর্ষণীয় করে তুলেছে পর্যটকদের। এখানে যেকোনো সময় গেলেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তবে গ্রীষ্মকালের হউতুওয়ান খুব সুন্দর রূপে সেজে থাকে। তাই হউতুওয়ান গ্রামটি ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। এ সময় প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে ওঠে।

গ্রীষ্মের দিনে হউতুওয়ান। Image Source: EISELE/AFP/AFP/Getty Images

বেশিরভাগ গাছ এবং গাছপালা গ্রীষ্মকালে পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, একটি প্রাণবন্ত এবং রঙিন পরিবেশ তৈরি করে। এটি গ্রামটিকে অবিশ্বাস্যভাবে মনোরম করে তোলে। 

গ্রীষ্মের উষ্ণ তাপমাত্রা এবং দীর্ঘ দিনের আলোর জন্য এই সময়টা মনোরম আবহাওয়া তৈরি করে। এই কারণে হাইকিং, পিকনিক এবং গ্রামাঞ্চলে হাঁটার মতো কার্যকলাপের জন্য এই সময়টি উপযুক্ত একটি সময়।

 

 

Feature Image: travel+leisure
References:

01. The Abandoned Fishing Village of Houtouwan02. Houtouwan, Shengshan Island, China.  
03. China’s Forgotten Village Swallowed by Nature.