ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
ছোটবেলায় শামসুর রহমান এর কবিতা আওড়ে বড় হয়েছি প্রায় সবাই। কিন্তু সত্যিই কয়জন জানি ট্রেনের বাড়ি কোথায়? কীভাবেই বা এলো ট্রেন, কেন বা কোথায় এর উৎপত্তি। একুশ শতকে এসে যেকোনো বাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রেনও আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সড়ক পথে যানজট কিংবা নৌপথে দূর্ঘটনা এড়াতেও কিন্তু ট্রেনের ব্যবহার বহুল।
ব্রিটিশদের হাত ধরে উদ্ভাবিত এই রেল বা ট্রেনের জন্মকথনও কম অবাক করার নয়। সাধারণ পাত দিয়ে ঠেলাগাড়ির চিন্তা থেকে ইঞ্জিনযুক্ত ট্রেন যা শিল্পবিপ্লবে রেখেছে অসামান্য ভূমিকা। আজকে চলুন জেনে নিই, জনপ্রিয় এই বাহন ট্রেন বা রেলপথের জন্মকথা, নানান মজার সব তথ্য।
পরিবহনের প্রথম ধাপ
প্রাচীনকালে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথেই বাড়তে লাগলো বিভিন্ন অনুষঙ্গের। আর এ আনুষাঙ্গিক পণ্য পরিবহণে শ্রমিক নিযুক্ত থাকলেও তা অত্যন্ত শ্রম ও সময় সাপেক্ষ হওয়ায় মানুষ বাহনের উদ্ভাবন ঘটায়। পরিবহনের প্রথম ও প্রধান পথ ছিল পানি। নৌপরিবহনের মাধ্যমে যোগাযোগ এর পাশাপাশি ষাঁড়, গরু, ঘোড়া বা গাধাদের দ্বারা পণ্যবোঝাই পরিবহণ হতো। অনেক স্থানে এগুলোকে ওয়াগনওয়ে বলা হত।
কিন্তু শিল্পবিপ্লবের সময় বিভিন্ন বস্তু যেমন কয়লা বা এ ধরণের পণ্য নৌযানে পরিবহণ করা দুষ্কর হয়ে যাওয়ায় যান্ত্রিক বাহনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে বুঝা যায়। পরবর্তীতে ১৬৯৮ সালে থমাস সেভেরি বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে ইঞ্জিনযুক্ত বাহনের কথা মাথায় আসে উদ্ভাবকদের।
যদিও তখনই ট্রেনের মতো যানবাহনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাযুক্ত ইঞ্জিনের আবিষ্কার ঘটেনি। ১৭৬৩ সালের পর ওয়াটের উদ্ভাবিত ইঞ্জিন দ্বারা লোকোমোটিভ তৈরি করেন ম্যাথিউ মারে নামক এক ইংরেজ। সেখান থেকেই ভীত রচিত হয় ট্রেন নামক নতুন যানবাহনের।
লোকোমোটিভ থেকে ইঞ্জিনযুক্ত রেলের যাত্রা
লোকোমোটিভ থেকে রাতারাতিই ট্রেনের উদ্ভব ঘটেনি। যদিও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই সব ঘটেছিল। বিভিন্ন আবিষ্কারকদের পরিশ্রম আর প্রযুক্তির সহায়তায় আজকে আমাদের আরামদায়ক রেলযাত্রার ভিত্তি।
ম্যাথিউ মারে কর্তৃক লোকোমোটিভ আবিষ্কারের পর ব্রিটিশ খনি প্রকৌশলী ও উদ্ভাবক রিচার্ড ট্রেভিথিক ট্রেনের সিরিজ দেখান। তিনিই প্রথম ইঞ্জিনচালিত বাহনের সূচনা করেন। যদিও তা বাষ্প ইঞ্জিন ছিল, সাথে ছিল পিস্টন রড একশন এবং ফ্লাইহুইল। ১৮০২ সালে তিনি যে বাষ্প-পাম্পিং ইঞ্জিন তৈরি করেন তা প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৪৫ পাউন্ডে কাজ করতে সক্ষম ছিল।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে তার এই লোকোমোটিভ তথা ট্রেনের সিরিজগুলো জনপ্রিয় হতে থাকে। যদিও তখনও আক্ষরিক ট্রেনের সূচনা ঘটেনি। রেললাইন নির্মাণ করে ট্রেনের জনক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন জর্জ স্টিফেনসন। লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত নির্মিত হয় ট্রেন তথা প্রথম রেললাইন।
৩১ মাইলের এই দুরত্বেই শুরু হয় রেলপথের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। স্টিফেনসন এর এই ট্রেনের গতি ছিল ঘন্টায় ৩০ মাইল। পণ্যের পাশাপাশি যাত্রীও বহন করা শুরু হয় সেই ট্রেনে।
রেলের বিকাশ
ইউরোপে শুরু হওয়া রেলপথের হাওয়া আমেরিকায় আসতে বেশি সময় নেয়নি। ১৮২৭ সালে বাল্টিমোর ও ওহিও রেলপথের মাধ্যমে আমেরিকাতেও রেলযাত্রা শুরু হয়। বাল্টিমোর বণিকদের নির্মিত লোকোমোটিভগুলো স্টিফেনসনের চেয়েও শক্তিশালী ছিল। জার্মানিতে রেলের শুরু ১৮৩৫ সালে। ইতালিতে ১৮৩৯ সালে এবং ঠিক ৫ বছর পর ১৮৪৪ সালে ফ্রান্সে রেলওয়ে সার্ভিস শুরু হয়।
আন্তঃমহাসাগরীয় রেলযাত্রা শুরু হতেও বেশি সময় লাগেনি। ১৮৫৫ সালে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের দুই তীরের যাত্রীদের রেলভ্রমণের স্বাদ দেয় পানামা রেলপথ।
অবাক করা ব্যাপার, ১৮৬৩ সালে মাটির গভীরেও রেলপথ বসানো হয়। লন্ডনে নির্মিত বিশ্বের প্রথম এই পাতাল রেলপথ ছিল ৪ মাইল দীর্ঘ যা প্রথম দিনেই ত্রিশ হাজার যাত্রী বহন করেছিল। প্রথম ইঞ্জিনযুক্ত রেলের প্রস্তাবনা, পাতাল রেল সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যকে তাই বলা হয় বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রেল ব্যবস্থা।
আধুনিকায়নে রেল
বাষ্প ইঞ্জিনের ধোঁয়া ছড়ানো ট্রেনে আজ আধুনিকতার হাওয়াও লেগে গেছে বেশ ভালোভাবেই। বিদ্যুৎ চালিত দ্রুত গতির ট্রেনের কাছে লোকোমোটিভ যেন হারিয়ে যাওয়া রুপকথা।
বাষ্প ইঞ্জিনের ধোঁয়া থেকে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি দ্রুতই সামনে চলে আসে। সেই দূষণ রোধ করতেই ১৮৭৯ সালে ভার্নার ভন সিমেন্স প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের প্রদর্শনী করান এবং ঠিক দুই বছর পর বিশ্বের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম লাইন নির্মাণ করেন সিমেন্স।
বিদ্যুতায়নের পর ডিজেলাইজেশন নিয়েও কাজ শুরু করে রেল কর্তৃপক্ষ। বিশ শতকের শুরুতে ডিজেল ইঞ্জিনের কর্মদক্ষতায় দ্রুতই বাষ্প ইঞ্জিনগুলোর গুরুত্ব কমতে থাকে আর পঞ্চাশের দশক থেকে উন্নত দেশগুলোতে বিলুপ্ত হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে উদ্ভাবকরাও নতুন নতুন উদ্ভাবনী দিয়ে রেলকে করে যাচ্ছে আরো উন্নত।
ডিজেলাইজেশন, পানি-বৈদ্যুতিক জ্বালানি ব্যবহার, আর এখন তো চোখ মেললেই বুলেট ট্রেনসহ নানা ধরণের আধুনিক ট্রেনের দেখা মেলে। আজকের এই ট্রেন দেখে কে ভাববে কীভাবে শুরু হয়েছিল রেলের যাত্রা! কবির ভাষায় বলতে গেলে রাত দুপুরে ট্রেনের ঝকঝকানিতেই বেলা পার হয়ে যায়, ট্রেনের বাড়ির খোঁজ নেয়ার সময় কোথায়!
উপমহাদেশে রেলের আগমন
উপমহাদেশে রেলের আগমন ঘটে লর্ড ডালহৌসির হাত ধরে ১৮৫৩ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির মাধ্যমে। ১৮৪৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমে হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত সফলভাবে রেললাইন নির্মাণকাজ সমাপ্ত করলে কোম্পানিটি বিভিন্ন রুটে নির্মাণ কাজ শুরু করে দেয় যার ধারাবাহিকতায় ১৮৫৯ সালে কানপুর থেকে এলাহাবাদ, ১৮৬২ সালে হাওড়া থেকে দিল্লি, ১৮৬৬ সালে দিল্লি থেকে আগ্রা এবং ১৮৬৭ সালে এলাহাবাদ থেকে জবলপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হয়।
পুরো ভারতজুড়ে যেন এক নতুন বিপ্লবের সূচনা ঘটে। মূলত নিজেদের স্বার্থে কাজ করলেও ব্রিটিশরা উপমহাদেশে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যা তৎকালীন ভারতবর্ষের জন্য আশীর্বাদই ছিল।
রেললাইনে বাংলাদেশ
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতের কিছু কিছু প্রদেশে রেলপথ নির্মাণ করার ধারাবাহিকতায় ইংরেজরা ১৮৬২ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত প্রথম রেলপথ যাত্রা শুরু হয়। এভাবেই রেললাইনে পা দেয় বাংলাদেশ। প্রথম দিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামক একটি প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে কলকাতা থেকে রানাঘাট এবং পরবর্তীতে রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ চালু করে। কুষ্টিয়ার সেই জগতিই বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন যা আজ শুধুই ধূলিময় স্মৃতি।
এদিকে কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গ ও আসামের যোগাযোগ রক্ষায় পদ্মার উপর হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নির্মাণ করে গেছে ব্রিটিশরা। তবে আক্ষরিকভাবে বাংলাদেশে রেলের সূচনা হয় পাট শিল্পের জন্য। পাট শিল্পের ক্রমবিকাশে রপ্তানি সহজ করতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ অবধি রেলপথ নির্মিত হয়।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Who Invented train. 02. Railroad. 03. The history of railways in Britain: from the first steam trains to the rail revolution.
ভালো পোস্ট। ইনফরমেটিভ।
ইন্ট্রোতে শামসুর রাহমানের* লেখা ব্যবহার করেছেন। ওটা এমন
“ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই। …”