আমাদের সবারই শৈশব কেটেছে টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন দেখে। এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না যার ছেলেবেলায় একবার হলেও এই কার্টুন দেখেনি। বেশিরভাগ মানুষেরই শৈশবকালে টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন ছিল আবেগের অন্য নাম। রঙিন টেলিভিশনে স্কুল ছুটি হলেই সামনে বসে পড়ে যাওয়ার সময়টা ছিল একেকজনের কাছে একটা অন্যরকম ভালোবাসার ব্যাপার। দুরন্ত এক ইঁদুর এবং এক বিড়ালকে দেখা যায় এই কার্টুনে যাদের দুরন্তপনায় সারাক্ষণ মেতে থাকা যেতো।
টম অ্যান্ড জেরি মূলত একটি আমেরিকান অ্যানিমেটেড মিডিয়ার একটি কমেডি সিরিজ; যা ১৯৪০ সালে উইলিয়াম হানা (William Hanna) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। টম অ্যান্ড জেরি সিরিজ যাতে একটি বিড়াল দেখা যায়, যার নাম টম (Tom) এবং একটি ইঁদুর দেখা যায়, জেরি (Jerry)। এই কার্টুনটি মূলত সৃষ্টি করা হয় এনিমেশন মুভি বানানোর উদ্দেশ্যে, একসময় পর্দায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে এটি। টম অ্যান্ড জেরির এই কার্টুনটি নিয়ে আজ জানবো বেশ কিছু মজার ঘটনা।
ছোট থেকে দেখতে দেখতে বড় হওয়া এই কার্টুনের সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বেশ বিরাট এক ইতিহাস। ১৯৩০ সালের দিকে এম. জি. এম অ্যানিমেশন স্টুডিও-এর অংশ ছিলেন গল্পলেখক ও চরিত্র ডিজাইনার উইলিয়াম হানা এবং পরিচালক জোসেফ বারবারা। তারা দুইজন সাধারণত জুটিবদ্ধ হয়ে ছবি পরিচালনা করতেন। তাদের কাজ করা এক মুভি রিলিজ হয় যাতে এক বিড়াল ও একটি ইঁদুরের খুনসুটি উঠে আসে। মুভিটির নাম ছিল ‘পুস গেটস দ্য বুট।’
এটির কাজ শেষ হয় ১৯৩৯ সাল নাগাদ, এবং থিয়েটারে প্রদর্শিত হয় এর ঠিক একবছর পর অর্থাৎ ১৯৪০ সালে। কিন্তু তখন পাল্লা দিয়ে এম. জি. এমেরির এক কার্টুনের কাছে হেরে যায়; যার ফলে আর্টস এন্ড সায়েন্সের পক্ষ থেকে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট শর্ট সাবজেক্ট কার্টুনস পুরস্কার পেয়েও হাল ছেড়ে দেয়ার উপক্রম হয়।
আর তাই হানা এবং বারবারার প্রচেষ্টায় নতুন করে এক কার্টুনের সৃষ্টি হয় যার নামকরণ করা হয় টম অ্যান্ড জেরি নামে, যার নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাদের, এ যেন এক ইতিহাসের অনন্য গল্প!
একসময় সেই স্টুডিওতে এক কার্টুন তৈরি করা হয় যার নাম ছিল ‘ক্যাপ্টেন এন্ড দ্যা কিডস’ (Captain and the Kids)। কিন্তু এই কার্টুনটি দিয়ে তারা সুবিধা করে উঠতে পারেনি, স্টুডিওতে নেমে আসে এক প্রকার ধ্বসের সম্ভাবনা। হানা এবং বারবারা তখন সিদ্ধান্ত নেন এই কার্টুনের প্ল্যানিং থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের অভিনব চিন্তার প্রসার ঘটতে শুরু করে তখন।
আর ঠিক তখনই হানা এবং বারবারা দুইজন মিলে এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলেন। খুব বেশি সময় নেননি তারা, সৃষ্টি করেন কালজয়ী এক কার্টুন, যার কথাই আমরা এতক্ষণ পড়ে বা জেনে আসছি। যদিও এর আগে ‘পুশ গেটস দ্য বুট’ (Puss Gets the Boot) নামে একটি কার্টুন বানানোর প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি হানা এবং স্টুডিও-এর অন্যান্য সহকর্মীদের পছন্দ হয়নি বলে জানান। তাদের ভাষ্যমতে এটি তেমন একটা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু একসময় এটি থিয়েটারে চলে আসলেও ইঁদুর বেড়ালের দৌর খুব একটা গতি করতে পারেনি।
হানা এবং বারবারা একসময় এর দর্শক হারাতে লাগলেন। পরবর্তীতে হানা এবং বারবারা এই কার্টুন থেকে অনেকটাই সরে আসেন। মন দেন অন্য জগতে, অন্য এক কার্টুন তৈরির নেশায়। যখন থেকে টম অ্যান্ড জেরি পর্দায় চলে আসলো সবাই এর চরিত্র টম এবং জেরির দুরন্তপনায় বিমুগ্ধ হয়ে যান। কিন্তু তখন ঘটে অন্য এক বিপত্তি!
নাম তো আর পছন্দ হয় না। এম জি এম স্টুডিও-এর প্রযোজক ফ্রেড কুইম্বলি একদিন তার স্টুডিওতে আসার আহবান জানান হানা আর বারবারাকে। তিনি তাদের জানান, এই ইঁদুর বেড়ালের কার্টুন নিয়ে একটি সিরিজ বানালে কেমন হয়? তার এই কথায় রাজী হয়ে যান দুজনই। এবং সিদ্ধান্ত নেন এই কার্টুন নিয়েই তারা সিরিজ বের করবেন।
যদিও তাদের এই কার্টুনের নামটি পছন্দ হচ্ছিলো না, আর তাই স্টুডিওতেই আয়োজন করা হয় কার্টুনটির নতুন নামকরণের আয়োজন। সেই প্রতিযোগিতাতেই অ্যানিমেটর জন কার প্রথম টম অ্যান্ড জেরি নামটির প্রস্তাব দেন এবং তা সাথে সাথেই গ্রহণ করা হয়। জানা যায়, এই নামকরণের জন্য তাকে প্রায় ৫০ ডলার পুরষ্কার দেয়া হয়। আর সেই বছরই স্টুডিওতে প্রোডাকশনে যোগ হয় টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনটি।
টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের জন্য গল্প লিখতে শুরু করেন এবং এর পরিচালনা করতে থাকেন হানা। একটি বিড়াল সারাক্ষণ এক ইঁদুরের পেছনে ছুটছে প্রথমে বেশ মজার মনে হলেও পরবর্তীতে তা অনেকটাই বোরিং মনে হতে লাগলো তাদের কাছে। বারবারা খুঁজতে লাগলো ভিন্নতা। এবং এই ভিন্নতা খুঁজার উদ্দেশ্যেই বেশ কিছু চমৎকার গল্প খুঁজে পেলো সে, যা বারবারা বেশকিছু শর্টফিল্ম তৈরি করতে আগ্রহী হন।
গল্প লেখা চলতে থাকলে বারবারা এবং হানা বুঝতে পারলেন তাদের এই শর্টফিল্ম কার্টুন জগতে বেশ ভালো একটি জায়গা করে নিচ্ছে। দুর্দান্ত এই কার্টুন সিরিজটি সৃষ্টির পর তাদের আর স্টুডিওতে অন্য কার্টুন নিয়ে আর ভাবতে হয়নি, অ্যানিমেশন জগতে বিশাল খ্যাতি লাভ করতে খুব একটা সময় লাগেনি হানা এবং বারবারার।
তবে কার্টুনে এই দুটো প্রধান চরিত্র বাদে কিন্তু আমরা বেশ কিছু চরিত্রও দেখা পাই এই কার্টুনে। টমের বেশকিছু কাজিন ছাড়াও টমের এক কুখ্যাত বন্ধু যে প্রায়ই টমের মতই জেরিকে তাড়া করে বেড়াতো।
তার বাড়িতে থাকা এক মধ্যবয়সী নারী, যার ভয়ে টমকে বেশ নাজেহাল অবস্থাতেই দেখতে পাই আমরা। এছাড়া টমের সেই বাড়িতে সামনে থাকা এক রাগী বুলডগ, যে নাকি কিছু হলেই টমকে ভয় দেখিয়ে শায়েস্তা করতো। ছোট্ট জেরির এক ভাইকে আমরা দেখতে পাই যার দুষ্টুমিতে খিলখিল করে হেসে উঠা ছাড়া উপায়া নেই। যেকোনো বন্ধের দিন কিংবা ক্রিসমাসের ছুটিতে এই ভাইটিকে দেখা যেতো জেরির কাছে বেড়াতে আসতে।
বেড়াতে আসা ভাইও কিন্তু রেহাই পায়নি টমের আক্রমণ থেকে! আর এইসব অন্যান্য চরিত্র যেন এই কার্টুনকে আরও মজার এবং উপভোগ্য করে তুলেছিল আমাদের মাঝে।
১৯৪০ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২০২২ সালে বেশকিছু শর্টফিল্ম পর্দায় দেখা গেছে। ১৯৪০ সালে পুস গেটস দ্য বুটস পর্দায় আসার পর চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়ন পেয়েও কোনো পুরষ্কার লাভ করতে পারেনি। এর পরের বছর ১৯৪১ সালে পর্দায় উঠে আসে ‘দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস।’ ১৯৪৩ সালে ‘দ্য ইয়াঙ্কি ডুড মাউস’ কার্টুনটি সেরা এনিমেটেড কার্টুন হিসেবে পুরষ্কার লাভ করে। এরপর একটানা পুরষ্কার লাভ করে মাউস ট্র্যাবল, কোইয়েট প্লিজ, দ্য ক্যাট কনসার্টো। যার সৃষ্টি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত।
এছাড়া, আরো যেসব শর্টফিল্ম পর্দায় আসে তা হল: দ্যা লিটল অরফান, দ্যা টু মাউস্কিটারস ইয়োহান মাউস, ড. জেকিল অ্যান্ড মি. মাউস, হেচ আপ ইয়োর ট্রাবলস, জেরিস কাজিন, তুসে পুশি ক্যাট ইত্যাদি। এসব শর্টফিল্ম ছাড়াও বেশকিছু টিভিশো সৃষ্টি করা হয়। সর্বশেষ এই কার্টুনটির একটি মুভি মুক্তি পায় ২৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে।
বেশকিছু কারণেই টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনটি এক প্রকার ধ্বসের মুখে পড়েছিল। কিন্তু হানা এবং বারবারার প্রচেষ্টায় ফের দর্শকপ্রিয়তা পান তারা। সারা বিশ্বের মানুষের শৈশবকালকে মাতিয়ে রাখা এবং উপভোগ্য করে তোলার জন্য এই হানা এবং বারবারার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই যায়!
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Tom and Jerry. 02. The Untold Truth of Tom and Jerry.