পানির নিচে চলাচল করতে সক্ষম এক বিশেষ ধরনের জলযানকে সাবমেরিন বলে। সাবমেরিনকে সংক্ষেপে সাবস বলা হয়ে থাকে। সাধারণত সামরিক বাহিনীতে এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজে সাবমেরিন ব্যবহার করা হয়। সামরিক সাবমেরিন তূলনামূলক অনেক বড় হয়ে থাকে। সামরিক বাহিনী সাগরের জলে টহল দিতে এবং যুদ্ধের সময় শত্রুর জাহাজকে আক্রমণ করতে সাবমেরিন ব্যবহার করে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাবমেরিনের বহুল ব্যবহারের পর থেকে, এটি নৌ-যুদ্ধের অত্যাবশকীয় একটি অংশ হয়ে উঠেছে। যদিও সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে কিছু গুটিকয়েক মানুষই সাবমেরিনের সংস্পর্শে আসতে পেরেছে। তবে, সবাই কম-বেশি সিনেমা এবং টিভি শোগুলোতে সচারাচর সাবমেরিন দেখেছেন।
কয়েকশো বছর আগেও সাবমেরিন নিয়ে মানুষের ধারণা ছিল নিতান্তই অমূলক এবং প্রায় অচিন্তনীয়। স্বাভাবিকভাবেই এর বাস্তব রূপদান প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত জটিল। ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ সাবমেরিনের ডিজাইন করেছে, চেষ্টা করেছে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে এবং যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে। তবে ব্যর্থতাই সফলতায় রূপ নিয়েছে সাবমেরিন হয়েছে আবিষ্কার। এটি ছিল গত শতাব্দীতে হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে একটি।
সাবমেরিনের প্রাথমিক ধারণা
সাবমেরিনের ইতিহাস ঘাটতে গেলে আমাদের পনেরশো-এর দশকে ফিরে যেতে হবে, যখন লিওনার্দ্যো দ্য ভিঞ্চি প্রথম একটি নৌকার ধারণা করেছিলেন যা জলের নীচে চলাচলে সক্ষম এবং যা অন্য জাহাজগুলিকে ডুবিয়ে দিতে পারে। কিন্তু, দ্য ভিঞ্চি কখনোই তার সাবমেরিন ডিজাইনের পথে এগিয়ে যান নি। কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তার আবিষ্কার বিশ্বে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথম ব্যবহারিক সাবমেরিনটি ১৬২০ সালে রাজা প্রথম জেমস-এর অধীনে কর্নেলিস ড্রেবেল দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল একটি চামড়া-আচ্ছাদিত সাবমেরিন। ড্রেবেলের তৈরি সাবমেরিনটি জলের চাপ সহ্য করার জন্য লোহা দিয়ে শক্তিশালী করা হয়েছিল এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এটি কর্মক্ষম ছিল। টেমস নদীর তলদেশে পনের ফুট গভীরতায় এই জলযানটি চলাচল করতে সক্ষম ছিল।
প্রথম সামরিক সাবমেরিন
সামরিক কাজে ব্যবহৃত প্রথম সাবমেরিন ছিল দ্য টার্টল। যা আমেরিকান বিপ্লবে মোতায়েন করা হয়েছিল। ১৭৭৫ সালে ডেভিড বুশনেল দ্বারা নির্মিত দ্য টার্টল সাবমেরিনটি ছিল ৭ ফুট লম্বা এবং সাড়ে ৫ ফুট চওড়া। এটির আকৃতি ছিল অনেকটা আখরোটের মতো। সাবমেরিনটি একজন ব্যক্তি দ্বারা সঞ্চালন করার মতো করে ডিজাইন করা হয়েছিল। এটি আধা ঘন্টা পর্যন্ত বিশ ফুট গভীরতায় নিমজ্জিত হয়ে থাকতে পারতো।
এই সাবমেরিন ডিজাইনে ওক কাঠ ব্যবহার হয়েছিল এবং এর পিতলের পাম্পগুলি একটি সিরিজের মাধ্যমে কাজ করতো যা জলগ্রহণ এবং নিষ্কাশনের কাজ করেছে। নিউইয়র্ক বন্দরে ব্রিটিশ জাহাজের অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করাই ছিল এটির প্রথম কাজ। একটি ১৫০ পাউন্ডের বোমাকে জাহাজের সাথে বেঁধে রাখার জন্য দ্য টার্টল ব্যবহার করার কথা ছিল যদিও সেই প্রচেষ্টা পরে ব্যর্থ হয়েছিল।
স্টিম পাওয়ারের আবির্ভাব
১৮৮০ এর দশকের প্রথম দিকে, সুইডিশ উদ্ভাবক থর্স্টেন নর্ডেনফেল্ড প্রথম বাষ্প চালিত সাবমেরিন তৈরি করেছিলেন। নর্ডেনফেল্ড-তিন, ৫০ ফুট গভীরতায় নিমজ্জিত হতে পারতো এবং এর গতিসীমা ছিল ঘন্টায় ১৪ মাইল। জলের নিচে টর্পেডো ফায়ার করা প্রথম জাহাজ নর্ডেনফেল্ড-তিন এর দুইটি একই রকম দেখতে টর্পেডো টিউব ছিল।
প্রথম সফল আমেরিকান সাবমেরিন
গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার দশ বছর পর, আইরিশ বংশোদ্ভূত জন হল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাবমেরিন ডিজাইন ও নির্মাণ শুরু করেন। হল্যান্ড ১৮৭৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কাছে তার প্রথম সাবমেরিন ডিজাইন জমা দেয়, যা সেই সময়ে ব্যবহারের অযোগ্য বলে বাতিল করা হয়েছিল। এই প্রত্যাখ্যানটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে, হল্যান্ড নতুন উদ্যমে পুনরায় ডিজাইন করে শুরু করেন।
১৮৮৮ সালের মধ্যে মার্কিন নৌবাহিনী শেষমেশ তার সাবমেরিনের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয় এবং একটি নতুন ডুবো জাহাজের জন্য একটি নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। হল্যান্ড সেই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে এবং পাঁচ বছর পরে সাবমেরিন প্লাঞ্জার নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু, প্লাঞ্জার নিয়ে কিছু অসুবিধা উদ্ভুত হবার কারণে হল্যান্ড আরেকটি সাবমেরিনের কাজ শুরু করে যার নাম তিনি হল্যান্ড-চার রাখেন।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে সাবমেরিন উন্নয়ন
ব্রিটেন এবং জার্মানি বিশ শতকের গোড়ার নৌ অস্ত্র প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, যেটা চলছিল সারফেস জাহাজ এবং সাবমেরিনের ক্ষেত্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই সাবমেরিন তার কৌশলগত নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারতো। কারণ হিসেবে দেখা যায়, জার্মান সাবমেরিগুলোর সহজেই যুদ্ধজাহাজ এবং যাত্রীবাহী জাহাজ উভয়ই ডুবিয়ে দেবার সক্ষমতা ছিলো একটি একক টর্পেডো দিয়ে।
যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে এগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মডেল U-53 দুইশ ফুট দৈর্ঘ্যে পৌঁছেছিল, যা অন্যান্য জাহাজের তুলনায় একটি উচ্চতর রেঞ্জসহ দুটি মাঝারি-ক্যালিবার ডেক বন্দুক বহন করতে পারতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: সাবমেরিনের কৌশলগত প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকেই সাবমেরিন তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছিল। ১৯১৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর আবুকির, হোগ এবং ক্রেসি নামের তিনটি ব্রিটিশ ক্রুজার জার্মানির U-9 সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয়। ক্রুজারে থাকা প্রায় ২,৩০০ জনের মধ্য থেকে ১,৪০০ জনের আর কোনো খোঁজ পাওযা যায়নি। মাত্র ছয়টি টর্পেডোর সাহায্যে U-9 তিনটি ক্রুজারকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সাবমেরিনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কানার্ড লাইনের লুসিতানিয়া। ১৯১৫ সালের ৭ মে এটি আইল্যান্ডের কিনসেলের কাছে U-20 এর সম্মুখীন হয়। একটি একক টর্পেডো দিয়ে জার্মান সাবমেরিনটি একশো জনের অধিক আমেরিকান যাত্রীবাহী এই লাইনারটিকে ডুবিয়ে দেয়।
যেটা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক বিষয়, কারণ তখন পর্যন্ত ধারণা করা হতো ১৫ নটের চেয়ে দ্রতগামী কোন জাহাজ সাবমেরিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। লুসিতানিয়া যখন টর্পেডোর শিকার হয় তখন এর গতি ছিল ঘন্টায় ১৮ নটিক্যাল।
ইন্টারওয়ার জাপানিজ সাবমেরিন ফ্লিট
ইন্টারওয়ার যুদ্ধকালীন সময়ে, জাপান একটি বৈচিত্র্যময় সাবমেরিন বহর তৈরি করেছিল। কোনটা উড়োজাহাজ আবার কোনটা মালামাল বহন করতো। উচ্চমানের টর্পেডো ব্যবহার করা হয়েছিল এসব সাবমেরিনগুলোতে। অক্সিজেনের সাহায্যে চালিত টাইপ ৯৫ এর ডাকনাম ছিল লং ল্যান্স।
জাপানি সাবমেরিনের আকারগুলো ভীষণ বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে কিছু মিডজেট সাবমেরিন আবার একজন ক্রু দ্বারা পরিচালিত হতো। কিছু ছিল মাঝারি বা দূরপাল্লার সাবস যেগুলোর আবার যুদ্ধের সময়ে দ্রুততম গতিতে নিমজ্জনের সক্ষমতা ছিল। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজের পরিবর্তে শত্রুর যুদ্ধজাহাজ আক্রমণ করার সিদ্ধান্তের কারণে, জাপানি সাবমেরিনগুলি মূলত অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিনের তুলনায় জাপানিজরা এক-চতুর্থাংশেরও কম মার্চেন্ট শিপিং ডুবাতে পেরেছিল। বস্তুত, রাডারের অভাব জাপানি সাবমেরিন যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাবমেরিন
১৯৩০-এর দিন দশকে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর, নতুন করে জার্মান নৌবাহিনীকে পুনরায় সজ্জিত করা শুরু করেন এবং আরো শক্তিশালী সাবমেরিন তৈরিতে মনোযোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ডুবে যাওয়া কিংবা আত্মসমর্পণ করা ৩৬০টি সাবস এর বিপরীতে তিনি নতুন ইউ-বোট তৈরির নির্দেশ দেন। যার ফলশ্রুতিতে কুখ্যাত ইউ-বোট হয়। U-300 সম্পূর্ণ নিমজ্জিত অবস্থায় উনিশ নটে পৌঁছতে পারতো।
পারমাণবিক সাবমেরিন
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে নৌ অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই নতুন সাবমেরিনগুলির ভ্রমণ করার ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেশি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবমেরিনগুলোর তুলনায় বেশি সময় ডুবে থাকতে পারে। সাথে সাথে এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন সাবমেরিনগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড দিয়ে সজ্জিত এই সাবমেরিনগুলি প্রায়শই সপ্তাহ বা এমনকি মাস ধরে সমুদ্রে থাকতে পারে। এসব সাবমেরিন সাধারণত সমুদ্র স্ক্যান করে থাকে শত্রু জাহাজের তৎপরতা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে। নিউক্লিয়ার সাবমেরিনগুলি আজও ব্যবহার করা হচ্ছে, এদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ইউকে ট্রাইডেন্ট সিস্টেম। পারমাণবিক সাবমেরিন বর্তমান সময়ে অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এটি মেরিন সেক্টরের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সাবমেরিনের ভবিষ্যৎ
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন এবং সমুদ্র, স্থল এবং মহাকাশ প্রযুক্তি একুশ শতকে সাবমেরিনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ভবিষ্যতে, ক্রু-বিহীন সাবমেরিনও আসতে পারে, যেগুলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে তথ্য পাঠাবে দূরবর্তী সামরিক ঘাঁটিতে তথ্য বিশ্লেষণের জন্যে।
Feature Image: navalpost.com References: 01. Evolution of the Submarine. 02. History of The Submarine. 03. Submarine Development - A Short History.