স্টোনহেঞ্জ: প্রাচীনযুগের মান মন্দির নাকি পাথুরে এক ভাস্কর্য

849
0

ইতিহাস এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রচীন স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে কয়েকটি হাতেগোনা স্মৃতিস্তম্ভর নাম সামনে আসে – স্টোনহেঞ্জ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে হয়তো সব থেকে প্রাচীন আর প্রাগৈতিহাসিক এক স্মৃতিস্তম্ভ, এই স্টোনহেঞ্জ। যা ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারের সালিসবারি সমভূমিতে পাওয়া যায়।

অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, আমাদের পূর্বপুরুষের নির্মানকৃত স্টোনহেঞ্জ বিশ্বের সব থেকে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ এবং বড় রহস্যগুলির মধ্যে একটি। তবে এটি কি স্মৃতিস্তম্ভ নাকি মান মন্দির নাকি শুধুই এক পাথুরে ভাষ্কর্য – এই নিয়ে আছে নানাজনের নানান মত; আবার বিতর্কও বটে। আর আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু এই স্টোনহেঞ্জ। তাহলে চলুন ঘুরে আসি ইতিহাসের পাতা থেকে।

stonehenge
রহস্যময় স্টোনহেঞ্জ। Image Source: unsplash.com

শুরুর কথা

গতকাল আজকের ইতিহাস। আর আজ যা বর্তমানকাল তা ইতিহাস হবে আগামীকাল, এটাই চিরাচরিত নিয়ম। আর ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে রহস্যময় ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আসে তখনই যখন খোঁজ করা হয় এর নির্মাতার। আসলে কে বানিয়েছেন এই ইতিহাস? কিংবা কি ভেবে বানিয়েছিলেন সে বা তারা?

লোককাহিনী অনুসারে, আর্থারিয়ান কিংবদন্তি মারলিন একটি বিশাল দৈত্যদল তৈরি করেছিলেন। যাতে তিনি এই স্টোনহেঞ্জ পৃথিবীর বুকে স্থাপন করতে পারেন। তাদের মতে, স্টোনহেঞ্জ এর পাথরগুলো এই দৈত্যরাই আয়ারল্যান্ডের কোন একটি স্থান থেকে একত্র করে এই ভাস্কর্য নির্মাণ করে। আবার অনেকের মতে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মান মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

স্টোনহেঞ্জ আসলে দেখতে কেমন ও অন্যান্য 

স্টোনহেঞ্জ আসলে একটি সুবিশাল পাথরের কাঠামো; যা একটি বৃত্তাকার ভাবে খুবই শক্তপোক্তভাবে ভূমির সাথে আটকে আছে। ধারনা করা হয়, সময়ের সাথে সাথে এর কাঠামোরও পরিবর্তন হয়েছে। কারণ প্রাচীনতম নিদর্শন হলেও পরবর্তীতে এটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। স্টোনহেঞ্জ দেখতে অনেকটা ঘোড়ার পায়ে নিচে পড়ানো লোহার বের বিশেষের মতো; যার আকৃতি অনেকটাই ইংরেজি অক্ষর “U” এর মতোই।

স্টোনহেঞ্জ ওই সময় এমন একটি বিশেষ এলাকায় নির্মান করা হয়েছিল যা তৎকালীন সময়ের মেসোলিথিক এবং নিওলিথিক সম্প্রদায়দের দ্বারা। তবে ধারনা করা হয়, এটি প্রাচীন ব্রিটিশরা নির্মাণ করছিলেন। ধারনা করার মূল কারণ হলো স্টোনহেঞ্জ এর কাছে সমাহিত করা মৃতদেহের ডিএনএ। যা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এর কিছু নির্মাতা ইংল্যান্ডের বাহিরের স্থান যেমন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় থেকে এখানে এসেছিলেন।

পাখির চোখে স্টোনহেঞ্জ। Image Source: britannica.com

আবার অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, স্টোনহেঞ্জ খ্রীস্টপূর্ব ৪৬০০ সালের সময় এসে মৃত্যু-পরবর্তী কর্মের অর্থাৎ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হতো। আবার অনেকের মতে, স্টোনহেঞ্জ এলাকায় এক সময় ধর্মচর্চার ভিন্নতা নিয়ে কাজ করা হতো। এসব কিছু আলাদা করে রাখলে স্টোনহেঞ্জ এর আসল নির্মাতার কোন সঠিক প্রমান এখন অব্দি পাওয়া যায় নি। তবে যুগে যুগে এর সংস্করণ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের দ্বারা এবং ব্যবহার করা হয়েছে এই স্টোনহেঞ্জ তা নিশ্চিতভাবে বলাই যায়।

এই স্টোনহেঞ্জ নিয়ে দুই ধরনের মন্তব্য অনেক আগে থেকেই শোনা যায়। যাদের একদল মনে করেন এটি আগের থেকেই একটি পবিত্র স্থান। আবার অনেকে মনে করেন প্রাচীন কাল থেকেই এটি একটি বৈজ্ঞানিক মানমন্দির এর প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। স্টোনহেঞ্জ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, আকাশের তারার সাথে চিহ্নিত প্রান্তিকরণগুলো সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের মতো জ্যোতিবিদ্যা সংক্রান্ত ঘটনাগুলো ভবিষ্যৎবানী করতে একটি মেগালিথিক বর্ষপঞ্জি হিসেবে ব্যবহৃত করা যায় যেন।

মানচিত্রে স্টোনহেঞ্জ। Image Source: britannica.com

তৈরির সময়কাল এবং বিবিধ

ইংরেজ প্রত্নতাত্তিক উইলিয়াম স্টুকেলি এর মতে, স্টোনহেঞ্জ বেশ কিছু ধাপে নির্মাণ করা হয়েছিল। তার এই তাত্ত্বিক মতামত ১৮ শতকের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। তার রচিত একটি লিখিত তত্ত্ব মতে, স্টোনহেঞ্জ এর পুরো নির্মাণকাজ সম্পূর্ন হয়েছিল মোট ছয়টি ধাপে। যার সব থেকে প্রাচীন অংশ নির্মিত হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০-২৯৩৫ এর সময়কালে।

জন অব্রের নামে মিল রেখে ৩৩০ ফিটের একটি বৃত্তে ৫৬টি অব্র গর্ত করা হয়। বৃত্তের খাদটিতে একটি উচ্চ ব্যাংক এবং একটি নিম্ন ব্যাংক দ্বারা বাইরের তীর এবং ভিতরের তীর আবদ্ধ করে রাখা হয়। আর এই অব্রের গর্তের গভীরতা ছিল যথাক্রমে ২৭০, ৩০০, ৩৩০ এবং ৩৬০ ফুট করে। এছাড়া, এই খাদগুলো পূরণ করতে ওই সময়ের শতাব্দী পুরনো অ্যান্টলার পিক ব্যবহার করা হয়েছে। বৃত্তাকার এই ঘেরটির দুইটি প্রবেশপথ ছিল। যার একটি প্রধানপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর অন্য আরেকটি সঙ্কীর্ণ পথ যা স্থাপনাটির দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।

Stonehenge
স্টোনহেঞ্জের বিস্তারিত চিত্র। Image Source: britannica.com

স্টোনহেঞ্জ ৩০০০ খ্রীস্টপূর্বের সমসাময়িককালে সবচেয়ে আলোচিত কবরস্থান ছিল। যার প্রমান বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক তাদের লিখিত বই বা সাময়িকীতে লিখে গেছেন। এছাড়া, স্টোনহেঞ্জ রিভারসাইড প্রকল্পের খনন এবং সংরক্ষণাগার গবেষনা থেকে জানা যায় যে, ওই ৫৬টি গর্তের প্রায় সবগুলোতে শ্মশান পাওয়া গেছে। এই এলাকার প্রায় ১৫০-২০০টি শ্মশানের মধ্যে একুশ শতকের প্রথম দশকে ৬৪টি শ্মশান খনন করা হয়েছিল; যেগুলোতে বেশিরভাগ শ্মশানেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের অপূর্ণ হারের খোঁজ পাওয়া গেছে।

বর্তমানে যে ৪৫টি ব্লুস্টোন স্টোনহেঞ্জ-এ দেখা যায়, তার বেশরভাগগুলোই দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের ওয়েলসের থেকে আনা হয়েছিল বলে ধারনা করা হয় এবং বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী যা প্রমানও হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে খ্রীস্টপূর্ব ২৬৪০-২৪৮০ সালের মধ্যে স্টোনহেঞ্জ এর সারসেন পাথরগুলো উত্তরে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরের মার্লবোরে ডাউনসের আলভেরি থেকে আনা হয়েছিল।  এবং পাথরগুলো স্টোনহেঞ্জ এর উত্তর-পূর্ব দিকের প্রবেশপথের বাহিরে সারসেন হাতুরি দিয়ে আঘাত করে পাঁচটি লম্বা ট্রিলিথন আকৃতির করে সাজানো হয়েছিল। বেশিরভাগ সারসেন আপরাইটের ওজন প্রায় ৪৫ টন এবং উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট ছিল এবং ট্রিলিথনের উপরের অংশগুলো ২৫ ফিট এবং উচ্চতা ৩২ ফুটের মতো ছিল।

তৃতীয় স্টেজ থেকে ষষ্ঠ পর্যায়ের কাজ খ্রীস্টপূর্ব ২৪৭০ থেকে ১৫২০ পর্যন্ত চলেছিল। ২৪৭০ থেকে ২২৮০ এর মাঝামাঝি সময়ে স্টোনহেঞ্জ থেকে ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ খনন করা হয়েছিল অ্যাভন নদী পর্যন্ত। ব্লু স্টোনহেঞ্জ থেকে Q এবং R গর্তগুলোতে সরানো ব্লুস্টোনগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়। সরানোর রাস্তার প্রশস্থতা ছিল ৬০ ফুট থেকে ১১৫ ফিট, ধারনা করা হয়। এছাড়া, ২০০৮ সালে খনন করে দেখা গেছে ভুরিটং ওয়ালে ৫৬০ ফিট প্রায় একটু একই রকম পথের খোঁজ পাওয়া যায়; যা প্রায় ২৫০০ খ্রীস্টপূর্ব পর্যন্ত ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়। এদিকে ১৬৪০ এবং ১৫২০ খ্রীস্টপূর্ব এর মধ্যে ষষ্ঠ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের স্মৃতিস্তম্ভ এর কাজ ওয়াই হোমস নামে দ্বিতীয় বলয় খনন করে রেডিওকার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে শনাক্ত করা গেছে।

স্টোনহেঞ্জের জ্যামিতিক নকশা। Image Source: britannica.com

শেষ কথ

সব মিলিয়ে স্টোনহেঞ্জ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পাথর সমাবেশের বৃত্ত ন্যায় একটি প্রাগৈতিহাসিক অতীত। প্রায় প্রতি বছর এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই ইতিহাস দেখতে চলে আসে। শতাব্দী বদলের সাথে সাথে প্রায়শই এই প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস নিয়ে মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্টোনহেঞ্জ। একেকজনের মতে, এটি শুধুই একটি পাথর সমাবেশের অংশ। অনেকের মতে প্রাচীন কবরস্থান। অনেকের মতে মানমন্দির।

তবে যাই হোক না কেন, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ এর কখনই কমতি ছিল না। সম্প্রতি ২০১৩ সালে বিলম্বিত একটি প্রস্তাব পাশ হয় যেখানে নতুন দর্শনার্থী কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রাচীন ইতিহাস আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির প্রতি সংযোগ সৃষ্টি করে, আমাদের পূর্বপুরুষের উপর জানার স্পৃহা সৃষ্টি করে। সব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এটি শুধুমাত্র পাথরে কোন ভাস্কর্য নয়। আবার মানমন্দিরও নয়। অনেক ইতিহাসের সাথে এর সম্পৃক্ততা এর রয়েছে। তবে বিশাল পাথরের ভাঁজে সত্য লুকিয়ে দম্ভ নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে স্টোনহেঞ্জ।

 

Feature Image: David Goddard/Getty Images/history.com
তথ্যসূত্র:
  1. Stonehenge.
  2. National Geographic – Stonehenge.
  3. The British Museum.