ডিভিডির রিপ্লেসমেন্ট নেটফ্লিক্সের যাত্রা শুরু হলো যেভাবে

354
0

অনলাইনে মুভি ও সিরিজ দেখার খুব জনপ্রিয় একটি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে নেটফ্লিক্স। অবসর সময়ে মুভি কিংবা সিরিজ দেখার জন্য অনেকেই নেটফ্লিক্সকে বেছে নেয়। নেটফ্লিক্সকে ধরে নেওয়া হয় ডিভিডির রিপ্লেসমেন্ট। তুমুল জনপ্রিয় অনলাইন মুভি, সিরিজ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের যাত্রার শুরুর দিকের গল্প নিয়েই আজকের এই আয়োজন। 

নেটফ্লিক্সের গোড়াপত্তনের আইডিয়া

১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার স্কট ভ্যালিতে রিড হ্যাশটিং এবং মার্ক র‍্যান্ডলফের হাত ধরে নেটফ্লিক্সের যাত্রা শুরু হয়। শুরুর গল্পটি কিন্তু বেশ মজার। শুরুতেই নেটফ্লিক্স অনলাইন মুভি ও সিরিজ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ছিলনা। ১৯৯০ সালে রিড হ্যাশটিং এবং মার্ক র‍্যান্ডলফ Pure Software নামে তার নিজের প্রথম কোম্পানি চালু করেন। এর লভ্যাংশ থেকেই নেটফ্লিক্সের জন্ম। 

নেটফ্লিক্সের জনক রিড হ্যাশটিং এবং মার্ক র‍্যান্ডলফ ; Image Source: businessinsider.com

তৎকালীন সময়ে ভিডিও দেখার জন্য VHS (Video Home System) ব্যবহার করা হতো। ভিএইচএস টেপ বিক্রি করা এবং ভাড়া দেওয়া খুবই ব্যয়বহুল ছিল এছাড়াও এটি আকৃতিতে বড় ছিল। ১৯৯৭ সালের অগাস্টের কোন এক তপ্ত দুপুরে মার্ক এবং রিড সান্তা ক্রুজের লোগোস বুকস অ্যান্ড রেকর্ডসে যায় এবং প্যাটসি ক্লাইনের সেরা হিটগুলির একটি সিডি কিনেছিলেন। 

পরবর্তীতে এই সিডি থেকে গান গুলো একটি কম্প্যাক্ট ডিস্কে ট্র্যান্সফার করে সেই কম্প্যাক্ট ডিস্ক  রিডের বাড়িতে মার্ক মেইল করেন যা ছিল বেশ সাশ্রয়ী একটি উপায়। যখন ডিস্কটি অক্ষত অবস্থায় রিডের বাড়িতে আসে, তারা এই আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে এবং অনলাইনে সিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা শুরু করে। 

যদিও এটাও শোনা যায় যে, একবার রিড হ্যাশটিং একটি সিডি ভাড়া নিয়ে তা ফেরত দিতে দেরি করায় ৪০ ডলার জরিমানা গুনেছিলেন এবং এখান থেকেই নেটফ্লিক্স চালু করার আইডিয়া তিনি পেয়েছেন। ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৮ সালে ৩০ জন কর্মচারি এবং ৯২৫ টি এনটাইটেল নিয়ে ব্যবসার জন্য পুরোপুরি ভাবে চালু করা হয়। 

যেভাবে মুভি ভাড়া দিত নেটফ্লিক্স 

শুরুতে নেটফ্লিক্স অনলাইনে মুভির সিডি ভাড়া দিত ৷ মুভি প্রতি ভাড়া প্রায় ৪ ডলার করে সাথে ২ ডলারের মেইল চার্জ দিতে হত। ওয়েবসাইটে মুভি অর্ডার করতে হত এবং ডাকযোগে ডিভিডি পেত। মুভি দেখা শেষে, তারা প্রদত্ত খামে নেটফ্লিক্সে পুনরায় ডিভিডি ফিরিয়ে দিত৷ সেই সময়ে, যাদের বাড়ির কাছে ভিডিও সিডি ভাড়ার দোকান ছিল না তাদের জন্য এটি একটি আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল। 

পরবর্তীতে নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন মডেলে স্যুইচ করে। এই মডেলের সাহায্যে, গ্রাহক যতক্ষণ খুশি ডিভিডি রাখতে পারে তবে ফেরত দেওয়ার পরে শুধুমাত্র একটি নতুন মুভি ভাড়া নিতে পারে। 

আমাজনের নজর নেটফ্লিক্সে 

১৯৯৮ সালে আমাজনের তৎকালীন সিইও জেফ বেজোসের সাথে রিড এবং মার্ক দেখা করেন। জেফ ১৪ থেকে ১৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে নেটফ্লিক্স কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। অ্যামাজনের তুমুল জনপ্রিয়তার জন্য একে প্রতিযোগী হিসেবে ভয় পেত নেটফ্লিক্স। মার্ক র‍্যান্ডলফ এই প্রস্তাবকে ন্যায্য বলে মনে করেছিলেন কিন্তু রিড হ্যাশটিং যিনি কোম্পানির ৭০% শেয়ারের মালিক, তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে অ্যামাজনের আর নেটফ্লিক্স কেনা সম্ভব হলো না।  

হঠাৎ বিপর্যয় 

নেটফ্লিক্সের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল কিন্তু এরমধ্যে নেমে এলো এক বিপর্যয়- ডট কম বাবল বিপর্যয়। বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানি যারা সেই যুগে একটি আইপিও পরিচালনা করেছিল তারা দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল বা অন্য কোম্পানিগুলো তাদের কিনে নিচ্ছিল। এই বিপর্যয়ে নেটফ্লিক্সের উপরেও বেশ মারাত্মক প্রভাব পড়ে। 

২০০০ সালের দিকে নেটফ্লিক্স লসের মুখে পড়ে। রিড এবং মার্ক নেটফ্লিক্স বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ব্লকবাস্টার এলএলসিকে ৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে চায়। ব্লকবাস্টারের সিইও জন অ্যান্টিওকো এই প্রস্তাব খুবই তাচ্ছিল্যার সাথে প্রত্যাখ্যান করে বলেন,

ডট-কম হিস্টিরিয়া সম্পূর্ণরূপে অপ্রতিরোধ্য। 

যদিও পরবর্তীতে এই ব্লকবাস্টারের ব্যবসায় ধস নামায় নেটফ্লিক্স। ২০০১ সালের গোড়ার দিকে নেটফ্লিক্স দ্রুত বৃদ্ধির অভিজ্ঞতা লাভ করলেও, ডট কম বাবলের পতনের ক্রমাগত প্রভাব এবং ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার কারনে কোম্পানিটি তার প্রাথমিক পাবলিক অফার (আইপিও) এর পরিকল্পনা বন্ধ করে দেয় এবং তার ১২০ জন কর্মচারীর এক তৃতীয়াংশ ছাঁটাই করে। তবুও থেমে থাকেনি নেটফ্লিক্স। 

সোনালি সময়

২০০৩ সালে ১ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের মাইলফলক স্পর্শ করে নেটফ্লিক্স। সেসময়ে ২৭২ মিলিয়ন ডলার আয় করে এবং ৬.৫ মিলিয়ন ডলার প্রফিট অর্জন করে। ২০০৪ সাল নাগাদ, ৪৯ মিলিয়ন ডলারের বেশ প্রফিট অর্জন করে। ২০০৫ সালে, ৩৫ হাজারের বেশি বিভিন্ন মুভি তাদের সংগ্রহে ছিল। প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডিভিডি তাদের সাবস্ক্রাইবারদের পাঠাত। 

নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার গ্রোথ গ্রাফ ; Image Source: vdocipher.com

অন ডিমান্ড ভিডিও সার্ভিসের যাত্রা 

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ওয়াচ নাউ হিসাবে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করার ঘোষণা দেয়। ২০১০ সালে কানাডায় এই সেবা ট্রায়াল হিসেবে চালু করে নেটফ্লিক্স। সেই সময়ে স্ট্রিমিং সার্ভিসটি শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারকারীরাই নিতে পারতো।  

মুভি স্ট্রিম করতে সক্ষম হওয়ার জন্য নূন্যতম ১ এম্বিপিএস ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে হবে, ডিভিডি কোয়ালিটির ফিল্ম স্ট্রিম করার জন্য ৩ এম্বিপিএস সংযোগ প্রয়োজন ৷ ১৭.৯৯ ডলারের প্ল্যান নিলে ১৮ ঘন্টা স্ট্রিমিং অ্যাক্সেস পেত গ্রাহকেরা। একটি বিশেষ ব্রাউজার অ্যাপলেটের মাধ্যমে ভিডিওগুলো দেওয়া হতো। যা গ্রাহকদের ইনস্টল করে নিতে হতো। 

অনলাইন স্ট্রিমিং মুভি ও সিরিজ ব্যানার; Image Source: arstechnica.com

২০০৮ সাল নাগাদ নেটফ্লিক্সে তাদের ব্যবসায় একটি বিরাট পরিবর্তন আনে। তাদের সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানে গ্রাহকদের জন্য আনলিমিটেড ভিডিও স্ট্রিমিং-এর অ্যাক্সেস দিয়েছিল। ২০১১ সালে নেটফ্লিক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সার্ভিস চালু করে। রিড বিনিয়োগকারীদের বলেন,

Three years ago, we were a DVD by-mail company that offered some streaming. We are now a streaming company which also offers DVD by mail.

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১৯০ টিরও বেশি দেশে নেটফ্লিক্স সিনেমা স্ট্রিম করে এবং ১৫১ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহক রয়েছে। এটি মূল প্রযোজনা সহ বিভিন্ন জনার এবং ৩০ টিরও বেশি ভাষার টিভি সিরিজ, ডকুমেন্টারি এবং ফিচার ফিল্ম প্রভাইড করে থাকে। নেটফ্লিক্সকে টেক্কা দিতে অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি প্লাস, হুলু আসলেও নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি। অন্যান্য মুভি, সিরিজের পাশাপাশি নিত্যনতুন ভিন্নধর্মী গল্প দিয়ে নিজেদের প্রোডাকশন এনেও বেশ সাড়া ফেলছে নেটফ্লিক্স। আজ এই পর্যন্তই।  

 

Feature Photo: shutterstock.com 
Sources: 

01. About Netflix. 
02. Netflix-Inc. 
03. How and When Did Netflix Start? A Brief History of the Company. 
04. The History of Netflix- Founding, Model, Timeline, Milestones (2023 Updated). 
05. From DVDs to streaming, here's the incredible history of Netflix. 
06. NETFLIX HISTORY.