ফুটবল খেলার সাথে যারা পরিচিত তারা নিশ্চয়ই ফুটবলের ফরমেশনের কথা জেনে থাকবেন। মাঠে খেলোয়াড়রা যেভাবে সজ্জিত থাকে, কে কোন জায়গায় খেলবে তা নির্দিষ্ট করা থাকে, এটি খেলার একটা গুরুত্বপূর্ন অংশ। খেলোয়াড়দের ফরমেশনের এই পদ্ধতি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় আজকের আধুনিক ফরমেশনে রূপ পেয়েছে।
ফুটবল খেলায় কৌশলের দিক থেকে মূল বিষয়ের অন্যতম হলো দল গঠন বা ফরমেশন। ফুটবলে ফরমেশনগুলো ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার এবং স্ট্রাইকারদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন নামগুলির মধ্যে শ্রেণীবিভাগ করা হয়। এই হিসেবে গোলরক্ষকের এই কৌশলগত দিকটিতে তেমন কাজ নেই, এক প্রকার অপ্রয়োজনীয়। এই আর্টিকেলে ফুটবলে সর্বাধিক ব্যবহৃত ফরমেশনগুলির একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করা হবে।
ফুটবলের প্রাথমিক ফরমেশন
ফুটবলের প্রথমদিকের ফরমেশন ছিল একেবারে সাধারণ। খেলার একেবারে শুরুর দিকে একজন ডিফেন্ডার ও একজন মিডফিল্ডার নিয়ে খেলা শুরু হতো, বাকি খেলোয়াড়রা সামনের সারিতে ফ্রন্টিয়ার হিসেবে খেলতেন। এটা ছিল ফুটবলের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ফরমেশন; যা পরবর্তীতে খেলোয়াড়দের পরিচিত কৌশল হিসেবে থেকে যায়।
কৌশল বলতে খেলার সিস্টেম বা দল গঠনকে বোঝায় যা ম্যানেজার বা কোচ দ্বারা পরিচালনা করা হয়। ১৯ শতকের প্রথম দিকে ফুটবলে আটজন ফরোয়ার্ড নিয়ে খেলার একটি প্রবণতা দেখা যায়, যার মধ্যে একজন গোলরক্ষক, হাফ-ব্যাক এবং তিন-চতুর্থাংশ ডিফেন্ডার ছিলেন।
১৮৭০-এর দশকে ভালো দলগুলো সামান্য ভিন্ন ফরমেশন ব্যবহার করেছিল যেখানে সাতজন ফরোয়ার্ড, দুটি হাফ-ব্যাক এবং একটি ফুল-ব্যাক দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সময়ে সাধারণত খেলোয়াড়দের ড্রিবলিং এর উপর প্রচুর চাপ দেওয়া হতো।
ফুটবল ফরমেশনে উদ্ভাবনের সূচনা
১৮৮০ এর দশকে উইলিয়াম সুডেল এবং টম মিচেল, স্কটল্যান্ড থেকে খেলোয়াড় কেনা শুরু করেন এবং তাদের দল, প্রেস্টন নর্থ এন্ড এবং ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স খুব সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সফলতা লাভ করে।
এই খেলোয়াড়রা বেশ কিছু নতুন কৌশল নিয়ে আসেন যা ‘স্কটিশ স্টাইল’ নামে পরিচিত ছিল যেখানে খেলোয়াড়রা ড্রিবলিং এর চেয়ে পাসিংয়ে বেশি জোর দিতেন।
১৮৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফুটবল লীগের প্রথম মৌসুম শুরু হয়। উইলিয়াম সুডেল এবং তার প্রেস্টন নর্থ এন্ড দল একটিও ম্যাচ না হেরে প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয় এবং ‘অজেয়’ নামটি অর্জন করে। প্রেস্টন ১৮৮৯ সালের এফএ কাপ ফাইনালে উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে। সেই মৌসুমে সুডেল ২-৩-৫ ফর্মেশন ব্যবহার করেছিল, যেখানে দুটি ফুল-ব্যাক, তিন-হাফ-ব্যাক এবং পাঁচজন ফরোয়ার্ড খেলেছিল।
প্রেস্টন নর্থ এন্ডের সাফল্য অন্যান্য ক্লাবকে ২-৩-৫ ফরমেশন গ্রহণ করতে প্ররোচিত করে। এই সিস্টেমটি ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ফুটবলে আধিপত্য বিস্তার করে যখন এফএ অফসাইড নিয়ম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিবর্তনের ফলে একজন আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড় নিজের এবং গোল লাইনের মধ্যে যে বিরোধী খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল তার সংখ্যা তিন থেকে দুইয়ে কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে খেলার গতিপথে আমূল পরিবর্তন আসে।
ফরমেশন ও সাফল্য, ফরমেশনের সাফল্য
চার্লি বুকান, যিনি আর্সেনালের হয়ে খেলেন, ম্যানেজার হার্বার্ট চ্যাপম্যানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, দলটিকে একটি নতুন প্লেয়িং ফরমেশন তৈরি করতে যা খেলার নতুন আইনের এই পরিবর্তনকে কাজে লাগাতে পারে। ধারণাটি ছিল এমন যে অফসাইড ফাঁদের জন্য দুটি ফুল ব্যাকের পরিবর্তে সেন্টার-হাফের দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
ফুল-ব্যাকগুলি কেবল সেন্টার-হাফের সামনে ২-৩-৫ থেকে ৩-৩-৪ এ পরিবর্তন করা হয়েছিল। এটি ইংরেজি বর্ণের ডব্লিউএম গঠন হিসাবেও পরিচিত হয়ে ওঠে। এই ফরমেশনটি বিকশিত হয়েছিল যা কাউন্টার-এ্যাটাক গেম হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। এটির উপর নির্ভর করে অ্যালেক্স জেমসের পাসিং ক্ষমতা এবং ডেভিড জ্যাক, ক্লিফ বাস্টিন, জ্যাক ল্যামবার্ট এবং টেড ড্রেকের মতো গোল করার ক্ষমতা নিশ্চিত করা যায়।
এই পদ্ধতিতে সাফল্য অবিলম্বে ছিল না বললেই চলে, এই পদ্ধতিতে খেলার দরুণ ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আর্সেনাল এফএ কাপ ফাইনাল জিততে পারে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিতই ছিল না, এক প্রকার মিথ ছিল।
পরের মৌসুমে আর্সেনাল তাদের প্রথম বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। অ্যালেক্স জেমস ১৯৩১-৩২ মৌসুমের একটি বড় অংশ ইনজুরিতে ছিলেন এবং এটি আর্সেনাল এভারটনের কাছে দুই পয়েন্টে শিরোপা হারানোর একটি বড় কারণ ছিল।
১৯৩২- ৩৩ মৌসুমে জেমস তার সেরা ফর্মে ছিলেন। চার পয়েন্টে প্রথম বিভাগে জিতেছে আর্সেনাল। সেই মৌসুমে তারা লিগে ১১৮ গোলের ক্লাব রেকর্ডও করেছিল। আর্সেনাল পরের মৌসুমে হাডার্সফিল্ড টাউনকে পরাজিত করে লিগ জিতেছে। এই সময়ের মধ্যে ডব্লিউএম গঠনটি ফুটবল লীগের বেশিরভাগ ক্লাব ব্যবহার করতে শুরু করে।
হার্বার্ট চ্যাপম্যান ছিলেন কয়েকজন ম্যানেজারদের মধ্যে একজন যারা গেমের আগে কৌশল নির্ধারণে জড়িত ছিলেন। জিমি রাফেল ১৯২০ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছিলেন। দলটি সিড কিং দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল কিন্তু তিনি দাবি করেছিলেন যে, চার্লি পেন্টারই দলের কৌশলের বা ফরমেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন:
সিড কিং একজন ভাল ম্যানেজার ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের প্রশিক্ষক চার্লি পেন্টারকে খেলায় অনেক কিছু শেখানো ছেড়ে দিয়েছিলেন। চার্লির সাথে খেলার আগে সেই বিষয়ে আমাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিলো ওয়েস্ট হ্যামের হয়ে খেলো। যাতে ওদের ফরমেশন শিখতে পারি।
জো স্মিথ সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করা হয়েছিল যিনি ১৯৩৫-৫৬ সালের মধ্যে ব্ল্যাকপুল পরিচালনা করেছিলেন। স্ট্যানলি ম্যাথিউস যুক্তি দিয়েছিলেন যে স্মিথ: ‘কখনও একজন ভালো কৌশলী বা এমনকি একজন দক্ষ পরিচালকও ছিলেন না, তবুও তিনি সর্বকালের সেরা ম্যানেজার ছিলেন যার জন্য আমি খেলার সুযোগ পেয়েছি। জো আমার মধ্যে সেরাটি বের করে এনেছিলেন কারণ তিনি আমাকে আমার স্বাভাবিক খেলাটি খেলতে দিয়েছেন’।
‘আমি তার সমর্থন এবং আমার উপর বিশ্বাসের জন্য সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকব, বিশেষ করে যখন আমি সেই মুহুর্তগুলির দিকে ফিরে তাকাই যখন আমি নিজের জন্য একটি দুর্দান্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিলাম এবং যখন আমি নিজেকে ত্রিমুখী জায়গায় আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম তখনও সন্দেহ ছিল’।
‘একজন গড়পড়তা খেলোয়াড়কে বিশ্বাস করতে এবং পারফর্ম করতে পারানোর জন্য একজন ভালো খেলোয়াড় হিসেবে, এবং একজন ভালো খেলোয়াড়কে খুব ভালো খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে তার অবদান অনস্বীকার্য। সে কিছু খুব ভালো খেলোয়াড়কে দলে নিয়েছে, এবং এটা একজন ম্যানেজারের কাজের সবচেয়ে কঠিন অংশ। জো এটা বার বার করেছে’।
আধুনিক ফরমেশন
ব্রাজিলিয়ানরা তখন জিনিসগুলিকে আরও বিকশিত করছিল এবং প্রথম ফর্মেশন তৈরি করায় মনোনিবেশ করে যাচ্ছিল যা আজও ব্যবহার করা হচ্ছে। ৪-৩-৩ ব্রাজিলিয়ানদের ব্যবহার করা প্রসিদ্ধ ফরমেশন। ফুটবলে সাংবাদিক জোনাথন উইলসন তার বই ইনভার্টিং দ্য পিরামিড-এ ‘বিশৃঙ্খল’ হিসেবে যে দিনগুলোর কথা বলেছেন সে দিনগুলোতে ফুটবলের কোনো ফরমেশন ছিল না।
ইংলিশ ফুটবলের প্রথম দিন থেকে ফুটবল কৌশলের বিবর্তন একটি আকর্ষণীয় যাত্রা করেছে। কৌশলগুলি ২-৩-৫ ফরমেশন গঠন থেকে আজকের অত্যন্ত বিশেষায়িত এবং জটিল ফরমেশন ব্যবস্থায় চলে গেছে। ফুটবল খেলা আরও বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে, ফুটবলের কৌশলে পরবর্তীতে কী হবে এবং ফুটবলের দলগুলি ভবিষ্যতে তাদের খেলায় কীভাবে তাদের ফরমেশন নিয়োগ করবে তা দেখতে আকর্ষণীয় হবে।
Feature Image: soccerprime.com References: 01. Football Formations. 02. The evolution of Football tactics in English Football. 03. Tactics and Playing Formation. 04. Classic Modern Football Formations.