কালের অতল গর্ভে মাটির নিচে হারিয়ে যায় কত শত প্রাচীন শহর ঠিক সেরকমভাবেই সিরিয়ার মাটির তলে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন একটি শহর হচ্ছে এবলা। আমরা মিশরীয়, গ্রীক কিংবা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা সম্পর্কেই বেশি শুনে থাকি। অসংখ্য সভ্যতার আড়ালে সিরীয় সভ্যতা খুব কম সময়ই আলোচিত হয়। মাটির তলে হারিয়ে যাওয়া এবলা নামক কিংবদন্তি সিরীয় সভ্যতার এই শহর নিয়েই জেনে নিন কিছু অজানা তথ্য।
আবিস্কারের ইতিহাস
বিভিন্ন সভ্যতা আবিস্কারের হিড়িক থাকলেও সিরীয় সভ্যতা অনেকটা অবহেলিতই থেকে গিয়েছিল। তবে ইতালীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ পাওলো ম্যাথিয়া মনে করেছিলেন যে সিরীয় সভ্যতাকে পুরোপুরি অবহেলা করা উচিত নয়। ১৯৬৪- ১৯৬৫ সালে তিনি এবং তার দল বর্তমান আলেপ্পো থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তর সিরিয়ার টেল মারদিখ নামক একটি স্থান তাদের গবেষণার জন্য বেছে নেন।
মিশরীয় এবং আক্কাদিয়ান শিলালিপি থেকে জানা যায় এবলা শহরটি ১৯৬৮ সালে ম্যাথিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। টেল মারদিখ প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন এবলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই খনন কার্যক্রম ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে এবং উপরের অংশ খনন করার মাধ্যমেই শহরের প্রধান অংশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৭০০ সহস্রাব্দে এই শহর বেশ উন্নতি করেছিল।
তিনি এবং তার গবেষকদল ১৭০০০টিরও বেশি কিউনিফর্ম ফলক এবং ৪৭০০ টি টুকরো এবং হাজার হাজার ক্ষুদ্র চিপ আবিষ্কার করেছে, যা সিরিয়ার লিংকব্লা শহরের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। এছাড়াও ফলকগুলো Ebla tablets Offsite Link নামে পরিচিত। ধসে পড়া ফলকগুলোতে সমসাময়িক কাদামাটির ট্যাগ পাওয়া যায় যার দ্বারা মূল ব্যবহারকারীদের সনাক্ত করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দে সুমেরিয় এবং আকাড্ডিয়ান শিলালিপিতেও এই শহরের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এই শহরের প্রথম অধিবাসীগণ ছিলেন আমোরাইট গোষ্ঠী। এরা হচ্ছে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনে বসবাসকারী এক সেমিটিক যাযাবর জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪ শতকের মধ্যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এবলায় চলে আসে। সেখানে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে এরা ‘হুরিয়ান’ নামক অপর এক জাতির সাথে মিশে যায়।
এবলায় প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ব
মাথিয়া ও তার গবেষকদল পশ্চিমদিকে খননের সময় একটি প্রাসাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এই প্রাসাদের দেয়াল এতো উঁচু ছিল যে কিছু অংশের দেয়াল এখনও ৭ মিটার পর্যন্ত টিকে আছে। এর নাম প্রত্নতাত্ত্বিকগণ দেন প্যালেস জি। যা মূলত একটি ছদ্দনাম।
প্রাসাদের পাশে একটি খোলা ময়দানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যেটিকে দর্শকের আদালত হিসাবে আখ্যয়িত করা হয়। উত্তর দেয়ালে মাটির ইটের তৈরি একটি উঁচু মঞ্চ খুঁজে পাওয়া যায়। সম্ভাবত এটি রাজার সিংহাসন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এছাড়াও এব্লাইট কারুশিল্পের একটি মানব মাথাযুক্ত ষাঁড় পাওয়া যায় যা বেশ উঁচুস্তরের ছিল। আরও পাওয়া যায় কাঠের কোরের সাথে সংযুক্ত সোনার ফয়েল এবং দেয়াল সাজানোর বিভিন্ন জিনিস। ব্যবিলনীয় অনুপ্রেরণায় এগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে।
একটি স্তবকসহ বেশ কয়েকটি সুমেরীয় পাঠ্য এবং এবলাইট ও সুমেরীয় ভাষার কিছু আভিধানিক তালিকা প্রাসাদে পাওয়া যায়। এবলা ও আশেপাশের অঞ্চলের প্রশাসনিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কিছু সাহিত্যিক পাঠ্যও পাওয়া গিয়েছিল। এবলার আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এখান থেকেই।
আরও কিছু নথিতে তৎকালীন কর্মরত শ্রমিক, কারিগরদের জীবনযাত্রার এবং রেশন ব্যবস্থার বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। প্রাসাদে আরও বেশ কিছু নথি খুঁজে পাওয়া যায় , যেখান থেকে জানা যায় উল উৎপাদনের বিবরণ এবং এবলার স্থানীয় এবং বিদেশীদের কাছে উলের তৈরি পণ্য বিক্রয়ের বর্ণনা আছে।
এবলার রাজ্য এবং তাদের সময়কাল
এবলায় তিনবার রাজ্যের উথান ও পতন হয়েছিল। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় রাজ্যের তুলনায় প্রথম রাজ্য বেশি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধশালী ছিল।
প্রথম রাজ্য
প্রথম রাজ্যের বিস্তৃতির সময় এবলার আয়তন ৫৬ হেক্টর ছিল। তৎকালীন রাজধানীতে ৪০ হাজার মানুষ এবং পুরো রাজ্যে ২ লাখ মানুষ বসবাস করত। তখন এবলা ৪ টি জেলায় বিভক্ত ছিল এবং এদের প্রত্যেকটির সীমান্তে নিজস্ব গেইট ছিল। ৪ টি গেইটই দেবতাদের নামে নামকরণ করা হয়েছিল। এই চার দেবতা ছিলেন দাগান, হাদাদ বা হাদ্দা, রাসাপ এবং উতু। দুইটি মন্দির ছিল এছাড়াও এই সময়েই প্যালেস জি তৈরি করা হয়। সাকুমে এই রাজ্যের প্রথম রাজা ছিলেন। প্রথম রাজ্যের শেষ রাজা ছিলেন ইরাক দামু। এরপরেই প্রথম রাজ্যের পতন আক্কাদীয়দের হাতে ঘটে।
দ্বিতীয় রাজ্য
দ্বিতীয় রাজ্য প্রথম রাজ্যের মত খুব বেশি সমৃদ্ধশালী ছিলনা। প্রথম রাজ্য ধ্বংসের পর দ্বিতীয় রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়, যদিও দ্বিতীয় রাজ্যের রাজাদের নাম এখনও অজানা রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় রাজ্যের রাজত্ব চলে। এসময় প্রথম রাজ্যের অনেক স্থাপনা এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো সংস্কার করা হয়েছিল।
তৃতীয় রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৬০০ পর্যন্ত তৃতীয় রাজ্যের সময়কাল ছিল। তখন এটি মারদিখ নামে পরিচিত ছিল। ইগ্রিশ হেবা ছিলেন তৃতীয় রাজ্যের প্রথম রাজা। তিনি শহরটিকে খুব পরিকল্পিতভাবে সাজানো শুরু করেছিলেন। তিনি নতুন করে প্রাসাদ, মন্দির এবং ২টি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। তৃতীয় সাম্রাজ্যের সময় এবলা প্রায় ৬০ হেক্টর আয়তনের বড় একটি শহর ছিল। ইয়েমা তৃতীয় রাজ্যের সবচেয়ে সফল রাজা ছিলেন।
মিশরের ফেরাউন হোটেপিব্রের সাথে তিনি সন্ধি করেন। ধীরে ধীরে এবলা প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের মিশর, আনাতোলিয়া, পারস্যের মাঝে সংযোগ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে, যা রাজ্যকে বাণিজ্যিকভাবে বেশ লাভবান করে তোলে।
এবলা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য
ভাষা
ট্যাবলেটগুলিতে লেখার মধ্যে দুটি ভাষা উপস্থিত হয়েছিল: সুমেরিয়ান, এবং আরও একটি পূর্বের অজানা কোন একটি ভাষা যা স্থানীয়ভাবে কথ্য এবলা ভাষার ধ্বনিগত উপস্থাপনা হিসাবে সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপি (সুমেরিয়ান লোগোগ্রাম বা “সুমেরোগ্রাম”) ব্যবহার করেছিল। অধ্যাপক জিওভানি পেটিনাটো, যিনি প্রথম ট্যাবলেটগুলির পাঠোদ্ধার করেছিলেন তিনি এই অজানা ভাষাকে “ইব্লাইট” বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়, যে নামে এটি আজও পরিচিত।
ধর্মীয় বিশ্বাস
একদম শুরুর দিকে এর অধিবাসীরা মৃত রাজাদের উপাসনা করতো। তবে পরবর্তীতে তারা বহু-ঈশ্বরবাদীতে রূপান্তরিত হয়। এক পর্যায়ে তারা মেসোপটেমিয়া এবং সেমিটিক দেবতা এবং তাদের স্ত্রীর পূজা করা শুরু করে। দবির ছিলেন শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা, তবে দাগন, সিপিশ, হাদাদ, বালাতু এবং আস্তার্তেও পূজা করা হতো।
জীবন জীবিকা
কৃষিকাজের জন্য এবলার মাটি বেশ উর্বর ছিল। ফলে এবলা একটি সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক শহরে পরিণত হয়। এখানে যব, গম, আঙুর, ডালিম, জলপাই, ডুমুর এবং শণের চাষবাস করা হতো। এছাড়াও গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল এবং শূকর পালন করতো শহরের অধিকাংশ অধিবাসীরা।
তবে দামাস্ক কাপড়, লিনেন কাপড় এবং উল প্রধান পণ্য ছিল। এবলা থেকে থেকে রাজ্যের অন্যান্য শহরে এসকল পণ্য বিপণনের জন্য সরবরাহ করা হতো। জলপাই তেল, ওয়াইন এবং বিয়ার উৎপাদনের জন্যও শহরের বেশ খ্যাতি ছিল।
এবলা সম্পর্কে যত জানা যাবে তত বেশিই যেন অজানা থেকে যাবে। তাই এই অজানাগুলো সামনে মেলে ধরতে হলে দরকার আরও অনুসন্ধান।
Feature Image: pinterest.com Sources: 01. Ebla. 02. Ebla: a lost metropolis of 4,000 years' ago discovered in Syria. 03. The Palace Archive of Ebla, Syria. 04. First Kingdoms: The Forgotten Mesopotamian Kingdom of Ebla. 05. List of kings of Ebla. 06. Ebla tablets.