কফির দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস

732
0

বৃষ্টির দিনে গরম এক কাপ কফি খাওয়ার সময় কখনো কি ভেবেছেন – কীভাবে এলো এই কফি? অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, নানা ইতিহাসের অংশ হয়ে কফির আজকের জনপ্রিয়তা। কফির এই দীর্ঘ পথপরিক্রমার গল্প নিয়েই আজকের আলোচনা।

কফির উৎপত্তি নিয়ে অনেক মত থাকলেও, এর সূচনা ১৩শ শতাব্দীতে ইথিওপিয়ায়। তবে কফি পানের প্রথম দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৫ শতকের মাঝামাঝি ইয়েমেনের সুফি মঠে। ১৬ শতকের মধ্যে এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বাকি অংশে পৌঁছায়। 

প্রথম ক্যাফে খোলা হয় কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমানে ইস্তাম্বুল), ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। অচিরেই তা কূটনীতিক, শিল্পী, লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের পছন্দের মিলনস্থল হয়ে উঠে। ইউরোপের প্রথম কফি হাউস ছিল ১৬৪৫ সালে ভেনিসে। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বাকি দেশগুলোও ভেনিসকে অনুসরণ করে। কফি হাউসগুলো শীঘ্রই ব্যবসা এবং সংস্কৃতির মিলনমেলা হয়ে ওঠে। 

ইস্তাম্বুলে অটোম্যান সাম্রাজ্যের একটি কফি শপ। Image source: Daily Sabah

আবিষ্কারের গল্প

কফি বিন আবিষ্কারের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি ৭০০ খ্রিস্টাব্দে একজন ইথিওপিয়ান (পূর্বে আবিসিনিয়া) ছাগল পালনকারী ক্যালডি এবং তার ছাগলগুলো কেন্দ্র করে। একদিন ছাগল চরানোর সময়, ক্যালডি লক্ষ্য করে আচমকাই ছাগলগুলো লাফাতে শুরু করেছে, যেন নাচছে।

তিনি আবিষ্কার করেন যে, তারা লাল বেরির মতো কোনো ফল খাচ্ছে এবং বুঝতে পারেন যে এই অজানা ফলই ছাগলগুলোর এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ। তিনি ফলগুলো এক সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যান। সন্ন্যাসী খুব আনন্দিত হন এই ভেবে যে, এটি তাকে সারারাত জেগে প্রার্থনা করতে সাহায্য করবে। 

অন্য একটি গল্পে অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে, কফি বিন সন্ন্যাসী ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আগুনে ফেলে দেন। আর এটিই বিশ্বের প্রথম রোস্টেড কফিতে পরিণত হয়েছিল। যদিও ক্যালডির গল্পের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  

ক্যালডির কফি আবিষ্কার। Image source: coffeecrossroads.com

মধ্যপ্রাচ্যে কফির আগমন

কফি ১৫ শতকে ইয়েমেনের ‘মোকা’ বন্দরে প্রথম আসে। কফির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং বন্দর শহর থেকে চালানের কারণে, মোকা এখন কফির সমার্থক হয়ে উঠেছে। 

ইয়েমেন থেকে মিশর, পারস্য এবং তুরস্কে কফি সুপরিচিত হয়। এটি ‘আরবের ওয়াইন’ নামে পরিচিত ছিল। সারা আরবের চারপাশে কফি হাউস খোলার সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। 

তবে ১৫ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে, মক্কার আদালত কফিকে এর উত্তেজক প্রভাবের কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কায়রো, মিশর এবং ইথিওপিয়াতেও একই ঘটনা ঘটে। তবে দাঙ্গা এবং প্রবল বিদ্রোহের মুখে, এই নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়। 

ইয়েমেনের মোকা বন্দর। Image source: Public Domain

এশিয়াতে কফির আগমন

ভারত

বাবা বুদান নামে ভারতের একজন সুফি সাধক, ১৬৭০ সালে মক্কা থেকে ফিরে আসার সময় কিছু কফি বিন ভারতে এনে কফি চাষ শুরু করেন। এটি দক্ষিণ ভারতে একটি বৃহৎ আকার ধারণ করে, যা আজও চলমান। 

দক্ষিণ ভারতের যেখানে প্রথম কফির আগমন ঘটে Image source: We The Origin

ইন্দোনেশিয়া

সিলন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভার ডাচ গভর্নরের কাছে কফির চারা পাঠানো হয়েছিল। যদিও একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কফি চাষের প্রথম প্রচেষ্টা নষ্ট করে দেয়। ১৭০৪ সালে আরও চারা রোপণ করা হলে ইন্দোনেশিয়ায় কফি একটি প্রধান জিনিস হয়ে ওঠে। জাভা কফির আরেক প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে। 

ফিলিপাইন 

কফি ফিলিপাইনের বাটাঙ্গাস প্রদেশের লিপা শহরে নিয়ে এসেছিলেন, একজন স্প্যানিশ ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসী। শীঘ্রই, ইবান, লেমেরি এবং তালের মতো বাটাঙ্গাসের অন্যান্য শহরে খামার খোলার মাধ্যমে কফি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। 

কফির ইউরোপ যাত্রা

কফি অবশেষে ১৫৭০ সালে ভেনিসের মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৬১৫ সালে, পোপ ক্লিমেন্ট অষ্টম কফিকে ব্যাপ্টাইজ করে খ্রিস্টান পানীয় হিসাবে ঘোষণা করে। 

১৬৬৯ সালে লুই চতুর্দশের সময়, প্যারিসে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের সময় রয়্যাল কোর্ট এবং প্যারিসে কফির প্রভাব তুমুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে।  

পোপ অষ্টম ক্লিমেন্ট Image source: Original Chino Products

আমেরিকার কফির ইতিহাস

আমস্টারডার্মের মেয়র ১৭১৪ সালে ফ্রান্সের রাজা লুই চতুর্দশ-কে একটি কফির চারা উপহার দিয়েছিলেন। এটি প্যারিসের রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে সুরক্ষিত ছিল। 

ফরাসি নৌবাহিনীর একজন অধিনায়ক, গ্যাব্রিয়েল ম্যাথিউ ডি ক্লিউ প্যারিস সফরে ছিলেন। যদিও এটা স্পষ্ট নয় যে, তিনি কিং লুইয়ের কফি গাছ থেকে ক্লিপিংস চুরি করেছিলেন কি না; কিং লুই নিজেই মার্টিনিকে একটি কফি বাগান স্থাপনের জন্য ডি ক্লিউকে আদেশ দিয়েছিলেন। 

ডি ক্লিউ তার কফি চারা নিয়ে ক্যারিবিয়ানের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন। এই দীর্ঘ ভ্রমণে ডি ক্লিউ তার উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন। নৌকায় পানির অভাব হওয়ায়, তিনি নিজে তৃষ্ণার্ত থেকে গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখেন। দ্বীপে পৌঁছে তিনি এটিকে নিরাপদে রাখতে গোপনে অন্যান্য গাছের মধ্যে রোপণ করেন। ৩ বছরের মধ্যে তা মার্টিনিক, সেন্ট ডমিনিক এবং গুয়াডালুপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যা শেষ পর্যন্ত ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বাকি অংশে পৌঁছায়। 

কফির সাথে আমেরিকার যাত্রা শুরু হয় ১৮ শতকে বোস্টন টি পার্টি এবং আমেরিকান বিপ্লবের মাধ্যমে। সালটা ছিল ১৭৭৩। একদল দেশপ্রেমিক বোস্টন বন্দরে, চায়ের উপর ইংরেজদের ট্যাক্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তাদের চায়ের জাহাজের সমস্ত চা সমুদ্রে ফেলে দেয়। এইভাবে, কফি আমেরিকান পানীয় হিসাবে পরিচয় লাভ করে। 

বোস্টন টি পার্টি। Image source: Journal of the American Revolution

দক্ষিণ আমেরিকার কফির ইতিহাস

১৭-১৮ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া এবং ভেনেজুয়েলায় কফির আগমন ঘটে। ১৯২৭ সালে, কলম্বিয়ার কফির ন্যাশনাল ফেডারেশন ‘Federación Nacional de Cafeteros de Colombia’ কফি গবেষণা ও উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়। যার ফলে কলম্বিয়ার বাজার বৃদ্ধি পায়।

একমাত্র ল্যাটিন দেশ হিসেবে ইকুয়েডর রপ্তানির চেয়ে বেশি কফি আমদানি করে। অন্যদিকে, ভেনেজুয়েলার তেল অর্থনীতি ৫০-৬০ এর দশকে উন্নতি লাভ করায়, কফি সেখানে অবহেলিত ফসলে পরিণত হয়। বলিভিয়াতে ৯০ এর দশকে কফি উৎপাদন শুরু হয় এবং এখনও স্বল্প পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। 

ব্রাজিলিয়ান কফি বিন। Image source: Unsplash

১৯২০ সালে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ঋণ পরিশোধের জন্য পেরুর প্রায় ২ মিলিয়ন হেক্টর জমি দখল করলে, কফির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, পেরুর ছোট খামারগুলোকে বৃহত্তর বাজারের সাথে সংযুক্ত করার অবকাঠামোর অভাব ছিল। তবে, অনেক কৃষক হাল ছেড়ে দেয়নি। ফলে পেরু এখন বিশ্বে ৫ম বৃহৎ কফি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। 

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কফি উৎপাদন করে ব্রাজিল। ফ্রান্সিসকো ডি মেলো পালহেতা নামে এক ব্রাজিলিয়ান কর্নেল, ১৭২৭ সালে ডাচ এবং ফরাসিদের মধ্যে একটি বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য গায়ানায় যায়। তবে তার মূল লক্ষ্য ছিল, ব্রাজিলে কফি নিয়ে আসা। তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে, গভর্নরের স্ত্রীর সাহায্যে কিছু কফির ক্লিপিং ব্রাজিলে এনে বৃহত্তম কফি সাম্রাজ্য শুরু করেন।  

অসিদের কফি প্রেম

১৭৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম কফি এসেছিল রিও ডি জেনিরো থেকে। গভর্নমেন্ট হাউসে প্রথম চারা রোপণ করা হয়, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। 

১৯৩০ সালে ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীরা কফির ইতিহাস পরিবর্তন করে। তাদের সাহায্যে শহরগুলোতে কফি শপ গড়ে উঠে। যা আজও তাদের বংশধররা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪২ সালে আমেরিকানরা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ইতিহাস আবার পরিবর্তন করে।  

সিডনি সিটি ডান্স ক্যাফেতে আমেরিকানরা। Image source: Argus Newspaper Collection of Photographs, State Library Victoria

কফির আবিষ্কার থেকে উৎপাদন, বিতরণ পর্যন্ত বিচিত্র ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সামাজিক, রাজনৈতিক, ও ভৌগোলিক কারণ। আজ কফি শুধু পছন্দের একটি পানীয়ই নয়, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু, ব্যক্তিগত সময়ের সঙ্গী এবং একটি বৃহৎ শিল্প।  

 

Feature Image: therail.com
তথ্যসূত্রসমূহ:

  1. History-of-coffee.
  2. History-of-coffee.
  3. A-short-history-of-Turkish-coffee.
  4. A-history-of-coffee-in-Asia.
  5. Coffee-in-Europe.
  6. Coffee-origins-101-south-America.
  7. History-of-Australia-love-affair-coffee.