বিয়ে-শাদি, ঘরোয়া খানাপিনা থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় অথবা তপ্ত দুপুরে প্রাণ জুড়াতে কোমল পানীয় ব্যতীত দ্বিতীয় কিছুর জুড়ি মেলা ভার! আর কোমলপানীয়ের কথা মনে আসলে প্রথমেই যে নামটা মন এবং মস্তিষ্কে আসে তা হলো ‘কোকাকোলা।’ প্রতিযোগিতা করতে আরো অনেক নাম সামনে আসলেও স্বাদ এবং গুণ একে করেছে অনন্য।
‘কোকাকোলা’ শুধু মাত্র যেন একটি কোমলপানীয়র নামই নয়; বরং যার রয়েছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের নানান জানা-অজানা ইতিহাস। ক্রমবর্ধমান এই প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বাজারে কিভাবে এই কোমল পানীয়টি বিশ্বজয় করলো? শুরু কোথায়? কিভাবে পৌঁছলো প্রত্যেকের হাতের নাগালে? যা আজ ইউরোপ পাড়ি দিয়ে আমাদের উপমহাদেশেও সমান তালে রাজত্ব করছে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
ফর্মুলা
কোমল পানীয়র ফর্মুলা যেন এক রহস্যের আধার। এমন হয়তো কেউ নেই যার মনে উঁকি দেয়নি এই প্রশ্ন! কি আছে এতে? এর উপাদান কি? কোন পদ্ধতিতে প্রস্তুত হয়, আরো কত কি! কত কন্সপিরেসি থিউরিও যে আছে কোকাকোলাকে কেন্দ্র করে – তার ইয়ত্তা নেই। তবে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এতটা গোপনীয় বা অন্ধকারে ঘেরা না। কৌতুহল মানুষকে কত দূরেই না নিয়ে যায়, কৌতুহলের হাত ধরেই যেন সৃষ্টি হয়েছে যুগান্তকারী সব সৃষ্টি।
১৮৮৬ সালের মে মাসে, জর্জিয়ার আটলান্টার একজন ফার্মাসিস্ট ডাক্তার জন পেমবার্টন এবং তার কৌতূহল তাকে একটি স্বতন্ত্র স্বাদযুক্ত কোমল পানীয় তৈরি করতে পরিচালিত করে। একটি ব্যতিক্রম স্বাদযুক্ত সিরাপ তৈরি এবং স্থানীয় জ্যাকবস ফার্মেসিতে নমুনা নেওয়া, অত:পর ‘চমৎকার’ একটি ফর্মুলা বলে মনে হওয়া! পরবর্তী ধাপে একটি নতুন ‘সুস্বাদু এবং সতেজ’ পানীয় তৈরি করতে সিরাপটি কার্বনেটেড জলের সাথে মিলিত করণ… ব্যাস!
কে জানতো বিশ্ববিখ্যাত কোমল পানীয়র ব্র্যান্ড কোকাকোলার সূত্রটি পেমবার্টন তার বাড়ির উঠোনে তিন পায়ের পিতলের কেটলিতে তৈরি করে ফেলবেন! এরপরই পথচলা, ডাক্তার পেমবার্টনের অংশীদার এবং বুককিপার ফ্রাঙ্ক এমরবিনসন, ‘কোকা-কোলা’ পানীয়টির নামকরণের পাশাপাশি আজও ব্যবহৃত ট্রেডমার্কযুক্ত, স্বতন্ত্র স্ক্রিপ্ট ডিজাইন করার জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত এবং প্রশংসনীয়।
বিজ্ঞাপনের কৌশল
একটা প্রোডাক্ট এর বিক্রয় থেকে শুরু করে ভোক্তার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের উপর। এবং এই পুরো ব্যাপারটাতেই কোকাকোলা ছিল খুবই কৌশলী! কোকাকোলা হয়ত বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্র্যান্ড। কিন্তু শুরুর দিকে কিন্তু এমনটি ছিল না।
যখন কোম্পানিটি ১৮৮৬ সালে প্রথম শুরু হয়েছিল। তখন পণ্যটির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এটি বিনামূল্যে বিতরণ করা শুরু হয়। ১৮৮৮ সালে পেমবার্টনের মৃত্যুর আগে, অর্থাৎ কোকাকোলাকে বিশ্বের ১ নম্বর বিক্রীত কোমল পানীয় তৈরি করার মাত্র দুই বছর পরে, পেমবার্টন তার ব্যবসার কিছু অংশ বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিক্রি করেছিলেন, যার অধিকাংশই আটলান্টার ব্যবসায়ী আশা জি ক্যান্ডলার-এর কাছে বিক্রি হয়েছিল। মিস্টার ক্যান্ডলার এর নেতৃত্বে, কোকা-কোলার প্রসরণ আটলান্টার বাইরেও ছড়িয়ে পরে।
ক্যান্ডলার এবার এখানে তার মোক্ষম চাল দেন। তিনি অভিনব সব পদ্ধতিতে কোকাকোলার প্রমোশন করা শুরু করেন। মাত্র ১১ হাজার মার্কিন ডলার বাজেট নিয়ে শুরু হয় বিজ্ঞাপনের যাত্রা। তিনি কোকাকোলার বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য ক্যালেন্ডার, দেয়ালিকা, ন্যাপকিন, পেন্সিল এবং ঘড়ির মতো আইটেম ব্যবহার করতেন।
১৮৯০ এর দশকের শেষের দিকে, কোকা-কোলা ছিল আমেরিকার অন্যতম জনপ্রিয় ফাউন্টেন ড্রিংকস, মূলত ক্যান্ডলারের অসাধারণ বিজ্ঞাপনের কারণে। ক্যান্ডলারের নেতৃত্বে, কোকা-কোলা কোম্পানি ১৮৯০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে ৪,০০০ শতাংশের বেশি পানীয় বিক্রি বাড়িয়েছিল।
১৯৬৯ সালে, কোকা-কোলা কোম্পানি এবং এর বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ম্যাকক্যান-এরিকসন, তাদের জনপ্রিয় ‘থিংস গো বেটার উইথ কোক’ প্রচারাভিযানের সমাপ্তি ঘটায়। এটি একটি প্রচারণার সাথে প্রতিস্থাপিত হয় যা ‘ইটস দ্য রিয়েল থিং’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে। একটি হিট গান দিয়ে শুরু, নতুন প্রচারাভিযানটি এমন বৈশিষ্ট্যযুক্ত যা এই পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে একটি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
কোকা-কোলা এবং মহামন্দা
২৪ অক্টোবর ১৯২৯ সালে, ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশের কারণে আমেরিকাকে এক দশকব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। বিক্রয় হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, কোকা-কোলা বিজ্ঞাপন খরচ বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে দীর্ঘমেয়াদী ব্র্যান্ড ইক্যুইটির জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে।
এর ফলে স্টক মূল্যের অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও ভোক্তাদের অতুলনীয় আনুগত্য দেখা দেয় এবং কোকা-কোলাকে তুলনামূলকভাবে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম করে; যা ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোকা-কোলা
যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করে, তখন কোকা-কোলা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের পণ্য সব মোতায়েন সৈন্যদের জন্য উপলব্ধ হবে, তারা যেখানেই থাকুক। এটি পানীয়টির জন্য একটি বিশ্বব্যাপী চাহিদা তৈরি করে, যার ফলে বোতলজাত সুবিধাসহ দেশের সংখ্যা ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এই সময়ে কোকা-কোলা তার দ্বিতীয় পানীয়, ফান্টা, জার্মান বাজারগুলিতে চালু করে। যা এখন প্রতিদিন ১৩০ মিলিয়নেরও বেশি বার পান করা হয় পুরো বিশ্বজুড়ে।
কোকা-কোলার নতুন স্বাদ
যখন প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি পেপসি-কোলা ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে বাজারের অংশীদারিত্ব লাভ করতে শুরু করে, তখন কোকা-কোলা ঘোষণা করে যে, ৯৯ বছরে প্রথমবারের মতো, এটি তার মূল ফর্মুলা বা স্বাদে পরিবর্তন ঘটাবে। ২৩ শে এপ্রিল, ১৯৮৫ সালে, আসল কোক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কোকা-কোলার শেয়ার দ্রুত ৩% কমে যায়। যা কোকা-কোলার ইতিহাসে প্রথম এত বড় ধস!
নতুন কোক পুরোনো ভোক্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এমনকি তারা তাদের প্রিয় এই পানীয়র পুরোনো স্বাদের জন্য আন্দোলনও করে এবং কেউ কেউ কোকাকোলা কোম্পানিকে বয়কট করে। কোকাকোলা কোম্পানি তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং মাত্র ৭৭ দিন এর ভেতর তারা তাদের পুরনো ক্লাসিক স্বাদে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
কোকা-কোলা ক্লাসিকের নতুন ব্র্যান্ডিংয়ের সাথে আসল কোলার স্বাদ ফিরে আসলেও নতুন কোক তাকগুলিতেই রয়ে যায়। যা ১৯৯২ সাল থেকে ২০০২ সালের শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, কোক দ্বিতীয় নামকরণ করা হয়েছিল। কোকা-কোলা আবার প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে যায় এবং শীর্ষস্থান দখল করে। এবং এই স্থানে পানীয়টি তখন থেকেই রয়ে গেছে।
ডায়েট কোক
জুলাই ১৯৮২ সালে, কোকা-কোলা একটি কম ক্যালোরির বিকল্প, ডায়েট কোক প্রবর্তন করে। এটি ১৮৮৬ সাল থেকে কোকা-কোলা ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা প্রথম নতুন ব্র্যান্ড। যাত্রার এক বছরের মধ্যে, ডায়েট কোক আমেরিকার শীর্ষ চিনি-মুক্ত পানীয় হয়ে উঠে এবং কোকা-কোলার খুচরা বিক্রয়কে ৭% বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে ডায়েট কোক বিশ্বের সবচেয়ে সফল ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে একটি। যা ১৮৫ টিরও বেশি দেশের বাজারে সহজলভ্য।
কোকা-কোলা প্যাকেজিং বিবর্তন
১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কোকা-কোলা শুধুমাত্র একটি ফাউন্টেন পানীয় হিসাবে পরিবেশন করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ৬.৫ আউন্স কনট্যুর বোতলটি ছিল একমাত্র প্যাকেজিং বোতল। তবে ১৯৬০ সালে, কোকা-কোলা তার পানীয়গুলিকে আরও বহনযোগ্য করার জন্য ১২-আউন্স স্টিলের ক্যান চালু করে যা বর্তমানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আর যুগান্তকারী লোগোটি তৈরি করা হয়েছিল ১৮৮৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক এম রবিনসন দ্বারা।
বিশ্বের সবচেয়ে আইকনিক ব্র্যান্ড
২০১৭ সালে, ফোর্বস কোকা-কোলাকে বিশ্বব্যাপী শীর্ষ পাঁচটি সবচেয়ে মূল্যবান ব্র্যান্ডের মধ্যে একটি হিসেবে স্থান দিয়েছে। সেই সাফল্যের একটি বড় অংশ এর বিজ্ঞাপন এর প্রচারাভিযান থেকে আসে, যা বিশ্বের সব প্রান্তে পৌঁছেছে বর্তমানে। উদাহরণস্বরূপ, কোকা-কোলা যখন ২০১৩ সালে ‘শেয়ার এ কোক’ স্লোগান চালু করেছিল তখনই বিক্রয় ২% বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে এবং ক্রীড়া ইভেন্টের স্পনসরশিপ (যেমন – ফিফা বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিক গেমস), কোকা-কোলা নিশ্চিত করেছে যে যুগ যতই আধুনিক হোক না কেন তারা সবসময় সেরাদের সেরা। যার ফলশ্রুতিতে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, কোকা-কোলা তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও, কোকা-কোলা এখনও বিশ্বের অন্যতম সফল এবং সুপরিচিত ব্র্যান্ড।
Feature Image: coca-cola.co.uk
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. The History of Coca-Cola.
02. The History Of Coca Cola.
03. The Evolution of the Coca-Cola Brand.
04. History of Coca-Cola.