আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রতিনিয়তই আমরা মধ্যপ্রাচ্যের ধ্বংসাত্নক পরিস্থিতির খবর দেখতে পাই। কেন মধ্যপ্রাচ্যে এই অবস্থা সেটি কি আমরা গভীর থেকে পর্যালোচনা করেছি কখনো? অনেকেই শুধুমাত্র নাইন এলিভেন এর প্রতিশোধের জন্য আমেরিকার হামলাকেই এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি বলে দায়ী করি। কিন্ত এর সাথে সাথে অঞ্চলটির আঞ্চলিক রাজনীতিও যে দায়ী, সেটি বেমালুম ভুলে যাই। আর এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি কিন্তু।
বছরের পর বছরের শোষণ থেকে উত্তরণের জন্য এখানের সাধারণ মানুষরা গণতন্ত্রপন্থী এক বিদ্রোহ গড়ে তুলে যার শুরু হয় উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়া থেকে। আস্তে আস্তে এই বিদ্রোহ মধ্যপ্রাচ্যসহ এর আশেপাশের দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এই গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহকেই ‘আরব বসন্ত’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
সূচনা
আরব বসন্তের সূচনা হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদ বুয়াজিজি নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে। তিউনিশিয়ান এই ব্যক্তি ফল বিক্রেতা ছিলেন। তিনি তার ব্যবসার জন্য যেই জায়গায় বসবেন সেখানে হঠাৎ একদিন অন্য কাউকে বসতে দেখে পুলিশের নিকট অভিযোগ করেন। মূলত তৎকালীন সময়ে পুলিশ অনেক দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল বিধায় এই সমস্যা নিরসনে তারা বুয়াজিজিকে হয়রানি করে এবং তার ফল জব্দ করে ফেলে। অর্থাৎ, ঘুষ নেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য।
বুয়াজিজি তার প্রতি এই অপমান সহ্য না করে টাউন হলের সামনে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেন। যেহেতু তিউনিশায়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না, সেহেতু গণমাধ্যমে এই খবর না ছড়ালেও ফেসবুক, টুইটারসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
বুয়াজিজির এই আচরণ সম্পূর্ণ তিউনিশিয়ান জনগণের অসহায়ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। ১৯৮৭ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা বেন আলি দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তো বটেই তার সাথে সাথে বেকার সমস্যা, মানবাধিকার, ভালো শিক্ষার অভাব, বিরোধী দলীয়দের প্রতি জেল ও অত্যাচার করার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছিলেন।
বুয়াজিজির এই ঘটনা সবার মনে এক প্রতিবাদ সৃষ্টি করে তোলে যেটা পূর্বের থেকেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল। ২৪শে ডিসেম্বর ২০১০ সালে মানুষ একত্র হয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচিতে তাদের ‘লাইভ ফায়ারিং’ করে। পরবর্তীতে ২৭শে ডিসেম্বর এক হাজার জন চাকরি প্রত্যাশী প্রেসিডেন্টের বাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করে। ৩রা জানুয়ারী ২০১১ সালে এই আন্দোলন আরো তীব্রতা লাভ করে। কিন্ত অবস্থা আরো তীব্রতর হয় যখন খবর আসে যে সেই বুয়াজিজি মৃত্যুবরণ করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৯৫ শতাংশ উকিল এবং ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা ধর্মঘটে যান।
বেন আলি বেগতিক এই অবস্থার ভিত্তিতে কারফিউ জারী করেন এবং বলেন যে, তিনি সংবিধান পরিবর্তন করবেন না। কিন্ত ২০১৪ সালের নির্বাচনে আর লড়বে না। অর্থাৎ এই চারবছর এক পার্টি সিস্টেমই থাকবে। তিনি সেনাবাহিনীকে জরুরী অবস্থায় কাজ করতে বললেও তারা সেটি নাকচ করে এবং পুলিশ জরুরী অবস্থায় ভূমিকা পালন করে। তারা এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছিল যে, বেন আলি আত্নসমর্পণ করবে না।
কিন্ত দেখা যায়, জরুরী অবস্থা জারীর পরপরই বেন আলি দেশ ত্যাগ করেন এবং তিউনিশিয়া এই একনায়কতন্ত্র থেকে রেহাই পায়। ৩০ বছর পর তিউনিশিয়ার মানুষজন স্বাধীনতার সুখ পায়। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক উপায়ে সেখানে নির্বাচন হয়। তিউনিশিয়ার এই বিপ্লবকে আরব বসন্ত বলা হলেও তারা এটিকে ‘জেসমিন রেভ্যুলেশন’ বলে থাকেন। বলা হয়ে থাকে যে এই আরব বসন্তের জন্য তিউনিশিয়াই অন্যতম একটি দেশ যারা তাদের লক্ষ্য আদায় করতে পেরেছে।
বিস্তার
তিউনিশিয়ার মতো ছোট একটি দেশের এই বিপ্লব সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য যেমন- মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, জর্ডান, মরক্কোর মতো দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক উত্থানের এই বিপ্লব যদিও সব দেশে একই ফলাফল বয়ে আনেনি। কিছু কিছু দেশে অবস্থা আরো মন্দ হয়েছে।
মিশর
২৫শে জানুয়ারী ২০১১ সালে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আঠারো দিন ব্যাপী বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভ রোধে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। তাহরির স্কয়ারে চলতে থাকা এই বিপ্লব মিশরের সেনাবাহিনীকে ভাবিয়ে তোলে। তারা হোসনি মোবারককে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন দেয়। নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের মুরসি ক্ষমতায় আসলেও টিকে থাকতে পারেনি। সেনাবাহিনী ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মুরসি ব্যর্থ’ দায় দিয়ে আবার ক্ষমতা দখল করে।
অর্থাৎ, জনগণ যেই গণতন্ত্র চাচ্ছিল, সেটি আর পাওয়া হয়নি। মিশরে সেনাবাহিনী সমর্থিত পুতুল সরকার ক্ষমতার আসনে বসে। আরব বসন্তের জের ধরে যেই উন্নতর জীবনের আশা মিশরীয়রা করেছিল তার সম্পূর্ণটাই ভেস্তে যায়।
লিবিয়া
লিবিয়ায় তৎকালীন সময়ে মুয়াম্মার গাদ্দাফি ৪২ বছর ধরে শাসনক্ষমতায় ছিল। গাদ্দাফির লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বের একাত্মতা তৈরি করা। এজন্য তিনি আলাদা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথাও বলেছিলেন। যাইহোক, আরব বসন্তের ছোঁয়া লিবিয়াতেও লাগলে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দলীয়রা লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজী দখল করে নেয়।
প্রতিবাদী মানুষদের সাথে গাদ্দাফি আপোষ করার পরিবর্তে উল্টো তাদেরকে সন্ত্রাসীসহ নানা অপবাদ দেয়। এতে করে অবস্থা বেগতিক হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, গাদ্দাফি আরব বিশ্বকে সুপারপাওয়ারদের বিরুদ্ধে একত্র করতে চেয়েছিলেন। এতে করে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আমেরিকা তার বিরুদ্ধে ছিল। ফলাফল হিসেবে ১৯৭৩ সালের জাতিসংঘের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজ্যুলেশন’ গ্রহণ করা হয় এবং লিবিয়াকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করে ন্যাটো আক্রমণ করে।
বিক্ষোভকারীদের হাতেই গাদ্দাফির মৃত্যু ঘটে। যেই ভিডিওটি এখনো ইন্টারনেট দুনিয়ায় আমরা দেখে থাকি। লিবিয়ার জনগণও তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নের দেশ গড়তে পারেনি। উল্টো দেশটি আজ কয়েকভাগে বিভক্ত এবং গৃহযুদ্ধে লিপ্ত।
সিরিয়া
বাশার আল আসাদ – একজন শিয়াপন্থী ক্ষমতাধর, যার পরিবার কয়েক যুগ ধরে সিরিয়াকে শাসন করছে। পুরাতন দামাস্কাস, আলেপ্পোর মতো শহরে তার এই রাজত্ব ধবংস করতে মানুষ জড়ো হয়। কিন্ত শেষমেশ লিবিয়া, মিশরের মতো তাদেরও লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বিক্ষোভ রুপ নেয় শিয়া-সুন্নিদের ক্ষমতার আসনে বসার। যেখানে ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব, রাশিয়া, আমেরিকার মতো দেশগুলোও জড়িয়ে পড়ে। কিন্ত আসাদকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ এখনো বিদ্যমান।
ইয়েমেন
আব্দুল্লাহ সালেহকে তার সরকারের বেকারত্ব, দুর্নীতি প্রকটতা লাভ করে। জনগণ ২৭শে জানুয়ারী বিক্ষোভ করে যা পরবর্তীতে আরো তীব্রতর হয়। তীব্রতার জেরে সালেহ দেশ ত্যাগ করেন এবং নতুন নির্বাচনে মন্সুর হাদি নির্বাচিত হন। কিন্ত দেশটিতে তবুও স্থিতিশীলতা আসেনি। হুথি বিদ্রোহীদের সাথে এখনো গৃহযুদ্ধ চলছে। এছাড়াও, সাধারণ মানুষের অবস্থা খুবই মর্মান্তিক যা আমরা মিডিয়াতে প্রতিনিয়তই দেখছি।
আরব বসন্তকে অনেকে শেষ বলে মনে করেন। কিন্ত আসলে আরব বসন্ত ততদিন শেষ হবে না যতদিন না পর্যন্ত এই অঞ্চলগুলোতে গণতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটছে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই অভ্যুত্থানটিতে হিতে বিপরীতই ঘটেছে বেশি। কেননা, মধ্যপ্রাচ্যের যেই অবস্থা ছিল আজ তা করুণ থেকে করুণতর। অর্থনৈতিক অবস্থা আজ বিপন্ন, ট্যুরিজম সেক্টর আগে যা ছিল তা আজ মৃত প্রায়। তাই এটাকে যতই বসন্ত বলা হোক না কেন, এটি বসন্তের মতো সুবাস আরব বিশ্বকে দিতে পারেনি।
Feature Source: npr.org References: 01. What was the Arab Spring and how did it spread? 02. How the Arab spring engulfed the Middle East – and changed the world. 03. What is the Arab Spring, and how did it start?