অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড: আধ খাওয়া আপেল যাদের লোগো

546
0

অ্যাপেল ইনকর্পোরেটেড (Apple Inc.) যা পূর্বে অ্যাপেল কম্পিউটার ইনকর্পোরেটেড (Apple Computer Inc.) ছিল। বর্তমানে এটি একটি আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশন। বর্তমানে তারা ইলেকট্রনিকস এবং সফটওয়্যার পণ্য ডিজাইন ও তৈরি করে থাকে। কোম্পানির সবচেয়ে পরিচিত হার্ডওয়্যার পণ্যের মধ্যে রয়েছে ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার, আইপড এবং আইফোন। 

অন্যদিকে, অ্যাপল সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে ম্যাকওএস এক্স অপারেটিং সিস্টেম, আইটিউনস মিডিয়া ব্রাউজার, মাল্টিমিডিয়া এবং প্রোডাক্টিভিটি সফটওয়্যারের আইওয়ার্ক স্যুট ইত্যাদি। এবং ফাইনাল কাট স্টুডিও, পেশাদার অডিও এবং ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রি সফটওয়্যার পণ্যগুলির একটি স্যুট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যাপেলের কয়েকশত খুচরা দোকানের পাশাপাশি অনলাইনে অ্যাপেল স্টোর এবং আইটিউনস স্টোর কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে কোম্পানিটি। 

ইতিহাস 

১৯৭৬-১৯৯৯, অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাকাল-

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে, যখন স্টিভ জবস হাই স্কুলে এবং স্টিভ ওজনিয়াক ইউসিএলএ বার্কলেতে পড়তেন তখন বিল ফার্নান্দেজ মাধ্যমে এই দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ফার্নান্দেজ ভেবেছিলেন তারা হয়তো দ্রুত বন্ধু হয়ে যাবে। কারণ, তাদের দুজনেরই ইলেকট্রনিকস এবং ব্যবহারিক কাজের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। স্টিভ জবস যখন আটারিতে কাজ করছিলেন, তখন তিনি গেম ব্রেকআউট নামে একটি প্রকল্পের সার্কিট বোর্ডে কাজের জন্য ওজনিয়াকের সাহায্য নেন। 

হোমব্রু কম্পিউটার ক্লাবের সদস্য হিসাবে ১৯৭৫ সালে তাদের আবার দেখা হয়। সেই বৈঠকের পরপরই, ওজনিয়াক নিজেই সাধারণ হোম পিসি তৈরির কাজ শুরু করেন। তিনি যখন তার নিয়োগকর্তা, হিউলেট প্যাকার্ডের (এইচপি) কাছে তার কাজ উপস্থাপন করেন, তখন তার কাজটাকে প্রত্যাখান করা হয়।

কিন্তু জবস হোম পিসির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই, ১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার কিউপারটিনোতে স্টিভ জবস এবং স্টিভ ওজনিয়াক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, কোম্পানিকে ‘অ্যাপল কম্পিউটার ইনকর্পোরেটেড’ নাম দেয়া হয়। 

অ্যাপলের প্রতিষ্ঠিতা স্টিভ জবস। Image Source: gettyimages.com

১৯৭৯ সালে, অ্যাপল প্রথম স্প্রেডশীট এবং ক্যালকুলেটর অ্যাপ, ভিসিক্যাল (VisiCalc) বাজারে নিয়ে আসে। ভিসিক্যাল দ্রুত ব্যবসার একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, অ্যাপল লিসা এবং ম্যাকিনটোশ নামে দুটি ব্যক্তিগত ধরনের কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু করে। 

যদিও লিসা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ছিল, যার ফলে ক্রেতারা উচ্চ মূল্যের জন্য কিনতে নিরুৎসাহিত হয়েছিল এবং বিক্রয় হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু এর সমকক্ষ, ম্যাকিনটোশ ছিল মসৃণ নকশা এবং দ্রুত গতির। যার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

২০০০ – ২০০৩, স্টিভ জবস কোম্পানিতে ফিরে আসেন- 

কোম্পানির তৎকালীন সিইও জন স্কুলির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে স্টিভ জবস একমত ছিলেন না। ম্যাকিনটোশের বিক্রয় বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে জবস কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার শেয়ার বিক্রি করে দেন। এরপর, স্টিভ জবস নেক্সট নামে পরিচিত একটি প্রকল্পে কাজ শুরু করেছিলেন। 

১৯৯৬ সালের দিকে, অ্যাপল ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে নেক্সট কিনে নেয়। অ্যাপল তার হার্ডওয়্যারে নেক্সট অপারেটিং সিস্টেমের কাজ শুরু করে। অন্তর্বর্তীকালীন সিইও গিল অ্যামেলিওকে পদচ্যুত করার পর স্টিভ জবস অ্যাপলের সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অ্যাপলের প্রথম চুক্তির মধ্যে একটি ছিল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে মাইক্রোসফট অফিস প্রকাশ করা। 

অ্যাপল কম্পিউটারের একটি প্রাথমিক সংস্করণ ম্যাকিনটোশ। Image Source: Shutterstock.com

২০০৪-২০০৭ এর মধ্যে অ্যাপল বিশ্বের সেরা একটি কোম্পানি হয়ে যায়- 

২০০১ সালে অ্যাপলের আইপড (iPod) মুক্তি পায়। এটি একটি পোর্টেবল মিউজিক প্লেয়ার যার মধ্যে ১,০০০টি গান ডাউনলোড করে রাখা যায়। যা পরবর্তীতে যখন খুশি তখন বাজানো যায়। তাছাড়া, এর মাধ্যমে আইটিউনস থেকেও সরাসরি গান ডাউনলোড করা যায়, যা অ্যাপলের অনলাইন মিউজিক স্টোর যেটি ২০০৩ সালে চালু করা হয়েছিল।  

২০০৭ সালে আইফোন মুক্তি পায়, যা মাল্টি-টাচ স্ক্রিন প্রযুক্তিসম্পন্ন, ইন্টারনেট ব্রাউজার এবং এমপিথ্রি (MP3) প্লেয়ারসহ একটি মোবাইল স্মার্টফোন ডিভাইস। এটি সিম্বিয়ান বা উইন্ডোজ মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেমের পরিবর্তে ওএস এক্স (OS X, Unix-এর উপর ভিত্তি করে) চলে। 

২০১০ সালে আইপ্যাড, একটি ট্যাবলেট কম্পিউটার হিসাবে মুক্তি পায়। যা একই সাথে সঙ্গীত এবং অন্যান্য মিডিয়া ফাইল চালাতে সক্ষম, অ্যাপ এবং গেম চালাতে পারে, ওয়েব সার্ফ করতে পারে, ই-বুক পড়তে পারে এবং আরও অনেক কিছু করতে পারে। যার ফলে এটি প্রথম পূর্ণ টাচস্ক্রিন কম্পিউটার হয়েও ভোক্তাদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল। 

২০০৭ সালের মাল্টি-টাচ স্ক্রিন আইফোন। Image Source: Shutterstock.com

২০০৮–২০১১, আইফোন এবং আইপ্যাডের বিভিন্ন সংস্কার উন্মোচিত হয়-

  • ২০০৮ সালে, অ্যাপেল আইফোন ৩জি (Apple iPhone 3G) সংস্কার উন্মোচিত হয়। 
  • ২০০৯ সালে, অ্যাপল আইফোন ৩জিএস (3GS) সংস্কার উন্মোচিত করা হয়। 
  • ২০১০ সালে, অ্যাপল আইফোন ৪ এবং আইপ্যাড সংস্কার উন্মোচিত করা হয়। 
  • ২০১১ সালে, আইফোন ৪এস এবং আইপ্যাড ২ সংস্কার উন্মোচিত করা হয়। 

২০১২–২০১৫, স্টিভ জবস মারা যায়, তবুও অ্যাপল শীর্ষেই থেকে যায়- 

  • দুঃখজনকভাবে ২০১১ সালে, স্টিভ জবস স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালে, টিম কুক আইপ্যাড মিনি এবং রেটিনা ডিসপ্লেসহ ১৩-ইঞ্চির একটি ম্যাকবুক প্রো প্রবর্তনের মাধ্যমে অ্যাপলের উদ্ভাবন অব্যাহত রাখেন।
  • ২০১২ সালের শেষের দিকে, স্টিভ জবস মারা যাওয়ার দুই বছর পর, সমালোচকরা ভাবতে শুরু করেন, যে অ্যাপল তার উদ্ভাবনী স্পর্শ হারিয়ে ফেলছে। কোম্পানিটি শুধু আইফোন ৫ এবং আইপ্যাড মিনির মতো নতুন পণ্য উদ্ভাবন করেছে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুনত্বের কোন দেখা নাই।

  • ২০১৩ সালে, টিম কুক আইওএস অপারেটিং সিস্টেমটিকে আইফোন এবং আইপ্যাডের পৃথক সংস্করণে ভাগ করেন। এই পরিবর্তনের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য আলাদা করে অ্যাপ তৈরি করতে হতো বিকাশকারীদের।

  • ২০১৫ সালে, বিশ্লেষকরা অ্যাপলের নতুন উদ্ভাবন অনেক কম হচ্ছে এবং প্রতিবেদন বের করেন যে, অ্যাপলের স্টক সেপ্টেম্বরের ৩৬ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু বিক্রয় এবং উদ্ভাবন সম্পর্কে এসব উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, অ্যাপল বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ব্র্যান্ড হিসেবেই থেকে যায়। তাদের ব্র্যান্ডের মূল্য ছিল ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। সুতরাং কারিগরি শিল্পে অ্যাপলের বিশিষ্ট অবস্থান বজায় রাখতে কুকের ভূমিকা ছিল। তার নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় আজও নতুন পণ্য এবং আপডেট অব্যাহত রয়েছে। 

সদর দপ্তর 

অ্যাপলের সদর দফতর সিলিকন ভ্যালির মাঝখানে, ক্যালিফোর্নিয়ার কিউপারটিনোতে অবস্থিত। অ্যাপলের এই ক্যাম্পাসে  ছয়টি ভবন রয়েছে; যার মোট আয়তন ৮,৫০,০০০ বর্গফুট। ২০০৬ সালের দিকে, অ্যাপল ৫০ একরের উপর দ্বিতীয় সদর দপ্তর তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। 

অ্যাপলের মূল সদর দপ্তর। Image Source: gettyimages.com

অ্যাপল পার্ক নামে পরিচিত নতুন সদর দপ্তর মূল সদর দপ্তরের প্রায় এক মাইল (১.৬ কিমি) পূর্বে কুপারটিনোতে অবস্থিত। যা ২০১৭ সালে চালু হয়। নরম্যান ফস্টারের স্কেল দ্বারা এবং বৃত্তাকার গ্রাউন্ডস্ক্র্যাপার ডিজাইন দিয়ে তৈরি কাঠামোটি ‘স্পেসশিপ’ এর মতো দেখতে। মনে হয় আকাশ থেকে মাদারশিপ নেমে আসছে। 

লোগো 

শুরুর দিকে অ্যাপলের প্রথম লোগো ছিল, একটি আপেল গাছের নিচে স্যার আইজ্যাক নিউটন বসে আছেন। কিছু দিনের ভেতরে পরিবর্তন আসে অ্যাপেল-এর লোগোতে। রব জ্যানফ আধা খাওয়া রেইনবো অ্যাপলের লোগো ডিজাইন করেন। অ্যাপেলের এই লোগোটিতে কামড়ের চিহ্ন আনা হয়, যাতে এটা অন্য কোন ফলের সাথে মিলে না যায়।   

অ্যাপলের প্রথম লোগো। Image Source: infobae.com

এক স্বাক্ষৎকারে রব জ্যানফ বলেন যে, একটা আপেল সবাই ক্রয় করতে এবং কামড়ও দিতে পারেন। তাই আধা খাওয়া লোগোর মাধ্যমে, বিশ্বের সব মানুষের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া তার ও স্টিভ জবসের উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৯৮ সালের পর থেকে অ্যাপলের লোগোর রঙ এখনও পর্যন্ত একই রাখা হয়েছে। কখনও সম্পূর্ণ নীল, ধূসর এবং কালো রাখা হয়েছে। 

স্লোগান 

১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে তৈরি হয়েছিল, অ্যাপলের প্রথম স্লোগান, ‘Bite in an Apple-বাইট ইন অ্যান অ্যাপল’। ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত অ্যাপল বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ‘ভিন্ন চিন্তা করুন (Think Different)’ স্লোগানটি ব্যবহার করে। স্লোগানটি তাদের ভাবমূর্তির উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল এবং মিডিয়া এবং গ্রাহকদের কাছে তাদের জনপ্রিয়তা পুনরুজ্জীবিত করেছিল। 

যদিও স্লোগানটি বাদ হয়ে গেছে, তবুও এটি অ্যাপলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাছাড়া, অ্যাপলের নির্দিষ্ট পণ্যের লাইনের জন্যও স্লোগান রয়েছে—উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালে আইম্যাকের (iMac)-এর প্রচারের সয়ম ‘iThink’ ব্যবহার করা হয়েছিল এবং আইফোনের বিজ্ঞাপনের সময় ‘সে হ্যালো টু আইফোন’ ব্যবহার করা হয়েছিল। 

অ্যাপলের পুরাতন স্লোগান। Image Source: wallpaper-house.com

বর্তমানে বিশ্বে অ্যাপল একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। নান্দনিক ডিজাইন এবং এর স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে, অ্যাপল দ্রুততার সাথে অনন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। ২০২১ সালে, অ্যাপলের নিট আয় ছিল ৯৪.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা এখন পর্যন্ত অ্যাপলের সর্বোচ্চ নিট আয়। তাছাড়া, একই বছর অ্যাপলের বিশ্বব্যাপী আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬৫.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। 

 

Feature Image:Shutterstock.com  
References: 

01. The-History-of-Apple-Inc.
02. The Apple-Inc.
03. About-Apple-Company-History-Timeline