হেলেন অব ট্র‍য়: সৌন্দর্যের অভিশাপ নাকি ভালোবাসার পরিণতি?

1007
0

হেলেন অব ট্র‍য় সম্পর্কে কমবেশি সবাই-ই অল্পবিস্তর জানে। তার জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না থাকলেও তার নাম শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্করই বটে। শুধু গ্রীক পুরাণেই তার কাহিনী সীমাবদ্ধ নেই। যুগে যুগে বহু কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে হেলেনকে তুলে ধরেছেন। 

ডিজিটাল মিডিয়ার এই যুগে সিনেমারও হচ্ছে প্রচুর। ২৫শ’ বছরেরও বেশি আগের গ্রীক মহাকাব্য এবং উপদেশমূলক কবিতাগুলো থেকে মূলত সর্বপ্রথম হেলেনের কথা জানা যায়। হেলেনের বর্ণনা পাওয়া যায় হোমারের ইলিয়াড, ওডিসিসহ ভার্জিলের ঈনিড-এ। এছাড়াও, হেলেনের কথা ঘুরেফিরে এসেছে এরিস্টোফেনিজ, সিসেরিও এবং ইউরিপিডিস-এর লেখাতে।  

সৌন্দর্য যেমন পূজনীয় তেমনই এটি যে ধ্বংসও ডেকে নিয়ে আসতে পারে হেলেনের জীবন কাহিনী সেটারই শিক্ষা দেয়। প্রাচীন গ্রীক কবি ও দার্শনিকদের উপস্থাপনার মাধ্যমে হেলেনের মিথ নারী সৌন্দর্যের বৈপরীত্যপূর্ণ প্রকৃতির অস্তিত্ব তুলে ধরে।  

তখনকার দিনে নারীদেরকে দেখানো হতো দেবতাদের কাছ থেকে পাওয়া আশ্চর্যজনক এবং পরম আকাঙ্ক্ষিত একটি উপহার হিসাবে। অন্যদিকে, বংশগতি রক্ষার উদ্দেশ্যে নারীর ভূমিকা তো বরাবরই অনস্বীকার্য। হেলেনের ঘটনার মাধ্যমে নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে এমনভাবে যে, নারী যেমন জীবন দিতে পারে তেমনি তার কারণে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে একটা গোটা জাতি। 

হেলেন অব ট্রয়। Image Source: artuk.org

শুধুমাত্র গ্রীস নয় সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী রমণী হিসাবে ধরা হতো হেলেনকে। হেলেন অব ট্রয়, হেলেন অব আর্গোস এবং হেলেন অব স্পার্টা নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ট্রয় এবং স্পার্টা শহর দুটির অবস্থান আজকের আধুনিক তুরস্ক এবং গ্রীস। হেলেন ছিল দেবরাজ জিউস এবং লিডার মেয়ে এবং ক্লাইটেমনেস্ট্রার বোন। এই ক্লাইটেমনেস্ট্রা ছিল আবার অ্যাগামেমননের স্ত্রী। ট্রয় যুদ্ধের পরে মাইসিনি-এর রাজা অ্যাগামেমনন ঘরে ফেরা নিয়ে ইস্কিলাস লিখেছেন তার বিখ্যাত ট্রাজেডি ‘অ্যাগামেমনন।’ 

মেনেলাউস-এর বিবাহিত স্ত্রী থাকা অবস্থাতে ট্রোজান রাজপুত্র প্যারিস-এর সাথে দেশান্তরি হবার ফলশ্রুতিতে সংগঠিত হয়েছিল ট্র‍য়ের সেই বিখ্যাত যুদ্ধ। দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ। ক্রিস্টোফার মার্লো তার ‘ডক্টর ফস্টাস’ বইতে হেলেনকে নিয়ে বলেছেন ”The Face That Launched A Thousand Ships.” 

হোমার তার ইলিয়াড-এর কাহিনী ট্রয় যুদ্ধের কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন। এটিতে যুদ্ধের শেষ কিছুদিনের ঘটনাপঞ্জি উল্লেখ করা আছে। এছাড়াও, অন্ধ কবি হোমারের দ্বিতীয় মহাকাব্য ওডিসি, রোমান কবি ভার্জিলের মহাকাব্য ঈনিড, ইস্কিলাসের অ্যাগামেমনন ট্রয়ের যুদ্ধের পরের ঘটনাবলী নিয়ে লেখা। 

হেলেন ও প্যারিস। Image Source: wbur.org

মজার ব্যাপার হলো, হোমারের ইলিয়াডে হেলেনের শারীরিক উপস্থিতি খুব একটা দেখা না গেলেও তার অস্তিত্ব সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজমান যেটি পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যদিও এটি ধারণা করা হয় যে, তিনি বুঝতে পারতেন তার প্যারিসের সাথে পালিয়ে যাবার ঘটনাকে স্পার্টানরা খুব ভালোভাবে নেবে না এবং স্বভাবিকভাবে অনাগত বিপদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। 

তবে ভালোবাসা সবসময়ই সবকিছুর উর্ধ্বে। এতকিছু ভেবে কি আর ভালোবাসা হয়? এক্ষেত্রে জর্জ বার্নার্ড শ’এর একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যাচ্ছে, “প্রেম একটি জলন্ত সিগারেট, যার শুরুতে আগুন এবং শেষ পরিণতি ছাই।” ঠিক এমনটাই ঘটেছিল হেলেন এবং প্যারিসের ক্ষেত্রে।  

হেলেনের নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ট্রয়ের যুদ্ধ। স্পার্টার রানী হেলেনের অপহরণের কারণেই অতি সমৃদ্ধশালী ও শক্তিধর এই নগরী একদিন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এই যুদ্ধ শুরু হবার পেছনের গল্পটিও খুব চমকপ্রদ। সেটি জানতে হলে পেছনে ফিরে দেখতে হবে।  

গ্রীক পুরাণের অনেকটা বড় জায়গা জুড়ে আছে দেবতাদের সংঘর্ষ এবং মরণশীল মানুষদের সচরাচরই তাদের এই সংঘাতের বলি হতে হতো। যেকোনো বিষয়ে তাদের পক্ষপাতিত্বও ছিল চোখে পড়ার মতো৷ দেখা যায়, কোন কোন দেবতা একটি বিশেষ জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল তো দেখা যাবে অন্য কেউ তাদের চক্ষুশূল।  

গ্রীক দেবতাদের অ্যানিমেটেড চরিত্র। Image Source: freepik.com

ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়েও তাদের এই প্রবণতা দেখানো নতুন কিছু না। ঘটনার সূত্রপাত হয় অলিম্পাসের তিন দেবী হেরা, অ্যাথেনা এবং আফ্রোদিতির মধ্যকার বিবাদ থেকে। কলহদেবী এরিসকে তার স্বভাবগত কারণে দেবতারা কোনো ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করতেন না। সেই ধারাতেই রাজা পিলিউস এবং জলদেবী থেটিসের বিয়েতেও সে নিমন্ত্রিত ছিল না। এতে ক্রুদ্ধ দেবী তাদের বিবাহসভায় ঝামেলা সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেন। বিবাহসভার কক্ষে তিনি নিক্ষেপ করেন একটি সোনার আপেল যেটির গায়ে লেখা ছিল, ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য’ কথাটি। 

সকল দেবী আপেলটির দাবিদার হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দিতা নেমে আসলো তিন দেবী আফ্রোদিতি, হেরা ও অ্যাথিনার মধ্যে। দেবরাজ জিউসকে বলা হলো তিনজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে নির্বাচন করতে। কিন্তু বুদ্ধিমান জিউস নিজেকে এই ঝামেলায় জড়াতে চাইলেন না। তিনি তাদেরকে ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। 

রাজকুমার প্যারিসের জীবন কাহিনীটাও খুব বিচিত্র। অনেকটা রাজা ঈদিপাসের মতোন। তিনি ভূমিষ্ঠ হবার আগে তার মা হেক্যুবাকে স্বপ্নে দেখানো হয় যে, তিনি যে পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে একদিন তার এই সন্তানই সমৃদ্ধশালী নগরীর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শংকিত রাজা-রানী তাদের সন্তানকে তুলে দিলেন জল্লাদের হাতে কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় রাজকুমার প্যারিস। 

যাইহোক, তিন দেবী নিজেদেরকে নির্বাচন করার জন্য নানাভাবে প্যারিসকে প্ররোচিত করে। দেবী হেরা তাকে কথা দেয়, এশিয়া ও ইউরোপের একছত্র অধিপতি বানিয়ে দেবার; দেবী অ্যাথিনা তাকে পৃথিবীর তাবদ জ্ঞানের ভাণ্ডার দেবার প্রতিশ্রুতি জানায়; সর্বশেষ দেবী আফ্রোদিতি তার দিকে মোক্ষম তীর ছুঁড়ে দেয়। তাকে প্রতিজ্ঞা করে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে এনে দেবার।

দুর্বল চিত্তের অধিকারী প্যারিস দেবী আফ্রোদিতির কথায় গলে তার হাতে তুলে দেয় আপেলটি। ইংরেজির বাগধারা, ‘An Apple of Discord’ এই ঘটনার কথায় মনে করিয়ে দেয়। মূলত ট্রয় যুদ্ধের সূত্রপাত এই ঘটনার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। এই যুদ্ধে আফ্রোদিতি থাকে ট্রয় তথা প্যারিসের পক্ষে, অন্যদিকে ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ হেরা ও অ্যাথিনা সাহায্য করে গ্রীকদের৷  

আফ্রোদিতিকে আপেল তুলে দেয়ার চিত্রকর্ম। Image Source: pinterest.com

এবার ফিরে আসা যাক হেলেনের কথায়। জিউস এবং লেডার কন্যা হেলেনের রুপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। নানা জায়গা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। হেলেনের পালক বাবা টিন্ডারিউস বেশ ভীত এবং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলেন এত জন প্রার্থীর মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে বাছাই করতে যেয়ে। কারণ তারা প্রত্যেকেই এসেছিল বিভিন্ন সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে। 

শেষমেশ টিনডারিউস একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি সকলের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নেন যে, তাদের মধ্যে থেকে যাকেই হেলেনের স্বামী হিসেবে নির্বাচন করা হোক না কেন সকলে তা নির্দ্বিধায় মেনে নেবে। এতে তিনি সফলও হলেন কারণ প্রত্যেকেই ভাবল তারা নির্বাচিত হবে। উপরন্তু, তারা এই কথাতেও একমত হলো যদি কেউ হেলেনকে অপহরণ করতে আসে তবে সবাই একজোট হয়ে হেলেনের স্বামীর পক্ষে দাঁড়াবে। 

অতঃপর টিনডারিউস হেলেনের স্বামী হিসাবে অ্যাগামেমননের ভাই মেনেলাউসকে নির্বাচিত করেন। তবে এখানেই শেষ নয়, তিনি মেনেলাউসকে নিজের রাজ্য স্পার্টার রাজা বলেও ঘোষণা করেন। 

মেনেলাউস এবং হেলেন। Image Source: Paintings by Johann Heinrich Wilhelm Tischbein (1751–1829)

এদিকে মেষপালক প্যারিস তার প্রকৃত পরিচয় ইতোমধ্যে জেনে গেছে। জলকন্যা ইনোনির প্রেম ভুলে আফ্রোদিতির প্রতিশ্রুতিতে সে জাহাজ সাজিয়ে স্পার্টার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাজা মেনেলাউস এবং রানি হেলেন তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। গ্রিকরা অতিথি এবং গৃহকর্তার সম্পর্ককে অনেক পবিত্র বলে মানতেন। স্বয়ং দেবরাজ জিউস ছিলেন অতিথেয়তার গ্যারান্টিদাতা ও রক্ষক। 

কিন্তু প্যারিস ভেঙে দিলেন সেই পবিত্র সম্পর্ক। দেবী আফ্রোদিতি হেলেনের মনে প্যারিসের জন্যে প্রেমের স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দেন। তার সক্রিয় প্ররোচনায় হেলেন এবং প্যারিসের মধ্যে প্রণয় গড়ে ওঠে। এদিকে একদিন রাজকার্যে মেনেলাউসকে ক্রিটের উদ্দেশ্যে যেতে হয়। এই মোক্ষম সুযোগটি কাজে লাগায় প্যারিস। 

মেনেলাউস বাড়ি ফিরে এসে দেখে তার বিবাহিত স্ত্রী প্যারিসের সাথে চলে গেছে। ক্রুদ্ধ মেনেলাউস প্রতিশ্রুতিস্বরূপ গ্রিসের রাজ্য অধিপতিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয়ে বিপুল রক্তক্ষয়ী সেই ট্রয়ের যুদ্ধ। যার ফলস্বরূপ ধ্বংস হয়ে যায় গোটা এক জাতি। 

মূলত ট্রয় যুদ্ধের কারণ যতটা না হেলেন ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল পৌরষত্বের অহং। তাদের রানিকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে অন্য কোন রাজ্যের রাজকুমার এটা কোনভাবেই গ্রীকরা মেনে নিতে পারছিল না। এভাবেই একটি নারীর জন্য সংগঠিত হয় দশ বছরব্যাপী যুদ্ধ। যার দরুণ অগণিত মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একটি পুরো জাতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। 

ট্রয়ের যুদ্ধের কল্পিত চিত্র। Image Source: The Rape of Helen, Mid of 17th c, Museo del Prado, Madrid. Fine Art Images

মহাকাব্যের পুরুষ নায়কদের মতো, হেলেন অব ট্রয় অমর হয়ে আছেন। কিন্তু শক্তি ও সম্মানের কাজের জন্য নয় বরং তিনি অমর হয়ে আছেন নিজেকে তার সাথে সাথে তার পরিবার ও রাষ্ট্রকে অপমানিত এবং বিশ্বাসঘাতকতাকারী অনন্যা সুন্দরী মহিলা হিসাবে।  

 

Feature Image: greekreporter.com
References:

01. Mythology by Edith Hamilton. 
02. Mythology by James Weigel Junor.  
03. চিরায়ত পুরাণ-খোন্দকার আশরাফ হোসেন।