পৃথিবীর সেরা স্থাপত্যের তালিকা করলে প্রথমেই যে নামগুলো আসবে, আয়া সোফিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। একসময় খ্রিস্টান বিশ্বের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র থেকে পরবর্তীতে মুসলিমদের অধিকারে এসে আয়া সোফিয়া বারবার নতুন করে সেজেছে। দুই মহাদেশের মাঝে অবস্থিত হওয়ার কারণে কেবল ধর্মীয় নয়, ইউরোপ এবং এশিয়া উভয় মহাদেশের স্থাপত্য ও অন্যান্য কারণে স্থাপনাটি ভিন্ন গুরুত্ব লাভ করেছে।
বর্তমানে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের সিদ্ধান্তে জাদুঘর থেকে একে মসজিদ করার ঘোষণায় পৃথিবীর কোথাও নিন্দা হয়েছে আবার অনেকে স্বাগতও জানিয়েছে। কিন্তু চার্চ হোক বা মসজিদ, আয়া সোফিয়া ঐতিহাসিক কারণে তার গুরুত্ব এখনো আগলে রেখেছে। আজকের আলোচনা সেই ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়াকে নিয়েই।
নির্মাণের শুরু
বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের সময়ে এই স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। ৫৩২ এবং ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল হিসাবে এটি নির্মিত হয়। মূল অংশটি মাইলাতাসের গ্রীক জিওমিটার ইসিডোর এবং ট্রেলসের অ্যান্থিমিয়াস ডিজাইন করেছিলেন। গুজব আছে, জাস্টিনিয়ান বুঝতে পারছিলেন না এটি কোথায় তৈরি করবেন।
এমন সময় একদিন তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে স্থানটি সম্পর্কে নির্দেশনা পান এবং সেখানেই এটি তৈরি করেন। এর আগেও থিওডিসিয়াসের সময়ে এখানে একটি গির্জা ছিল। নিকা রায়টের সময় সেটি পুড়ে গেলে এখানেই নতুন গির্জা তৈরি করেছিলেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান। ইতিহাসে তিনি অন্যতম সেরা রোমান সম্রাট হিসেবে পরিচিত।
আয়া সোফিয়া নির্মাণ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এটি তৈরিতে আগের মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করা হয়েছিল। এমনকি জেরুজালেম থেকেও কিছু উপাদান আনা হয়েছিল। আয়া সোফিয়া সম্পর্কে বাইজেন্টাইনদের বিশ্বাস, এর নির্মাণ সামগ্রী কোন সাধারণ স্থাপনা হতে আসেনি; বরং এসেছে খোদ সলোমনের উপাসনালয় হতে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান নিজে এর নির্মাণের তদারক করতেন। প্রচলিত আছে নির্মাণ সমাপ্ত হলে, ‘সলোমন, আমি আপনাকে অতিক্রম করে গেছি’ বলে সম্রাট জাস্টিনিয়ান চিৎকার করেছিলেন।
মূলত সম্রাট জাস্টিনিয়ান এমন একটি স্থাপনা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা তাঁকে অমর করে রাখবে। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় এবং উচ্চাভিলাষী স্থাপনাটি তৈরি করার মাধ্যমে তিনি নিজেকে সম্রাট সলোমনের সাথে তুলনা করেছিলেন। অবশ্য এই স্থাপনা কেবল জাস্টিনিয়ানের নিজস্ব কীর্তি ছিল না; তার সাম্রাজ্যের আরও অনেকের অবদান ছিল। এমনকি ভুলে যাওয়া যাবে না যে, কন্সট্যান্টনিয়াস এবং থিওডিসিয়াসের পূর্ববর্তী স্থাপনার উপরেই তিনি নিজের কীর্তি স্থাপিত করেছিলেন।
নকশা
আয়া সোফিয়া তৎকালীন এবং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর স্থাপনা। জাস্টিনিয়ান যে নকশার উপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করেছিলেন, সেই সম্পর্কে উপকথা প্রচলিত আছে। স্থপতিদের দেওয়া কোন নকশাই সম্রাটের মনে দাগ না কাটায় অতৃপ্তি নিয়ে সম্রাট সেদিন বিছানায় গিয়েছিলেন। স্বপ্নে তিনি দেখেন আয়া সোফিয়া যেখানে তৈরি হবে সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এবং এমন সময় এক দেবদূত সেখানে উপস্থিত হয়।
দেবদূত প্রথমে বামদিকে দৃষ্টি দেন এবং এক কোণায় গিয়ে স্থির হলে সম্রাট সেখানে পৌঁছে দেবদূতের হাতে একটি রুপার থালা দেখতে পান। সেখানে একটি গির্জার ছবি আঁকা। আশ্চর্যভাবে এই নকশাটিই সম্রাটের পছন্দ হয়ে গেলে তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যেন ঘুম ভাঙার পরও নকশাটি তার মনে থাকে।
স্থাপনাটি দাঁড়িয়ে আছে এর পুরনো নকশারই উপর। তবে সেখানে নানা পরিবর্তন এসেছে। আমরা যদি জাস্টিনিয়ানের সময়ের আয়া সোফিয়ার সাথে বর্তমান আয়া সোফিয়া তুলনা করি তবেই সেটা বুঝা যাবে। মূল আয়া সোফিয়া তৈরি হয়েছিল বিস্তৃত স্থান নিয়ে। বড় বড় খিলান এবং নকশাকাটা দেওয়ালের এই দালানের ছাদ তখনও এখনকার মতোই অনেক উঁচু ছিল। উপরের দিকে জানালা কাটা হয়েছিল যেন আলো প্রবেশ করতে পারে। এসব জানলা খুব কৌশলের সাথে তৈরি হয়েছিল যেন আলোর সঙ্গে বাতাসের ব্যবস্থাও থাকে। আয়া সোফিয়ার মূল প্রবেশপথ বিস্তৃত এবং আরও ছোটখাটো প্রবেশপথ ছিল।
হাতবদল এবং পরিবর্তন
প্রথমে অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে আয়া সোফিয়া স্থাপিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় শাসনে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবেই ব্যবহার করা হয় এটিকে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে এটিকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তর করা হয়; যা ১২৬১ সাল পর্যন্ত বলবত ছিল। পরবর্তীতে পুনরায় অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয় এবং ১২৬১-১৪৫৩ সাল পর্যন্ত সেভাবেই ছিল।
খ্রিস্টান সমাজ হলেও তাদের মধ্যে কিছু নীতিগত বিভেদ ছিল। ফলে আয়া সোফিয়ার ভেতরের নকশা বদলে যায়। অর্থোডক্স আমলে তাদের নীতি অনুসারে অলঙ্করণ করা হয় এবং ক্যাথোলিক চার্চের সময়েও অঙ্গসজ্জা বদল হয়। কিন্তু তা আংশিক। পরবর্তীতে মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে আয়া সোফিয়া পুরোপুরি বদলে যায়।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ফতেহ সুলতান মুহাম্মদের ঐতিহাসিক কন্স্টান্টিনোপল জয়ের মাধ্যমে তুরস্ক মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অটোমান বিজয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হয়। ‘ইম্পিরিয়াল মসজিদ’, নামে পরবর্তী প্রায় ৫০০ বছর স্থায়ী হয় আয়া সোফিয়া। বর্তমানে তুরস্কের প্রধান মসজিদ সুলতান আহমেদ মসজিদ, যা ‘ব্লু মসজিদ’ নামে পরিচিত, স্থাপিত হয় ১৬১৬ সালে। কিন্তু এই মসজিদ স্থাপনের পূর্বে ‘ইম্পিরিয়াল মসজিদ’ই ছিল তুরস্কের প্রধান মসজিদ।
মসজিদে রূপান্তরের পর আয়া সোফিয়ার তুমুল পরিবর্তন হয়। দেওয়ালে মার্বেল পাথরে অঙ্কিত যীশু খ্রিস্টের অনেকগুলো ছবি সিমেন্ট দিয়ে মুছে দেওয়া হয়। ছবিগুলো প্রায় ৫০০ বছরের জন্য সিমেন্টের নিচে চাপা পড়ে। অটোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের আদেশে স্থপতিরা নতুন বিন্যাসে একে সাজান। ফলে অটোমান এবং মুসলিম স্থাপত্য রীতি মিলে আয়া সোফিয়া আরও সমৃদ্ধ হয়। তবে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, যীশু বা মেরীর ছবি মুছে ফেলা বা ঢেকে দেয়ার ফলে সংস্কৃতির একটি অংশ চাপা পড়ে যায়।
এরপর এই স্থাপনাটি ১৯৩৫ সালে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি ও স্বাধীন তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক জাদুঘরে রূপান্তর করেন। জাদুঘরে রূপান্তরের পর ছবিগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়। এছাড়া আয়া সোফিয়ার জন্য নতুন নিয়ম প্রবর্তন হয়। প্রধান নিয়মটি হল,
এই স্থাপনার মূল অংশ বা হলরুম ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ; সেটি মুসলিম অথবা খ্রিস্টান ধর্ম উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই স্থাপনার উভয় ধর্মের জন্য আলাদা সংরক্ষিত জায়গা রয়েছে। অর্থাৎ এই কমপ্লেক্ষটিতে একটি মসজিদ ও একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। যা শুধুমাত্র যাদুঘরের কর্মচারী কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত।
রাজনৈতিক গুরুত্ব
রাজনৈতিক কারণে আয়া সোফিয়া গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে অবস্থিত হওয়ার কারণে বরাবরই বিজেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল আয়া সোফিয়া। জাস্টিনিয়ান যেমন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তেমনি পরবর্তীতে ফতেহ সুলতান মুহাম্মদও আয়া সোফিয়া দখল এবং নতুন করে সাজানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন। আসলে বলা চলে, আয়া সোফিয়া হয়ে উঠেছিল তুরস্কের প্রাণ ভোমরা। শহরের মালিক যারা হয়েছেন তারাই এর দখল নিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধু সিদ্ধান্ত সম্ভবত ছিল মোস্তফা কামাল পাশার। এমন একটি স্থাপনা নিয়ে তিনি যে নিয়ম প্রবর্তন করেন তা প্রশংসার দাবীদার।
বর্তমান সময়ে এসেও আয়া সোফিয়া রাজনীতির শিকার। তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে নিজের ক্ষমতা আরও প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে আবার আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করে। এতে অবশ্য মুসলিম বিশ্বের অনেকে খুশি কিন্তু আবার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাকে ধর্মীয় ট্যাগ লাগানোয় অনেকেই এরদোয়ানের সমালোচনা করেছেন। এতে মূলত আয়া সোফিয়ার কিংবদন্তী বাড়ল।
কিংবদন্তী
কুমারী মেরির হাতের ছাপ: আয়া সোফিয়ার একটি স্তম্ভে একটি হাতের ছাপ পাওয়া যায়। অনেকেই বিশ্বাস করে, এটি কুমারী মেরির হাতের ছাপ। আবার অন্যদিকে অনেকে বিশ্বাস করেন, অনেক উঁচুতে থাকা হাতের এই ছাপ সলোমনের কোনো এক দৈত্যের; কেননা তারা এও বিশ্বাস করে যে, আয়া সোফিয়ার নির্মাণ সামগ্রী সত্যিই সলোমনের উপাসনালয় হতে এসেছে যিনি তার উপাসনালয় জ্বিনদের দ্বারা তৈরি করেছিলেন।
আশ্চর্য স্তম্ভ: কথিত আছে, সম্রাট জাস্টিনিয়ান মাথাব্যথায় ভুগতেন। কোন উপায়ে সে রোগ সারানো করা সম্ভব হয়নি। মাঝে মাঝে ব্যথা অসহ্য বোধ হলে তিনি আয়া সোফিয়ায় গিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন। একদিন প্রার্থনা করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে একটি স্তম্ভে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। পবিত্র সেই স্তম্ভে মাথা রেখে ঘুমানোর পর জাস্টিনিয়ানের মাথাব্যথা সেরে যায়। একথা ছড়িয়ে পড়লে মানুষ আয়া সোফিয়ায় এসে সেই স্তম্ভ স্পর্শ করে নিজেদের রোগমুক্তির প্রার্থনা করত।
জাদুকরি পাথর: নির্মাণ শুরু হলে জাস্টিনিয়ান বিভিন্ন প্রদেশ থেকে উৎকৃষ্ট পাথর চেয়ে পাঠান। সেসব প্রদেশ থেকে আগত মার্বেল পাথরগুলো কেবল সুন্দরই নয়; অনেকে বিশ্বাস করত এসব পাথরের কোন কোনটি ভবিষ্যৎও বলতে সক্ষম।
কিংবদন্তী আর বাস্তব মিলিয়ে আয়া সোফিয়া আজও পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা। স্থাপনের সময় থেকেই স্থাপত্য এবং শৈল্পিক দিক বিচারেও আয়া সোফিয়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা কীর্তি। জাস্টিনিয়ান থেকে এরদোয়ান পর্যন্ত সকল শাসকই আয়া সোফিয়ায় নতুন কিছু না কিছু সংযোজন করেছেন।
নানা ধর্ম, গোত্র আর ক্ষমতার হাতে পড়ে এটি নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, পরিণত হয়েছে একটি বাস্তব কিংবদন্তীতে। ভবিষ্যতেও যদি বারবার নানা বদলের সম্মুখীন হয়, আয়া সোফিয়া টিকে থাকবে নিজের মতো করে।
Feature Image: Getty Images.
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Hagia Sophia.
02. Hagia Sophia.
03. Hagia Sophia.