গিলোটিন: কষ্টহীন মৃত্যুদন্ডের মৃত্যুযন্ত্র

2435
0

গিলোটিন (Guillotine) এক ভয়াবহ যন্ত্র, এক মৃত্যুকূপের নাম। অতীতে একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে। গল্প উপন্যাসে আমরা বহুবার দেখেছি রাজা বাদশাহদের প্রিয় ছিল শিরচ্ছেদ করা। তাদের কাছে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা উৎসবের মতো। আর সেই উৎসবের মধ্যমণি একটা নয় বরং দুটো ছিল, এক যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে; আর দুই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে যে যন্ত্রটা ব্যবহার করা হচ্ছে। তেমনই এক যন্ত্রের নাম গিলোটিন।  

শিরচ্ছেদ করার পদ্ধতি আসলে বেশ কঠিন ছিল। এক কোপে খুব কম সময়ই শিরচ্ছেদ হতো। দুই থেকে তিনবার করে কোপ দিলে এরপরে মাথা থেকে ধড় আলাদা হতো। এতে ভিক্টিমের মৃত্যু খুব কষ্টের হতো। মূলত সেই চিন্তাকে মাথায় রেখেই গিলোটিন আবিষ্কার করা হয়েছিল। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। চলুন ঘুরে আসি ইতিহাসের পাতা থেকে।  

১৭৮৮ সালের দিকে মাথুরিন নামে এক ব্যক্তিকে এক বাড়ি দিয়ে খুন করা হয়। এক বারে খুন হওয়া এই ঘটনা সবাইকে বেশ নাড়া দেয়। বান্ধবী হেলেনকে বিয়ে করা নিয়ে জীনের সাথে হাতাহাতি হয় বাবা মাথুরিনের। একটু রেগে গিয়ে এক বাড়িতে বাবাকে মেরে ফেলেন জীন। সেই থেকেই বোধহয় একবারে কিভাবে হত্যা করা যায় সেটা নিয়ে কাজ শুরু হয়। যার ফলাফল হিসেবে আসে গিলোটিন। 

১৭৮৯ সালের দিকে যখন ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ঘটে তখন ড. জোসেফ ইগনেস গিলোটিন নামে এক ব্যক্তি এই অদ্ভুত যন্ত্রের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন। মৃত্যুদন্ডকে তুলনামূলক কম কষ্টকর করার ভাবনা এবং রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব সবার জন্য একই ধরনের মৃত্যুর উপায়, এসব ভাবনা থেকেই এই যন্ত্রের আবিষ্কার। প্রথমে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় কমিটি। গিলোটিন ১৭৯০ এর শেষের দিকের আবিষ্কার হয়েছিল। কিন্তু এর সূচনা হয়েছিল আরো বহু বছর আগেই। 

১৭৯৩ সালে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার একটি চিত্র। Image Source: La Guillotine en 1793 by H. Fleischmann (1908), Wikimedia

মধ্যযুগে জার্মানীতে একই ধরনের একটা হত্যাযন্ত্র ব্যবহার হতো, নাম ছিল ‘প্ল্যাঙ্ক।’ এছাড়া ইংরেজরা একই ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করত ‘হালিফ্যাক্স গিবেট’ নামে। তবে আরো মজার ব্যপার হলো, এই ফ্র্যান্সের গিলোটিন দুইটি মেশিন থেকে অনুপ্রাণিত। একটি ম্যাননিয়া এবং অন্যটি হচ্ছে স্কটিস মেইডেন। ষোল থেকে আঠারো শতকে প্রায় একশ বিশ জন এর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, এই যন্ত্রের সাহায্যে। এছাড়াও, ফরাসি বিপ্লবের বেশ আগে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হতো।  

১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিল এক দস্যুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই গিলোটিনের যাত্রা শুরু হল। কেবলমাত্র ফরাসি বিপ্লবের সময় এই গিলোটিন প্রাণ কেড়ে নেয় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের। ভাবুন তো, প্রায় দু’শ বছর ধরে এই যন্ত্র কত জন মানুষের প্রাণ নিয়েছে? ব্যথাহীন এক মৃত্যু! কিন্তু আদৌ কি তা ব্যথা বা অনুভূতিহীন ছিল? 

রাজা ষোড়শ লুইস, রানী ম্যারি অ্যান্তোনেইটসহ বেশ কিছু রাজ পরিবারের সদস্যের মৃত্যু ঘটে এই গিলোটিনের ব্লেডে। আবার একটা ভয়ানক তথ্য প্রচলিত ছিল, গিলোটিন এর আবিষ্কারক নাকি এই গিলোটিনেই প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পায়, নিহত গিলোটিন ছিলেন অন্য এক ব্যক্তি। নিজের আবিষ্কারে, নিজের প্রাণ খুইয়েছিলেন আর কি! আচ্ছা তাঁর মধ্যে কি কোন অনুতাপ ছিল এই গিলোটিন বা কষ্টহীন মৃত্যুদন্ডের মৃত্যুযন্ত্র আবিষ্কার করে?  

আতঙ্কের যুগ বা রেইন অফ টেরর চলাকালীন গিলোটিনে শিরচ্ছেদের একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। Image Source: Pierre-Antoine Demachy, in the Carnavalet Museum, Paris.

১৭৮০ সালের দিকে কিছু পরিবর্তন আনা হয় এই ভয়ংকর যন্ত্রে। ১৯৭৭ সালে ফ্রান্সে আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয় এই গিলোটিন। এর আগে ১৯৩৯ সালে প্রকাশ্যে গিলোটিনের ব্যবহার বন্ধ করা হলেও, গোপনে ব্যবহৃত হতে থাকে এই যন্ত্র।  

আমরা মানুষেরা বড্ড অদ্ভুত। নাহলে ভাবুন তো এই গিলোটিন নামক ব্যথাহীন, কষ্টহীন মৃত্যুদন্ডের মৃত্যুযন্ত্র (Painless Death Instrument) বাচ্চাদের খেলনা থেকে কিভাবে সাজসামগ্রী বানিয়ে ফেলি? এই ভয়ানক মৃত্যুযন্ত্রের রেপ্লিকা হিসবে দুফুট উচ্চতার এক গিলোটিন ব্যবহার হত বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে, এমনকি মহিলাদের কানের দুল হিসেবেও এটি ১৭৯০ সালের দিকে জনপ্রিয়তা পায়। 

বাচ্চাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এই খেলনাতে, পুতুলের শিরচ্ছেদ করতো বাচ্চারা। নিঃসন্দেহে এক ভয়াবহ মানসিক অসুস্থতার দিকে যাচ্ছিল তারা। কিছু কিছু এলাকাতে এই ধরনের খেলনা বন্ধ করে দেয়া হয়। মানুষের খেয়াল কি অদ্ভুত, এমনকি অভিজাত পরিবারের ডিনার টেবিলে উঠে এসেছিল গিলোটিন। সবজি আর ফল কাটার কাজে ব্যবহার করা হতো। তাদের চোখে কি কখনো ভেসেছিল মৃত দেহ আর মাথার আলাদা চিত্র? ছলকে উঠেছিল রক্ত? 

এদিকে গিলোটিনের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছিল, সাথে বাড়ছিল এর পরিচালকের পদমর্যাদা। সেই সময়ের সকল প্রতিষ্ঠিত আর জনপ্রিয় পরিবারের সদস্যরা যেমন – স্যানসন এবং ডেইব্লারস বংশপরম্পরায় গিলোটিন পরিচালনা করতেন। কত হাজার হাজার খুনের সাক্ষী তারা! কত রক্ত, কত শির নিয়ে তারা উচ্ছ্বাস করেছেন। এমনকি এই দুই পরিবারের নাম জপতো সেই সময়ের সাধারণ মানুষেরা, বিপদ থেকে বাঁচার আশায়। ১৮৭৯ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত লুইস ডেইব্লার এবং এনাটল ডেইব্লার এই হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। সম্ভবত উনারায় ছিলেন প্রকাশ্যে খুন করা শেষ হত্যাকারী।

খুব অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এরা জল্লাদ বা শিরচ্ছেদকারী হলেও এদের চালচলন,পোশাক-পরিচ্ছদ অনুকরণ করা হতো। বিশেষ করে ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিছু ব্যক্তি থেকে শুরু করে, বড় বড় সন্ত্রাসীরা এই পরিবারের নামে হাতে ট্যাটু (Tattoo) করতেন।   

এদিকে জার্মানিতে তৃতীয় রেইস এর সময় থেকে এই গিলোটিন ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৯৩০ এর দিকে সমগ্র জার্মানি জুড়ে ২০ টির মত শিরচ্ছেদ যন্ত্র বসানো হয়। হিটলারের নির্দেশে বসানো এই যন্ত্র ১৬,৫০০ এর মত প্রাণ কেড়ে নেয় ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অনেক যোদ্ধা ছিলেন।

জার্মান নাৎসী বাহিনী ও গিলোটিন। Image Source: themirror.uk

এই তো কিছুদিন আগেও গিলোটিন ব্যবহার করা হতো। হামিদা ডেজান্ডৌবি নামের এক খুনী ছিল এই গিলোটিনের শেষ শিকার। ১৯৭৭ সালে তাঁকে হত্যার পরে গিলোটিন সম্ভবত আর রক্তের স্বাদ পায়নি। ১৯৭৭ সালে শেষ হত্যা হলেও অফিশিয়ালি ১৯৮১ সালে এই যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা হয়। 

একদিকে এই মৃত্যুগুলো যেমন নৃশংস ছিল, ঠিক তেমনি যারা এর সামনে পেছনে কাজ করতেন, তারাও ছিলেন অমানবিক। মৃতের খণ্ডিত মস্তকে ব্লাড পাম্প করে, চোখ খোলা রাখতে বলে, গালে চড় মেরে তারা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন খন্ডিত মস্তকে প্রাণের সঞ্চার হয় কিনা কিংবা কথা বলে কিনা! কতটা অসুস্থ মস্তিষ্কের হলে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসা সম্ভব, বলুন তো! 

এই অসুস্থ চিন্তার আরো একটা গল্প বলি, আমরা যেমন আয়োজন করে থিয়েটারে যাই, পার্কে যাই, মুভি দেখতে যাই, সেই দু’শ বছরে দল বেঁধে মানুষ খুন হওয়া দেখতে যেত। গিলোটিনে কিভাবে শিরচ্ছেদ করা হয় তা দেখার জন্য দলে দলে লোক জমা হতো। থিয়েটারকে বাড়িয়ে লোকের জন্য জায়গা করতে হতো। এমনকি কিছু মানুষ ছিল যারা সামনের সারিতে গিয়ে বসতেন, যাতে শির ছেদ হওয়া ভালো করে দেখা যায়।

ভাবতে অবাক লাগে, এরা কি মানুষ ছিলেন? নাকি অন্য জগতের কেউ? ঠিক মেলার মতো জমত সেসব দিনগুলো। ভিক্টিমের নামের গান, নানা রকমের ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্ট সুভ্যেনির এর মেলা বসতো চারিদিকে। 

আস্তে আস্তে ইতিহাসের পাতায় হারিয়েছে গিলোটিনে যারা মারা গেছে তারা। কিন্তু আজো রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়ে কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে গিলোটিন কালের সাক্ষী হয়ে। রক্তের দাগ নিয়ে।  

 

Feature Image: answerreserachjournal.org
তথ্যসূত্র:

01. The Guillotine & the French Revolution.
02. 8 Things You May Not Know About the Guillotine.
03. The Bloody Family History of the Guillotine.
04. The Guillotine.
05. The guillotine falls silent.