এই পৃথিবীতে প্রায় ৭ বিলিয়ন মানুষ রয়েছে, যাদের রয়েছে নিজস্ব মত, পছন্দ-অপছন্দ, রয়েছে ভিন্ন রুচি। মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বস্ত্র, সবার পছন্দ-অপছন্দ এক না হওয়ায়; তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের, বিভিন্ন রুচির বস্ত্রসম্ভার। আধুনিক যুগে যার নাম হচ্ছে ফ্যাশন। আর এই ফ্যাশনের কথা আসলেই যেই নামটি সবার প্রথমে মাথায় আসে-গুচি। বিশ্ব নন্দিত ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচি নিয়েই আজকের আয়োজন।
যাত্রা শুরু
সময়টা ১৯২১ সাল, একজন পাঁচ তারকা হোটেলের লিফটম্যান এবং পোর্টারের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে বিশ্বনন্দিত ব্র্যান্ড, যেই ব্র্যান্ডকে সবাই চেনে ‘ধনীদের ব্র্যান্ড’ হিসেবে; বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘গুচি’। আজ থেকে ঠিক ১০৩ বছর আগে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে গুচিও গুচি নামের একজন পোর্টার, পরবর্তীতে ফ্যাশন ডিজাইনার ও ব্যবসায়ী তিনি ধনী, উচ্চবিত্তদের জন্য ফ্যাশনেবল বিলাসবহুল লাগেজ তৈরি মাধ্যমে গুচি’র যাত্রা শুরু করেন। গুচিও গুচি-র শেষ নাম দিয়ে ব্র্যান্ডটির নামকরণ করা হয় গুচি।
ব্র্যান্ডটি ইতালির হলেও বেশিরভাগ পণ্য লন্ডনের ফ্যাশন দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। অনেকেই মনে করেন, গুচিও গুচি কিশোর বয়সে লন্ডনের সেভয় হোটেলের পোর্টারের কাজ করার সময় তাকে লন্ডনের ফ্যাশন অনেকটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পাশাপাশি এইচ জে কেভ এ্যান্ড সন্সের মতো লাগেজ কোম্পানি তাকে ভ্রমণ ব্যাগ এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রী তৈরি করার কাজে অনুপ্রাণিত করেছে।
তিনি সেভয় হোটেলের চাকরি ছেড়ে এইচ জে কেভ এ্যান্ড সন্স কোম্পানিতে কাজ করেছেন এবং সেখান থেকে ফ্যাশন সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছেন। তারপর তিনি লন্ডন থেকে ফিরে এসে ইতালির ফ্লোরেন্সে ‘গুচি’-র যাত্রা শুরু করেন।
পণ্যের ধরণ
গুচির যাত্রা শুরু হয় চামড়াজাত পণ্য দিয়ে। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটি ছিল গুচিও গুচির পরিবারের একক মালিকানাধীন। চামড়াজাত পণ্যের মধ্যে ছিল ঘোড়সওয়ারদের জন্য স্যাডল, চামড়ার ব্যাগ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র। গুচিও তার ছেলে আলডোরের জেদ রক্ষা করতে গিয়ে রোম শহরে ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় দোকান উদ্বোধন করেন। এরপর, ১৯৫১ সালে গুচিও গুচি মিলান শহরে তাদের তৃতীয় দোকান খোলেন।
তিনি ব্যবসা ছোট রাখতে চেয়েছিলেন এবং যখন তিনি বেঁচেছিলেন, কোম্পানিটি কেবল ইতালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে আলডো গুচি ব্র্যান্ডটিকে একটি আন্তর্জাতিক পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছিলেন। গুচিও গুচির মৃত্যুর (১৯৫৩ সালে) দুই সপ্তাহ আগে তার ছেলে আলডো নিউইয়র্ক শহরে গুচি বুটিক দোকানটি খোলেন। পরে তিনি ব্যবসাকে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোয় প্রসারিত করেছিলেন।
যাত্রা শুরুর কয়েক দশকে এটি একটি জেনেরিক ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত পায় কিন্তু স্বীকৃতি পায় ১৯৫৩ সাল থেকে। সেই বছর এলিজাবেথ টেলরের একটি ছবি লাইম লাইটে এসেছিল, সেখানে তাকে দেখা যায় বাঁশের তৈরি নিসপএকটি ব্যাগ ধরে থাকতে।
এরপর ১৯৬১ সালে আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকলিন কেনেডিকেও একটি গুচি ব্যাগ বহন করতে দেখা যায়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি সেই ব্যাগের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘দ্য জ্যাকি’; ধীরে ধীরে নামী সেলিব্রেটিরা এই ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে।
১৯৮১ সালে গুচি প্রথম পরিধানের জন্য রেডি টু ওয়্যার ফ্যাশন শোয়ের আয়োজন করেছিল। সেইবারের কালেকশনটি ছিল ‘ফ্লোরা’ প্যাটার্নের উপর যা খুব বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ফ্যাশন শো-টি ইতালির ফ্লোরেন্সের সালা বিয়ানকা, পালাজো পিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ছন্দপতন
পরবর্তী কয়েক দশক ধরে, গুচি বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। গুচিও-এর নাতি-নাতনিরা ৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে কোম্পানিতে কাজ করছিলেন, এবং তৎকালীন সময়েকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে লেগে যায় পরিবারিক দ্বন্দ্ব।
অবশেষে, রডলফোর ছেলে; মাউরিজিও, ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং তার চাচাতো ভাই এবং চাচা আল্ডোকে কোম্পানি থেকে বের করে দেন। এরপর ১৯৮৯ সালে, একটি শেয়ার হোল্ডার কোম্পানি, ইনভেস্ট করপ (Investcorp), গুচির প্রায় অর্ধেক শেয়ার নিয়ে নেন।
বার্গডর্ফ গুডম্যানের প্রেসিডেন্ট, ডন মেলো এবং হেড অব এক্সেসরিজ-রিচার্ড ল্যাম্বার্টসনকে তখন নিয়োগ করা হয় ব্যবসার পুনরুদ্ধারের জন্য।
ঘুরে দাঁড়ানো
গুচির ব্যবসায় আসল পরিবর্তনটি আসে ১৯৯০ সালে, যখন টম ফোর্ড নামে একজন প্রতিভাবান তরুণ ডিজাইনার কোম্পানিতে আসেন। প্রাথমিকভাবে, তিনি গুচির রেডি টু ওয়্যার কালেকশনের তত্ত্বাবধান করছিলেন, কিন্তু ১৯৯৪ সালে ফ্যাশন হাউসের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত হন।
সেই সময়ে, মাউরিজিও গুচি তার বাকি শেয়ার Investcorp-এর কাছে বিক্রি করে দেন। এর ঠিক কয়েক বছর পর ১৯৯৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়। আজ অবধি, টম ফোর্ডকে বিবেচনা করা হয় এমন একজন ডিজাইনার হিসেবে যিনি সত্যিকার অর্থেই গুচিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি হাইপারসেক্সুয়াল ডিজাইন এবং প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তার ১৯৯৫ সালের ফল কালেকশন ছিল মসৃণ এবং নজরকাড়া ডিজাইন যা বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক সফলতা লাভ করে এবং গউইনেথ প্যালট্রো, জেনিফার লোপেজ এবং ম্যাডোনার মতো সেলিব্রেটিরা সেই কালেকশনের পোশাক পরে লাল গালিচায় ছবি তুলেছিলেন। ১৯৯৯ সালে, আইকনিক ‘জ্যাকি’ ব্যাগটি নতুন কিছু সংযোজনের মাধ্যমে পুনরায় উৎপাদন করা হয়েছিল এবং খুব দ্রুতই সেই বছরের জনপ্রিয় একটি আইটেম হয়ে ওঠে।
২০০৪ সালে টম ফোর্ডের প্রস্থানের পর, কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিলো গুচির।যেমন, ২০০৬ সালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর জিয়ান্নির অধীনে ‘ফ্লোরা’ প্যাটার্নের সফল পুনঃপ্রবর্তন। ২০০৮ সালে ব্র্যান্ডটি ডেভিড লিঞ্চের নির্দেশনায় নির্মিত প্রথম টেলিভিশন বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করে। এবং ২০০৯ সালে গুচির আইকনিক ‘ফ্লোরা’ এর সুগন্ধি উদ্বোধন করে।
বর্তমান
২০১৪ সালের শেষের দিকে, গুচির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর জিয়ান্নিনি এবং সিইও ডি মার্কোর প্রস্থান ঘটে এবং নতুন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে তুলনামূলক অপরিচিত এক্সেসরিজ ডিজাইনার আলেসান্দ্রো মিশেলকে নিয়োগ দেয়া হয়। মিশেল গুচিতে যোগদানের পর প্রথম, পুরুষদের পোশাকের কালেকশটি এক সপ্তাহের মধ্যে ডিজাইন করেছিলেন।
তার ঠিক এক মাস পরে নারীদের ড্রেস কালেকশন ডিজাইন করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য যা ছিল ব্যবসা সফল। এরপর, মার্কো বিজারি গুচির নতুন সিইও হিসেবে যোগদান করেন। আলেসান্দ্রো মিশেল, ২০১৫ সালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে নিযুক্ত হন এবং গুচিকে একটি চমকপ্রদ ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করেছে যা তার বড় চশমা এবং অসাধারণ প্রিন্টের জন্য পরিচিত লাভ করেছে।
কোম্পানি ২০২২ সালে পশম-মুক্ত উৎপাদন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এর পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দেয়। গুচি ২০১৯ সালে তার মেকআপ লাইন পুনরায় চালু করে এবং তার প্রথম ইউনিসেক্স সুগন্ধি-মেমোয়ার ডি’উন ওডেউর মার্কেটে উন্মুক্ত করে। মিশেল আরও ঘোষণা করেছেন যে, গুচি ঋতু নির্ভরহীন ফ্যাশন প্রোডাক্ট উৎপাদন করবে এবং প্রতি বছর পাঁচটি শো থেকে দুটি শো কমিয়ে দেবে। যাইহোক, ২০২২ সালের নভেম্বরে, তিনি ব্র্যান্ড থেকে তার প্রস্থান ঘোষণা করেছিলেন।
গুচি সম্পর্কে দুটো অবাক করা তথ্য হলো, এলিজাবেথ টেলরের হাতের ব্যাগটি বাঁশের ছিল যেখানে গুচির পণ্যগুলো সবই ছিলো চামড়ার কারণ ১৯৪০ এর দশকে চামড়া প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়, তখন বিকল্প হিসেবে বাঁশ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এবং বাজারে ছাড়ার পর তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। গুচির এমনও তথ্য আছে যে, জিজি (GG) লোগোটি গুচিও গুচি তিনি নিজে তৈরি করেননি, ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাকে সম্মাননা জানানোর জন্য তৈরি করা হয়।
গুচির ব্যবসায়িক মডেল হল, ধনী বা উচ্চবিত্ত গ্রাহকদেরকে উচ্চ মানের বিলাসবহুল ফ্যাশন আইটেম অফার করার উপর ভিত্তি করে। ব্র্যান্ডের মূল ক্রিয়াকলাপগুলির মধ্যে রয়েছে এর পণ্যগুলির ডিজাইন বা ফ্যাশন ডিজাইন, উৎপাদন এবং বিপণন, এই ব্যবসার ব্র্যান্ডের খ্যাতি নির্ভর করে দক্ষ ডিজাইনার এবং কারিগরদের উপর।
গুচি তার বিলাসবহুল ফ্যাশন পণ্য বিক্রি, লাইসেন্সিং, এবং অন্যান্য ব্র্যান্ডের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে আয় করে। সেলস স্টোর, ই-কমার্স চ্যানেল এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি এবং অন্যান্য লাক্সারি ব্র্যান্ড ও শিল্পী এবং ডিজাইনারদের সাথে কাজ করে লিমিটেড এডিশন প্রোডাক্ট তৈরি করে।
নানারকম উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গুচি এখনও রয়েছে বিশ্বনন্দিত ব্র্যান্ড হিসেবে সবার শীর্ষে। বিভিন্ন সেলিব্রেটিরা এখনও ফ্যাশনের জন্য দ্বারস্থ হয় গুচির। যা ছিল এবং এখনও বহমান আছে। একটা ছোট উদ্যোগ থেকে আজ এই বিশাল বাস্তবতায়। ২০২১ সালে গুচি উদযাপন করে তার যাত্রার শতবর্ষ। নিজেদের পথচলাকে আরো দৃঢ় করতে গুচি নিয়েছে নানারকম উদ্যোগ। আভিজাত্যের প্রতীক স্বরূপ তখন এবং এখনও বিরাজমান বিশ্বনন্দিত এই ব্যান্ড।
Feature Image: tg24.com References: 01. The business model of Gucci. 02. gucci.com 03. 27 Unknown & Interesting Facts About Luxury Brand Gucci 04. 22 Fun Facts about Gucci