গুয়েনতানামো কারাগার: ভয়ঙ্কর এক কারাগারের নাম

542
0

‘আইল্যান্ডের সীমানা-বিহীন আইন’ এই ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করা হয় গুয়েনতানামো বে। যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বন্দি রেখে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা যাবে। সেই সাথে তার অপরাধের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য, কোন ধরণের নিয়ম না মেনেই অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা যাবে।

সেই সাথে সশস্র বাহিনীদের আইন মেনে সকল প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ এবং এই ক্ষেত্রে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। এই ধারণার উপর গুয়েনতানামো বে কারাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে গুয়েনতানামো বে হলো চরম অনিয়ম, নির্যাতন, অত্যাচার এবং আইনের উর্ধ্বে চলমান একটি স্থান নামে পরিচিত। 

স্থানীয়দের কাছে কারাগারটি ‘গিটমো’ নামেই পরিচিত। কিউবার দক্ষিণাংশে ইউএসের ন্যাভাল বেস সংলগ্ন অংশে গুয়েনতানামো বে কারাগারটির অবস্থান। ২০০২ সালের দিকে এই স্থাপনাটি নির্মাণ কাজ শুরু হবার পূর্বে ইউএসের ফোর্স এই ঘরটিকে যুদ্ধাপরাধী আফগানিস্তানী কিংবা ইরাকি মুসলিম নাগরিকদের আটকে রাখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন।  

গুয়েনতানামো বে। Image Source: pinterest.com

আর সেই থেকে এই স্থানটিকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনার শুরু হয়। কারণ এখানের টর্চার সেলটির মধ্যে আমেরিকার সশস্র বাহিনীর উপরও অপরাধীদের অস্বাভাবিক নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে।  

তাই, জেনেভা কনভেনশনে এই বিষয়টিকে উত্থাপনের পর সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনা শুরু হয়। যার পর ইউএস কর্তৃপক্ষের উপর ব্যাপক নজরদারি করা হয় এবং এই বিষয়টির সত্যতা জানার জন্য চারিদিকের সকলেই ব্যাপক মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়।  

২০০২ সালে শুরু হবার পর থেকে এই ক্যাম্পে প্রায় ৮০০ বন্দি এই কারাগারের ভেতরেই মৃত্যুবরণ করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই অমানবিক অত্যাচার এবং তীব্রভাবে শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। কোনো ধরণের অপরাধের চার্জ ছাড়াই এই কারাগারে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে বন্দি বানানো হয়।

কিন্তু, ইউ এস মিলিটারি এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটির ভাষ্যমতে, অনেক বন্দিদের এই জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক বন্দিদের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্দেশে স্থানান্তর করা হয়। বন্দিরা সবসময়ে তাদের সুবিধা কিংবা তাদের পরবর্তী নির্দেশনা জানার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। কারণ সরকার কখনো কোন দেশের সম্মান এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিন্দু মাত্র ছাড় কাউকেই দিবে না।  

গুয়েনতানামো বে কারাগার। Image Source: pinterest.com

২০০২ সালের দিকে এই ক্যাম্পের মধ্যে আল-কায়দার সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ক্যাম্পে প্রেরণ করা শুধু হয়। আল-কায়দা সারা বিশ্বে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিত। আল-কায়দার নির্দেশেই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার এর হামলা পরিচালিত হয়েছে। 

একের পর এক হামলা, যুদ্ধ এবং চারদিকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে, ওসামা বিন লাদেন (১৯৯৬-২০০১) সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে আল-কায়দা নামক জঙ্গি সংগঠনটি। তখন ওসামা বিন লাদেন এবং তার অনুসারীরা মিলে সারা বিশ্বে ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল।  

এই হামলার পরে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০০ এর অধিক মানুষ জঙ্গি সন্দেহে সেনা কর্তৃপক্ষ বিনা আইনি নোটিশে, কোন ধরণের অভিযোগ ছাড়াই ধরে নিয়ে আসে এই কারাগারে। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণা দেন যে,

অপরাধীদের জন্য কোন ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে না। যেহেতু তারা ইউএসের বাইরে থেকে এসে এই হামলা চালিয়েছে তাদের সকলকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হোক। 

অন্যদিকে, জেনেভা কনভেনশনে এই কারাগারকে ঘিরে ব্যাপক ভয়ানক তথ্য সামনে আসে যেখানে কারাগারে বন্দিদের উপর ব্যাপক অত্যাচারের ভয়ানক চিত্র তুলে ধরা হয়, যা সারা বিশ্বের মানুষকে হতবাক করে দেয়।  

প্যাস্টেল রঙে আঁকা ওসামা বিন লাদেন। Image Source: pinterest.com

জেনেভা কনভেনশনে বেআইনিভাবে কোন অপরাধীকে অপরাধ প্রমাণের পূর্বে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বাসী নয়। ২০০৬ সালের দিকে ইউএসের সুপ্রিমকোর্টে ঘোষণা প্রদান করা হয় যে, গুয়েনতানামো বে কারাগারে বন্দিদের উপর যে ধরণের নির্যাতন চালানো হয় তা সম্পূর্ণরূপে মানবতা-বিরোধী।

যা সম্পূর্ণরূপে জেনেভা কনভেনশন বিদেশি নাগরিকদের অপরাধ এবং অপরাধের উপর শাস্তি স্বরূপ আইনে এবং মিলিটারি জাস্টিস কোড এবং কনডাক্ট পুরোপুরি পরিপন্থী। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের দিকে কমিশন মিলিটারি কমিশনের বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। যা ফেডারেল কোর্ট পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যাত করে।  

২০০৮ সালের দিকে কোর্ট পরবর্তীতে এই রায় প্রত্যাখ্যান করে অপরাধী ও তাদের আটক করার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে বিধায় রায় প্রদান করে। কোর্টের সিদ্ধান্তের কারণে বেশ কয়েকজন বন্দি নিজেদের দেশে কিংবা অন্য দেশের জেলে তাদের স্থানান্তরের আকুল আবেদন জানায়। কিন্তু অনেক দেশ তাদের পর্যাপ্ত কারাবাসে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না এবং নিজের দেশেও তারা ফেরত যেতে পারবেন না এমন অজুহাতে তাদের সেই ইচ্ছার উপর না বোধক সিদ্ধান্ত জানানো হয়।  

এই ক্যাম্পটি প্রতিবারই বন্দিদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দিয়ে আসছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ। তার মধ্যে অন্যতম হলো অ্যামনেসটি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, আর রেড ক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ। এছাড়াও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অর্গানাইজেশন আমেরিকান স্টেস্ট তার ব্যতিক্রম নয়।

বন্দিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাদের উপর চলমান অমানবিকভাবে শাস্তি প্রদানের ভয়ানক তথ্য সামনে চলে আসে। চারিদিক থেকে পাওয়া এত এত সমালোচনার ঝড়ে পরবর্তীতে বুশ প্রশাসন তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে। সেই সাথে কোন অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার প্রতি অমানবিক না হবার প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেন। 

গুয়েনতানামো বে কারাগারের দৃশ্য। Image Source: pinterest.com

২০০৯ সালের দিকে ইউএসের অফিশিয়াল ইন-চার্জ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, গুয়েনতানামো বেতে আটককৃতদের মধ্যে ১১ সেপ্টেম্বরের জড়িত সন্ত্রাসীদের বিচারেও আওতাধীন করা যাবে না। কারণ তাদেরকে খুব ভালোভাবে টর্চার করা হয়েছে।

অন্যদিকে ইউএসের অফিশিয়ালদের মতে, এই ধরণের টেকনিক তারা বিভিন্ন কোর্সের ক্ষেত্রে এপ্লাই করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১১ সেপ্টেম্বরের পরিকল্পনাকারী মূল হত্যা খালিদ শেখ মোহাম্মদকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। আর সেই জিজ্ঞাসাবাদে আল কায়দার নেতৃত্ব, পরিকল্পনা এবং অন্যান্য যুদ্ধোপরাধভীতি অপরাধগুলো তারা সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।  

২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারির দিকে, ডেমোক্রেট দলের প্রধান বারাক ওবামা এক বছরের মধ্যে গুয়েনতানামো বে বন্দিরা নিজেদের আপিল করার ক্ষেত্রে এত দিক যে সুবিধা পেতেন সে সুবিধা তিনি বাতিল করে দেয়। সেই সাথে তিনি সেই সকল বন্দিদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণের নির্দেশনা প্রদান করেন।

এছাড়াও তিনি জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে, কেউ এস আর্মির ফিল্ড ম্যানুয়াল ইন্টারোগেশন এর নীতি প্রয়োগ করার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। যেখানে একজন বন্দিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তার প্রতি কোন ধরণের টর্চার করা না হয়। 

গুয়েনতানামো বে। Image Source: dw.com

কিন্তু হঠাৎ করে গুয়েনতানামো বে কারাগারটি বন্ধের নির্দেশনা শুনে, কিছু কিছু রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট কংগ্রেসের সদস্যরা সিদ্ধান্তটির বিরোধীরা করেন। কারণ তাদের কাছে এই সিদ্ধান্তটি যে বন্দিদের আবাসন করা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণ হতে পারে বলে ধারণা দেয়। ২০১৩ সালের দিকে ঠিক ২০১৩ সালের দিকে এই কারাগারের ১৬৬ বন্দি নিজেরদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার এবং অন্য স্থানে হস্তান্তর করার জন্য তার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক অনশনে লিপ্ত হন।  

চারদিক থেকে এই কারাগারের প্রতি সমালোচনার তীর আসতে থাকে। তাই আলকু নামক একটি জনপ্রিয় সংস্থা সামনে থেকে নেতৃত্ব পরিচালনা করে। আকলু (ACLU) সবসময় বিভিন্ন কোর্ট এবং এডভোকেটদের সাথে মিলিতভাবে এই পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

কারণ তারা কখনোই চায়নি যে, কোন ভিনদেশের মানুষকে কোন ধরণের অপরাধ যাচাই না করে কিংবা অপরাধ না প্রমাণ করেই দিনের পর দিন সাজা বরণ করতে হবে এবং সেই সাথে অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হবে। যার ফলে মিলিটারি কমিশন দ্বারা পরিচালিত গুয়েনতানামো বে-এর পুরো কার্যক্রম বন্ধ হয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পর আমেরিকার ইতিহাসে এই লজ্জাজনক কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।  

 

Feature Image:

সোর্স–

https://www.britannica.com/topic/Guantanamo-Bay-detention-camp

 

https://www.aclu.org/issues/national-security/detention/guantanamo-bay-detention-camp

 

https://www.theguardian.com/us-news/2022/jan/09/guantanamo-bay-20-years-on-detainees