ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা আজও ইতিহাসপ্রেমী প্রত্যেকটি পাঠকের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে গোড়াপত্তন হয়েছিল এই সভ্যতার। গ্রিককে হেলেনীয় সভ্যতার দেশ হিসেবেও বলা হয়ে থাকে। গ্রিক সংস্কৃতি, ভাষা, রীতিনীতি, সেইসাথে সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম এবং অন্যান্য দিকগুলির মিশেলেই তৈরি হয়েছে গ্রিসের কালজয়ী ইতিহাস।
ভৌগলিক অবস্থান
ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে বেশ কিছু দূরে ২৫ হাজার বর্গ মাইলের একটি উপদ্বীপ হলো ‘গ্রিস’ নামের এই দেশটি। ইউরোপের দীর্ঘতম উপকূলরেখা রয়েছে এখানে এবং এটি ইউরোপের সবচেয়ে দক্ষিণের দেশ। মূল ভূখণ্ডে পাহাড়, বন এবং হ্রদ রয়েছে। দেশটির পূর্বে নীল এজিয়ান সাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিমে আয়োনিয়ান সাগরের হাজার হাজার দ্বীপের জন্য সুপরিচিত। দেশটি তিনটি ভৌগলিক অঞ্চলে বিভক্ত: মূল ভূখণ্ড, দ্বীপপুঞ্জ এবং পেলোপোনিস।
মূল ভূখণ্ডের পিন্ডাস পর্বতমালায় বিশ্বের গভীরতম গিরিখাতগুলির মধ্যে একটি, ভিকোস গর্জ রয়েছে, যা ৩৬০০ ফুট (১১০০ মিটার) নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। মাউন্ট অলিম্পাস হলো গ্রিসের সর্বোচ্চ পর্বত যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৫৭০ ফুট (২৯১৭ মিটার) উপরে। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতো যে এটি দেবতাদের বাড়ি। একারনেই হয়তো পরবর্তীতে মাউন্ট অলিম্পাস গ্রিসের প্রথম জাতীয় উদ্যান হয়ে ওঠে।
গ্রিক আর গ্রিসের মধ্যে পার্থক্য কি?
গ্রিক আর গ্রিস শব্দদুটি বহু পঠিত অতি প্রাচীন দুটি শব্দ হলেও অনেকেই এই দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য নিরুপম করতে সক্ষম হয় না সব সময়। গ্রিক এবং গ্রিস দুটি আলাদা শব্দ। গ্রিস একটি দেশের নাম আর গ্রিসের মানুষ বা গ্রিস সম্পর্কিত সকলকিছুই হচ্ছে গ্রিক। গ্রিসের ভাষাকেও গ্রিক ভাষা নামে পরিচিত।
গ্রিসের মানুষের খাদ্যাভ্যাস
ভৌগলিক অবস্থান আর পরিবেশের দূরত্ব দেশ হতে দেশের আচার-আচরণকে তো ভিন্নতায় রূপদান করেই সাথে সাথে খাদ্যের অভ্যাসেও গড়ে তোলে বিপুল এক পার্থক্য। তাই পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে গ্রিসের লোকেদের খাদ্যাভ্যাস বেশ ভিন্নই বলা চলে। তবে তারা পরিবারের সকলকে নিয়ে আমোদ করে খাবার খেতে ভালোবাসে। পারিবারিক বন্ধন বেশ মজবুত গ্রিকদের।
রোজকার দিনের খাদ্যাভ্যাস
বিভিন্ন ধরনের শস্য, আঙ্গুর, এবং জলপাই তাদের খাদ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এর সাথে ডিম, পনির, দই, মাছ, ভেড়ার মাংস, ছাগল, মুরগি, ভাত এবং ফল ও সবজিও সাথে থাকে সম্পূরক হিসেবে।
তবে কিছু খাবার আছে যা জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, যার মধ্যে রয়েছে মুসাকা, বাকলাভা, ঘন কফি এবং রেসিনেটেড ওয়াইন (রেটসিনা)। আর কফি-হাউসগুলি বহুকাল পূর্ব হতেই পুরুষদের জন্য প্রতিদিনের জমায়েতের জায়গা হিসাবে কাজ করে আসছে। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন ধরনের খাবারের বৈচিত্র্য। বর্তমানে এসকল রেস্তোরাঁ বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে।
আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে খাদ্যের রকমফের
রোজকার দিনে খাবারের মেন্যু থেকে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের খাদ্য তালিকায় বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে। গ্রিকরা সর্বদাই অতিথিদের জন্য সর্বোচ্চ আরামের ব্যবস্থা করে থাকে। যার সাথে আয়োজন করা হয় নানা পদের খাবার।
অনুষ্ঠানভেদে খাবারের মেন্যুতে থাকে বৈচিত্র্যতা। যেমন-অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকার্তদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় কোলিভা (সিদ্ধ গম, চিনি এবং দারুচিনি মিশ্রিত এক ধরনের খাবার)। অন্যদিকে নববর্ষের দিনে বিশেষ এক ধরনের কেক বেক করা হয় যা পরিবারের সকলকে সাথে নিয়ে খেয়ে থাকে। আর মধ্যরাতের ইস্টার পার্টির জন্য তারা আস্ত একটা ভেড়ার রোস্ট দিয়ে ভোজনবিলাস থাকে তাদের মেন্যুতে।
গ্রিকদের ধর্ম-কর্ম
প্রাচীন গ্রিক ধর্ম বিশ্বাসীরা মনে করতো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অমর দেবতাদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। তারাই মানবজাতি এবং এই বিশ্ব পরিচালনা ও সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। তারা মূলত বহু দেব-দেবীতে বিশ্বস্ত ছিলেন। প্রধান প্রধান দেব-দেবী ছিল জিউস, এপোলো, এথেনা আরো অনেকে।
বিনিময়ে, মানবজাতি তাদের স্রষ্টার প্রশংসা এবং উপাসনার মাধ্যমে তাদের এই উপকারের ধন্যবাদ জানাবে। আর একারণেই তৈরি হয়েছিল অসংখ্য মন্দির। নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল পাদরি এবং যারা কিনা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ধর্ম-কর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটায়।
গ্রিকদের প্রধান প্রধান দেবতাদের নাম এবং পরিচিতি
‘জিউস’কে মানা হয় দেবতাদের রাজা হিসেবে। সূর্য, আলো, সঙ্গীতের দেবতা বলা হয় এপোলোকে। আর জগৎজোড়া যারা সুপরিচিতি প্রেম, ভালোবাসা, সৌন্দর্যের জন্য তিনি হলেন দেবী আফ্রোদিতি। এছাড়াও আছে যুদ্ধ দেবতা, এরিস। শিকার, উর্বরতা এবং চাঁদের দেবী আরটেকিসসহ আরো অনেকে।
গ্রিক লেখক হেসিওড (৮ম খ্রিস্টপূর্ব) তার রচনা ‘থিওগনি’ এবং গ্রিক কবি হোমার তার ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’ এর ঘটনা বিবরণীতে যা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
গ্রিকরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো, মানুষ এবং সেইসাথে সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণীকূল, মাউন্ট অলিম্পাস দেবতাদের দ্বারা সৃষ্ট। তাদের এই ধারণার মূলে ছিল, প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তনের ঘটনাটি। যা তাদের মনে ভাবনার উদ্রেগ যোগায় যে, এই সৃষ্টি এবং তার বিকাশ ও বিনাশের পেছনে অবশ্যই কারোর অস্তিত্ব আছে।
বর্তমানে যা ‘গ্রিক মিথোলজি’ হিসেবে পাঠক, গবেষকদের কাছে অধিক পরিচিত মূলত এতেই বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে দেবতাদের আরাধনা-উপাসনা করতে হবে। এবং তাদের মন রাক্ষা করে চলতে হবে। মূলত, প্রকৃতিই ছিল তাদের এই ধর্মীয় বিশ্বাসের সবচেয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা।
গ্রিক দার্শনিক
বর্তমানে জ্ঞানের একটা শাখা ‘দর্শন’ হলেও, সকল জ্ঞানের ‘মা’ কিন্তু দার্শনিকদের এই চিন্তা করার ক্ষমতা। বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর বাঘা-বাঘা সব আবিষ্কার-এর পেছনে যদি আমরা তাকাই তার মূলে রয়েছে দার্শনিকরা। তাদের মনে প্রশ্ন করার ক্ষমতা বা খুব সাধারণ কিছুকেও বিশ্বয়কর দৃষ্টিতে দেখার ক্ষমতার জন্যই আজ মানবজাতি এত অগ্রসর! এর শুরু কিন্তু হয়েছিল ‘গ্রিস’ দেশেই। সক্রেটিস, থিওফ্রস্টাস, এরিস্টটল, টলেমি, আলেকজান্ডার, প্লেটো, হিরোডোটাস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিডসহ বিখ্যাত সব ব্যক্তিবর্গই ছিলেন গ্রিক।
নিজেকে এবং নিজের পারিপার্শ্বিক সকল অবস্থান সম্পর্কে জানাটাই জেনো ছিল তাদের জীবনের সার্থকতা। সক্রেটিস-এর সেই বিখ্যাত উক্তি “নিজেকে জানো” (Know thyself) এখনো পুরোনোকে নতুন রূপে জানার আগ্রহ শতগুণে বাড়িয়ে দেয়।
গ্রিকরা শিক্ষা এবং কঠোর পরিশ্রমকে খুব বেশি মূল্য দিয়ে থাকে। শিক্ষা গ্রিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সাফল্যের একটি ব্যবহারিক পরিমাপ এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়। গ্রিকরা চায় তাদের সন্তানরা ভালো শিক্ষা লাভ করে তাদের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করুক। আর একারণে, তারা তাদের সন্তানদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহান ত্যাগ স্বীকার করতেও পিছুপা হয় না।
স্থাপনা, দর্শন, সংস্কৃতি আর জাতি হিসেবে গ্রিকদের ভেতর যে বৈচিত্র্যতা দেখতে পাওয়া যায় তা বিস্ময়কর। পৃথিবীর যেকোনো সভ্যতাকে, তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য দিয়ে পেছনে ফেলার ক্ষমতা যেন একমাত্র গ্রিসের-ই আছে। গ্রিসের নাম নিতেই যেন দৃশ্যপ্টে ভেসে ওঠে, মারাত্মক রকমের জ্ঞানী একটি জাতির প্রতিচ্ছবি। মনে হয় এখনও গ্রিসের পথে-ঘাটে ঘুরে বেরাচ্ছে কালজয়ী সব দার্শনিক। এখনো যেন পথে হেটে যাওয়া কোনো পথিক দেখলেই, মহাজ্ঞানী দার্শনিক সক্রেটিস জিজ্ঞাস করবেন সহজ কোনো প্রশ্ন নতুনভাবে জানা, জানানোর এবং চিন্তার খোরাক জাগাতে!
Feature Image: pinterest.com References: 01. Ancient Greece. 02. Ancient Greece-a brief guide to the history culture and daily life. 03. Greece. 04. The top 6 facts about greek culture. 05. Greek Philosophy.