মিশরীয়দের বলা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্মাতা। মিশর সভ্যতা দুনিয়ার অন্য যেকোনো সভ্যতার চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আর এই সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক সব আবিষ্কারকে একসাথে করতে গড়ে তুলা হয়েছে গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম বা GEM (জেম)৷ গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম যা গিজা মিউজিয়াম নামেও পরিচিত৷
গিজা পিরামিড থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে প্রায় ৫০ হেক্টর বা ১২০ একর জায়গা জুড়ে এই মিউজিয়ামটি অবস্থিত৷ এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ আর্কিওলোজিক্যাল মিউজিয়াম বা প্রন্ততাত্ত্বিক জাদুঘর। যা প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন পুরাকীর্তি নিয়ে গঠিত৷ পিরামিড এবং কায়রোর মাঝে প্রথম মরু সমমালভূমির প্রান্তে অবস্থিত এই সাইটটি৷ আজকের আলোচনায় বিস্তারিত আলাপ হবে এই জাদুঘর নিয়ে।
ইতিহাস
এই মিউজিয়ামের ইতিহাস বেশ পুরোনো৷ ১৮৩৫ সালে মিশর সরকার এজবেকিয়ে গার্ডেনে প্রথমবারের মতো মিশরীয় এন্টিক মিউজিয়াম তৈরী করে৷ পরবর্তীতে এটিকে কায়রোতে স্থানান্তর করা হয়৷ অগাস্ট মেরিয়েট-এর নির্দেশে ১৮৫৮ সালে এটিকে বৌল্যাক ওয়্যারহাউজে প্রতিষ্ঠা করা হয়৷
পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মিউজিয়ামে থাকা শিল্পকর্মগুলোকে গিজায় আনা হয়, যাকে আমরা গিজা মিউজিয়াম বলে চিনি৷ সেখান থেকেই বর্তমানের গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের সূচনা৷
নতুন মিউজিয়াম তৈরির উদ্যোগ
২০০২ সালে এই জাদুঘরটির নকশা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় যাতে অংশ নেয় ৮৩টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের ১৫৫০ জন স্থাপত্যবিদ৷ এই ১৫৫০টি ডিজাইনের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয় ডাবলিন ভিত্তিক আইরিশ স্থাপত্য কোম্পানি হেনেঘান পেং (Heneghan Peng) এবং সেই সাথে জিতে নেয় ২৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থমূল্য৷
৬টি দেশের ১৩টি কোম্পানির প্রায় ৩০০ জন এই নকশার দলে ছিলেন৷ মোট ৩টি প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য কাজ করেছে৷ প্রতিষ্ঠান ৩টি হচ্ছে- হেনেঘান পেং, বুরোহ্যাপোল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অরুপ।
ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন ও পুরো সাইটটির মাস্টার প্ল্যান-এর দায়িত্বে ছিল ওয়েস্ট এইট। জার্মান কোম্পানি অটেলিয়ের ব্রুকনার তুতেনখামেনের গ্যালারি, গ্র্যান্ড স্টেয়ারস, পিয়াযা এট্রিয়াম, শিশুদের জাদুঘর-এর ডিজাইনের দায়িত্ব পায়৷ এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয় মে ২০০৫ সালে৷ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে এর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষ হয়৷
খরচ
শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ যার মধ্যে জাপানিজ কোম্পানি জাইকা ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মিশর সরকারকে সফট লোন হিসেবে দেয়৷
১৪৭ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয় মিশর সরকারের পক্ষ থেকে এবং ১৫০ মিলিয়ন ডলার জোগাড় হয় বিভিন্ন অনুদান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে৷
নির্মানকাজে বেশ কিছু দেরীর জন্য মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ-এর মূল বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ যা কয়েক দফায় বেড়ে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হয়৷
প্রবেশ মূল্য
মিশরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের টিকেট মূল্য রাখা হয়েছে সবার নাগালের মধ্যে৷ স্থানীয় মিশরীয়দের জন্য এর মূল্য মাত্র ৩.৩৫ মার্কিন ডলার৷ বিদেশীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ২৫ মার্কিন ডলার৷ তবে শিক্ষার্থীদের জন্য আছে সুখবর৷ তারা সর্বোচ্চ ৫০% ছাড়ে এখানে ঢুকতে পারবেন৷
কি রয়েছে এই বিশাল জাদুঘরে?
মিশরের পুরাতত্ত্ব বিভিন্ন সংস্কৃতি ও কীর্তি নিয়ে এই মিউজিয়ামটি দাঁড়িয়ে আছে৷ ২৪ হাজার বর্গ মিটারের প্রদর্শনী স্থান রয়েছে এখানে, যা আকারে প্রায় ৪টি ফুটবল মাঠের সমান৷ রয়েছে শিশুদের জন্য জাদুঘর, রয়েছে কনফারেন্স সুবিধাও৷
এখানের মূল সোপানটি ৬৪ মিটার লম্বা, ২৪ মিটার উঁচু, নিচের দিকে ৮৫ মিটার প্রস্থ ও উপরের দিকে ১১৭ মিটার প্রশস্থ৷ এটি মূলত মিউজিয়ামের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ডিজাইন করা হয়েছে৷ সেই সাথে এটি ক্রনোলজিক্যাল অর্ডারে মিউজিয়ামে থাকা শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শন করবে৷
এখানে রয়েছে এক্সিবিশন গ্যালারি, কনফারেন্স সেন্টার, ল্যান্ডস্কেপিং ও রিটেইল এরিয়া৷ রয়েছে রেস্টুরেন্ট, এক হাজার আসনসংখ্যার অডিটোরিয়াম ও ২৫০ আসনবিশিষ্ট ৩টি সেমিনার রুম, গ্যালারি স্পেস, মিটিং রুম ও বিজনেস সেন্টার৷ শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগও রয়েছে এখানে৷ এই জাদুঘরে আরো রয়েছে ২৪ হাজার বর্গমিটারের এক্সিবিশন স্পেস, ৫টি গ্যালারিতে রয়েছে তুতেনখামেনের সম্পূর্ণ সংগ্রহ, সোলার বোট, দ্বিতীয় রামসিসের মূর্তি, ও একটি বড় কনজারভেশন সেন্টার৷
কাছাকাছি অবস্থানে থাকা পিরামিডগুলোর মতো ত্রিভূজাকৃতির এই জাদুঘরটি৷ এই ভবনটির উত্তর ও দক্ষিন দিকের দেয়াল সরাসরি মিশরের পিরামিডের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ উত্তরের দেয়াল আছে দ্য গ্রেট খুফুর পিরামিডের সাথে এবং দক্ষিণের দেয়াল আছে মেনকাউর পিরামিডের সাথে৷ প্রায় ১ লক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহশালা এটি৷ মিশরের বিভিন্ন স্থান থেকে এগুলো সংগ্রহ করে প্রদর্শনের জন্য জাদুঘরে রাখা হয়েছে৷
মূল এট্রিয়ামের সামনেই রয়েছে রাজা দ্বিতীয় রামসিসের মূর্তি, যা মিউজিয়ামের প্রবেশপথেই স্বাগতম জানাবে৷ এই মিউজিয়ামে প্রথম দিকেই রাখা হয় প্রায় ৩২০০ বছর পুরনো দ্বিতীয় রামসিস-এর মূর্তি, যা মিশরের রাজধানী কায়রোর একদম প্রাণকেন্দ্রে রামসিস স্কয়ার থেকে এখানে আনা হয়েছিল৷
২০১৮ সালে এই মূর্তিটিকে-এর স্থায়ী ঠিকানা গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়৷ প্রায় ৫ দশক ধরে এই মূর্তিটি রামসিস স্কয়ারে ছিল৷ সেখান থেকে এই ৮৩ টনের মূর্তিটিকে জেম জাদুঘরে আনা হয়৷
এরপর মূল সোপান যেখানে ৮৭ জন রাজা ও দেবতার মূর্তি রয়েছে৷ প্রধান গ্যালারিটি সোপান থেকে বামে এবং ৪টি যুগে ভাগ করা৷ প্রি ডায়ন্যাস্টিক(৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত) এবং ওল্ড কিংডম( পিরামিড তৈরীকারকদের যুগ), মিডল কিংডম, নিউ কিংডম এবং গ্রেকো রোমান৷
সোপানের ডানদিকে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে বিখ্যাত তুতেনখামেনের সমাধি৷ তুতেনখামেন, কিং তুত নামেও পরিচিত৷ ১৩৩৩ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১৩২৩ খ্রিষ্টপুর্ব পর্যন্ত ১০ বছর তিনি প্রাচীন মিশরের রাজত্ব করেন৷ ১৯২২ সালে তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কৃত হয় এবং বলা হয়ে থাকে এটি আধুনিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন৷
রাজা আখেনাতেন-এর মৃত্যুর পর মাত্র ৯ বছর বয়সে তুতেনখামেন মিশরের রাজা হন, সবচেয়ে কমবয়সী রাজা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল৷ ২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা দাবী করেন ম্যালেরিয়া ও হাড়ের রোগজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে৷ ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামেনের সমাধি খুঁজে বের করেন৷ সেখানে তার মমির পাশাপাশি তার ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্রও পাওয়া যায় অবিকৃত অবস্থায়।
এখানে আরো আছে রাণী নেফ্রিত, নেফারতিতি, উসেরকাফ, হাতসেপসুত, রাজা প্রথম ও দ্বিতীয় সেনুসরেত, দেবী হাথোর-এর মূর্তি৷ রয়েছে মিশরীয় ফারাওদের মধ্যে অন্যতম রাজা আখেনাতেন এর কফিন৷ চাঁদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও উদ্ভাবনের দেবতা থোথ-এর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পুরোহিত পেতুসিরিস, আহোমোস ও মেরিতামুন-এর কফিনের দেখাও মিলবে এই জাদুঘরে৷
শুধুমাত্র একটি সভ্যতার উপর ভিত্তি করে প্রায় ৫.২ মিলিয়ন বর্গফুটের এই জাদুঘর গড়ে উঠেছে, যা মিশরের অন্যতম একটি আকর্ষণ৷ মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাহকও বলা চলে৷ একইসাথে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিভিন্ন পুরাকীর্তি আর আধুনিক প্রযুক্তির অপূর্ব এক মেলবন্ধন ভ্রমণকারীর স্মৃতিতে আজীবন জাগ্রত থাকবে৷
এই জাদুঘরটি অন্যান্য সব জাদুঘরের মধ্যে যোগাযোগের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ সেই সাথে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সব জাদুঘর-এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে৷ ইজিপ্টিওলোজি, স্থাপত্য, কিংবা নৃবিজ্ঞানের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষনার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
মিশরের জিডিপির প্রায় ১১% আসে পর্যটন খাত থেকে৷ তবে ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর থেকে মিশরে অস্থিতিশীল অবস্থার শুরু হয়৷ তখনকার প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক এর পতনের ফলে গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের কাজ বাধাগ্রস্থ হয়৷ তবে অবশেষে এটি কাজ শেষে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে৷ আশা করা যাচ্ছে এই মিউজিয়াম থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অনেকেই উপকৃত হবে, কর্মসংস্থান হবে অনেক মানুষের৷ মিশরের পর্যটনখাত হবে আরো উন্নত এবং জিডিপিতেও এর অবদান বাড়বে৷
তাই সবদিক বিবেচনায় গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামকে মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর বলাই যায়,যার আবেদন রয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে৷
Feature Image: Ahmed Wahba/archgdaily.com References: 01. http://grandegyptianmuseum.com. 02. http://orascom.com. 03. http://arup.com. 04. http://discoverwalks.com. 05. http://financialexpress.com.