সৌন্দর্যের বেড়াজালে বন্দি এক দেশের নাম ভিয়েতনাম। পাহাড় ও সমুদ্রের অদ্ভুত মিতালির এই দেশের চারপাশে সবুজাভ অরণ্যে যে কারো মন ভালো করে দিতে যথেষ্ট। প্রকৃতির সৌন্দর্যে হাতছানি দেয়া দেশটি দক্ষিণ চীন সাগরের পাড়ে অবস্থিত। এই দেশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এই দেশের পরিচ্ছন্নতা।
ভিয়েতনামের সরকার দেশের প্রতি বেশ সচেতন, আর তাই তো নিজের দেশকে সবার কাছে তুলে ধরতে কোন কমতি রাখেনি। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের কাছে নিজের দেশকে এক অনন্য দেশ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য নিয়েছেন বেশ কিছু পদক্ষেপ।
মানব সভ্যতার ইতিহাস, প্রাচীন ইতিহাস ইত্যাদির ভীড়ে জড়িয়ে রেখেছে এই ভিয়েতনাম। আর তাই তো নানান দেশের পর্যটকের কাছে এক কৌতূহল এবং মুগ্ধতার দেশ হিসেবেই পরিচিত ভিয়েতনাম। এই ভিয়েতনামের পঞ্চম বৃহত্তম শহর দানাং।
ভিয়েতনামের অন্যতম সুন্দর, শান্ত, নিরিবিলি এক শহর এটি। দানাং শহর মূলত হার নদীর তীরে অবস্থিত। এই শহরেই সৃষ্টি ঈশ্বরের হাত নামে খ্যাত গোল্ডেন ব্রিজ। পাহাড়ের মাঝ থেকে দুটি হাতের মাঝে এই অপরূপ ব্রিজের দেখা পাবে যে কেউ। ভিয়েতনামের এই ব্রিজ নিয়ে জানবো জানা-অজানা কিছু।
নির্মাণের গল্প
দানাং-এ অবস্থিত এই ব্রিজটি বেশ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সৃষ্ট। এই ব্রিজের শহরে অর্থাৎ দানাং-এ এলেই চোখে পড়বে পাহাড়ের সবুজাভ শান্তিময় এক জগত থেকে দুটো হাত ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে এক ব্রিজ।
হাতে ধনুকের মতো বাঁকানো এই ব্রিজটি প্রায় ৪৯০ ফুট দীর্ঘ। এর সৌন্দর্যে গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো এক অনুভূতি দিবে ভিয়েতনামের এই সুদীর্ঘ সোনালী রঙের ব্রিজটি। এই ব্রিজের উপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় লক্ষ লক্ষ পর্যটক হেঁটে বেড়ান এর সৌন্দর্য নিজের চোখে দেখার জন্য।
এই ব্রিজটি কিন্তু এমনি এমনি বিখ্যাত হয়ে উঠেনি! এর সৃষ্টিও বেশ জটিলই ছিল বলা যায়, যার পেছনে রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস। সর্বপ্রথম ফ্রান্সের একটি সংস্থা আজ থেকে প্রায় ৯৯ বছর আগ এই ব্রিজটি নির্মাণ করেন।
তবে তখন এটি ছিল পাহাড়ের ষ্টেশন। তৎকালীন সময়ে ভিয়েতনামকে শাসন করতো ফরাসীরা। আর এই শাসনকারী ফরাসীদের হাত ধরেই এর কাজ শুরু হয় আনুমানিক ১৯১৯ সালে।
ইতিহাসে উঠে এসেছে এর উদ্বোধনের গল্প, যা জুন মাসে করা হয়। দেখতে স্বর্ণের মতো বলে ফরাসীরা একে নাম দেন সোনালী ব্রিজ বা গোল্ডেন ব্রিজ। ভিয়েতনামের পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ এই গোল্ডেন ব্রিজটি।
এখানে পদচারণায় যেন মুখরিত হয়ে থাকে সারা বছর। অনেকে বলেন যে, এই ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানে ঈশ্বরের হাতের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। আর তাই এর নাম ঈশ্বরের হাত নামেও পরিচিতি লাভ করে।
আকর্ষণীয় এই ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচল করে অসংখ্য কার ক্যাবল। নগর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক ছিমছাম পাহাড়ি অঞ্চলে এই ব্রিজের দেখা পাবে পর্যটকেরা। বেশ পরিপাটি এক দেশের সৌন্দর্য যেন আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে এই ঈশ্বরের হাত নামে খ্যাত ব্রিজটি।
দেশটির এক সংবাদ থেকে উঠে এসেছে, গত বছর আনুমানিক ১ কোটি ৩০ লাখ পর্যটক এসেছিল কেবল মাত্র এই ব্রিজটি পরিদর্শন করতে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলীর জন্যে এই ব্রিজ থেকে দানাং শহরের প্রায় সবটুকুই দেখা যায় বেশ সহজেই।
নানান দেশের প্যটক তো আছেই, সবচেয়ে বেশি ঘুরে বেড়িয়েছে এই ব্রিজে চীনের নাগরিকেরা। এরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছে যে এই দেশের প্রতাপশালী ব্যক্তিরা করেছেন প্রশংসা।
এই ব্রিজের সৌন্দর্য যে একবার চোখে দেখেছে, এর সৌন্দর্যে রোমাঞ্চিত হয়নি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন! এ যেন এক প্রকৃতির মাঝে এক বিশাল সৃষ্টি! ঘন জঙ্গল থেকে দুটো হাতের উপর স্টিলের তৈরি এই ব্রিজের কাছে হার মানতে বাধ্য বিশ্বের যেকোনো বিখ্যাত স্থাপত্যশৈলী।
এই ব্রিজটি সাধারণত ফাইবার গ্লাস, কংক্রিটের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। গোল্ডেন ব্রিজটি এর পাশের সমুদ্র থেকে প্রায় ১০০০ মিটার উচ্চতায় স্থাপিত করা হয়েছে।
এই ব্রিজটি দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করে রেখেছে। দূর থেকে দেখলে একে সাপের ন্যায় মনে হবে। আর এর মাঝে যখন রোদের আলো পড়ে তখন যেন সোনালী রঙ ঠিকরে পড়ে এর সৌন্দর্য আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়!
প্রথম প্রথম এর পর্যটক সংখ্যা কম হলেও ধীরে ধীরে এর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। সাধারণ জনগণ এই ব্রিজের প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে এই ব্রিজ ২০১৮ সালে জুন মাস নাগাদ এটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর এর নাম-যশ চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সামাজিক মাধ্যম সহজলভ্য হওয়ার দরুন খুব বেশি সময় লাগেনি এর নাম ছড়িয়ে পড়তে। এরপর এর বিভিন্ন ছবি বিভিন্ন পর্যটকের দ্বারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
নির্মাতারা হয়তো ভেবেই ছিল এই ব্রিজের নাম তেমন একটা ছড়াবে না, বিখ্যাত হওয়া তো দূর! কিন্তু ধীরে ধীরে এর সৌন্দর্য সবার নজরে আসতে শুরু করে। ব্রিজের দুটি হাত অনেকে পাথরের মনে করলেও এটি আদতে ইস্পাতের তৈরি। এখন প্রশ্ন আসে এই নির্মাণে কতদিন সময় লেগেছিল! অনেকের মনে এই প্রশ্ন জন্মানোটা স্বাভাবিক! আর প্রশ্নের জবাব দেন নির্মাতারা।
তারা বিভিন্ন মাধ্যমকে জানান প্রায় এক বছরের মত সময় লেগেছিল এবং এই ব্রিজের পেচনে ব্যয় করা হয় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি! এই ব্রিজের আশেপাশে বেশ কিছু ছোটবড় প্রাচীন প্রাসাদ আর ক্যাথেড্রাল রয়েছে যা একজন পর্যটকের কাছে আরেক আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়!
এই ব্রিজের স্থানীয় নাম কাউ ভ্যাং, যা সাধারণত ভিয়েতনামের লোকেরা মুখেবলে সৃষ্টি করেছেন। পর্যটকদের আকর্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে বেশ ক’বছর আগেই বানা হিলসে ক্যাবল কার চালু করা হয়েছিল। এর আশেপাশে রয়েছে বেশ কিছু গ্রাম যার মাঝে ফরাসীদের নানান স্থাপত্যশৈলী জড়িয়ে আছে। ফরাসীদের এসব চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর কারণেই বিভিন্ন পর্যটকদের আকর্ষণ মাত্রা বেড়ে যায়।
আর এই সৌন্দর্যে অপার বিস্ময়য়ের কারণে বানা হিলসে উন্নতির এক অপার সুযোগ চলে আসে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি! ভিয়েতনামের এই এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকা পর্যটন এলাকা হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে ইতিমধ্যেই। আর বানা হিলসে এই ব্রিজের কারণে এই এলাকাটি যেন নতুন করে আবার সেজে উঠেছে নতুন উদ্যমে। ফরাসীদের স্থাপত্যশৈলী, ক্যাথেড্রাল, গ্রাম সবকিছু মিলে যেন এক প্রাচীনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে!
সর্বশেষ জানা যায়, এই ব্রিজটিতে কোন গাড়ি চলাচলের ব্যাবস্থা নেই, কেউ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে তাকে পায়ে হেঁটেই এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে। এই অত্যাধিক সৌন্দর্যে ভরপুর ব্রিজটিতে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়ছেই। পায়ে হেঁটে কেবল ব্রিজটিই নয়, বরং দানাং এর আশেপাশের এলাকা উপভোগ করতে পারবেন যে কেউ। চারপাশের সবুজ গাছপালা, মাথার উপর নীলাভ আকাশ সব মিলিয়ে যেন এক স্বর্গের প্যাকেজ!
ভিয়েতনামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রায় ২.৮৬ মিলিয়ন পর্যটক এই ব্রিজ পরিদর্শনে আসেন। এর মধ্যে ভিয়েতনামের বাইরের দেশের পর্যটকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে দেশটির সরকার আরও একটি ব্রিজ নির্মাণের কথা ভাবছেন বলে জানা যায়। তবে যে স্থাপত্যশৈলী তৈরি করে রেখে গেছেন ফরাসীরা, যার প্রাচীনত্বে ডুবে গেছেন কোটি কোটি পর্যটক তাতে করে অন্য কোন ব্রিজ এর জায়গা দখল করে নিতে পারবে না বলেই অনেকে বিশ্বাস করেন।
কেবল মাত্র একটি ব্রিজ একটি দেশের পর্যটন খাতে এতোটা উন্নতি করতে সাহায্য করবে তা হয়ত কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, আর তাই সবার চিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সারা বিশ্বের বুকে দাপট দেখিয়ে বিখ্যাত হওয়ার এক অদম্য জয়ীহয়ে ঈশ্বরের হাত বলে খ্যাত গোল্ডেন ব্রিজটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে!
Feature Image: bestpictravel.com Reference: 01. Golden Bridge Da Nang Things You Need To Know. 02. Golden Bridge.