নরকের দরজা: পৃথিবীর বুকে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড

577
0
নরকের দরজা: পৃথিবীর বুকে এক জীবন্ত অগ্নিকুন্ড

১৯৭১ সাল, উত্তর-মধ্য তুর্কমেনিস্তানের কারাকুম মরুভূমিতে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের জন্য ড্রিলিং শুরু করেন। ড্রিলিং এর কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই ভূমি আকস্মিকভাবে ধ্বসে যেতে শুরু করে। ক্রু’রা মাটির নিচে তলিয়ে যেতে শুরু করেন। গর্তের দেয়াল এবং রিম থেকে টালুস পড়তে শুরু করে।

ক্রু’রা অবশেষে পালাতে সক্ষম হলেও, তাদের সরঞ্জাম গর্তেই রয়ে যায়। ভূতাত্ত্বিকদের ড্রিলিং এর জন্যই যেন পৃথিবীর বুকে আকস্মিকভাবে খুলে যায় এক ভয়াবহ নরকের দরজা, যা দরভাজা গ্যাস ক্রেটার নামেও পরিচিত।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য 

১৯৭১ সালের পর থেকেই প্রায় ৭৬ মিটার ব্যাসসম্পন্ন এবং ৩০ মিটার গভীর এই গর্তটি রূপ নিয়েছে এক ভয়ানক জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে, যে অগ্নিকুন্ডের ১০-১৫ মিটার উচ্চতার অগ্নিশিখাগুলো এক মূহুর্তের জন্যেও নিভেনি। ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা ছিল, ক্ষতিকারক গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেলে এই আগুনও দ্রুত নিভে যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে আগুন তখন থেকেই জ্বলছে এবং বর্তমানে এই জায়গাটি একটি অনন্য এবং মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হয়ে উঠেছে।

জীবন্ত নরকের দরজা। Image source: geologyscience.com

যখন ভূপৃষ্ঠ ভেঙে একটি গর্তে পরিণত হয় এবং এই ধরনের কোনো অগ্নিকুন্ডের সৃষ্টি হয় তখন ভূতাত্ত্বিকরা সিঙ্কহোল শব্দটি ব্যবহার করেন। ভূতাত্ত্বিকরা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা গ্রহাণুর প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে উৎপাদিত গর্তের জন্য ক্রেটার শব্দটি ব্যবহার করেন।

সাধারণত যেসকল স্থানে সিঙ্কহোলের সৃষ্টি হয় সেখানে মূলত চুনাপাথরের গভীর গহ্বরগুলো শিলাপাথরের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে, যা ভূপৃষ্ঠকে দৃঢ়তা প্রদানের জন্য যথেষ্ট সক্ষম। কিন্তু এই অবস্থাটি অস্থায়ী এবং যেকোন সময় শিলাস্তরগুলোর অবনতি ঘটায় নিচে থাকা শূন্যস্থানগুলো ভেঙে পড়তে পারে। ক্রমাগত ভূপৃষ্ঠের ক্ষয়, ভূমিকম্প, কম্পন, বৃষ্টির পানি, নির্মাণ কাজ কিংবা ড্রিলিং রিগের মতো যানবাহনের ভার না নিতে পারার কারণে ভূমি ধ্বসের সূত্রপাত হতে পারে। দরভাজা এলাকায় বেশ কয়েকটি এরকম ধ্বসের কারণে সৃষ্ট সিঙ্কহোলের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

দরভাজা গ্যাস ক্রেটার এর জ্বলন্ত লাল আভা এবং ভয়ানক শিখার জন্য পরিচিত। গর্তের নিচে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থাকায় অগ্নিশিখা তীব্র তাপে জ্বলতে থাকে, যা দূর থেকে দেখলে পৃথিবীর সাথে অন্য এক জগতের সংযোগ ঘটেছে বলে মনে হয়। এই গর্তের অগ্নিশিখাগুলোর গর্জন দূর হতেও শোনা যায়, যা যথেষ্ট ভয়ংকর একটি বিষয়। এই কারণেই স্থানীয়রা এর ডাকনাম দিয়েছেন নরকের দরজা। 

নরকের দরজায় দীর্ঘ সময় ধরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা। Image source:education.nationalgeographic.org

অগ্নিশিখা দীর্ঘ সময় ধরে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার রহস্য

ড্রিলিং এর পরবর্তী পর্যায়ে সিঙ্কহোলের আশেপাশের শিলা থেকে গর্তে মজুদ উচ্চ ঘনত্বের প্রাকৃতিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে আগুনের সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসটি মূলত প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা ভূপৃষ্ঠের ফাটল, ভেদনযোগ্য শিলা এবং বেডিং প্লেন সেপারেশারনের (বেডিং প্লেন হলো এমন একটি পৃষ্ঠ যা পূর্বের ভূস্তরকে পরবর্তী ভূস্তর থেকে পৃথক রাখে) মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে, যার ফলে গর্তের দেয়াল বরাবর হাজার হাজার অগ্নিশিখার সৃষ্টি হয়।

নরকের দরজায় প্রবেশ

অসম্ভাব্য মনে হলেও এটি সত্যি যে, এক্সপ্লোরার এবং অ্যাডভেঞ্চারার জর্জ কাউরুনিসের এক বিরাট স্বপ্ন ছিল এই নরকের দরজায় প্রবেশ করা এবং ২০১৩ সালে তিনি তার দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এই স্বপ্নটি পূরণও করেন। নরকের দরজা নামে পরিচিত আগুনের ৩০ মিটার (১০০ ফুট) গভীর এই গর্তে বিশ্বের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রবেশ করেছিলেন।

মরুভূমির বুকে জীবন্ত ৭৬ মিটার (২৫০ ফুট) চওড়া এই অগ্নিকুন্ডের কিছুটা সামনে এগিয়ে, আগুনে ভরা গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে পরিষ্কারভাবে তিনি অগ্নিশিখাগুলোর গর্জন শুনতে পাচ্ছিলেন। গর্তে প্রবেশের পূর্বে, কয়েকদিন প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও নরকের দরজায় প্রবেশ তার জন্য অত্যন্ত ভীতিকর ছিল।

নরকের দরজার সামনে জর্জ কাউরুনিস। Image source: education.nationalgeographic.org

এই গর্তের কিছুটা নিচে নামতেই তার জন্য তাপ (১০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১৮০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট) অসহনীয় হয়ে উঠে। গর্তটির প্রান্তের চারপাশে এবং কেন্দ্রের দিকে হাজার হাজার ছোট শিখা দেখতে পান। এরই কিছুটা নিচে মাঝখানের দিকে বড় দুটি অগ্নিশিখা দেখা যায়, সেখানেই খুব সম্ভবত প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনের জন্য ড্রিলিং করা হয়েছিল।

জর্জ কাউরুনিস গর্তে প্রবেশের আগে কেভলারের তৈরি একটি কাস্টম-মেড ক্লাইম্বিং জুতা, একটি স্বয়ংক্রিয় শ্বাসযন্ত্র, আগুন প্রতিরোধী দড়ি এবং একটি তাপ প্রতিরোধী স্যুট পড়ে নিয়েছিলেন। অ্যালুমিনাইজড ফ্যাব্রিক থেকে তৈরি এই স্যুটগুলো অনেকটা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের মতো দেখতে। এই স্যুটগুলো সাধারণত কিছু অগ্নি-নির্বাপক কর্মীদের পাশাপাশি স্টিল-মিল শ্রমিক এবং আগ্নেয়গিরিবিদরা ব্যবহার করেন। কিন্তু এই পোশাক পড়া সত্ত্বেও গর্তে প্রচুর দীপ্তিমান তাপ প্রতিফলিত হওয়ার কারণে কাউরুনিস ভেতরে বেশ গরম অনুভব করছিলেন। তিনি অভিযান শেষে জানান, তিনি সেখানে সেদ্ধ হওয়া আলুর মতো অনুভব করছিলেন।

আগুনে ভর্তি এই নরকের গর্ত মোটেও অন্ধকার নয়। এই পুরো গর্তটি আগুনের শিখা দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এর সবকিছুই কমলা রঙের। কাউরুনিস জানান, তিনি যখন গর্তে প্রবেশ করেছিলেন তখন এর কমলা রঙের মাটি এবং দেয়াল তাকে মঙ্গল গ্রহের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এই গর্তে প্রবেশের পর থেকেই তার মনে হচ্ছিলো, এই নরকের দরজার সাথে পৃথিবীর বাইরের অন্য এক জগতের সংযোগ রয়েছে।

নরকের দরজায় প্রবেশ। Image source: education.nationalgeographic.org

তবে কাউরুনিসের এই ভয়ংকর অভিযানের মূল উদ্দেশ্য নরকের দরজার ভিতরের গঠন এবং দৃশ্য ধারণ করা নয়, বরং এই অস্বাভাবিক পরিবেশে জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। অর্থাৎ, এত তাপমাত্রার পরিবেশে কোনো এক্সট্রিমোফাইল ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা তা খুঁজে বের করা। যার জন্য এই গর্তের নিচের স্তরের মাটির নমুনা সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল এবং এতে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন কাউরুনিস।

মূলত সৌরজগতের বাইরে এমন কিছু গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলো অত্যধিক পরিমাণে গরম এবং মিথেন সমৃদ্ধ, যা এই গর্তের পরিবেশের অনুরূপ। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, মাইক্রোবায়োলজিস্টরা কাউরুনিসের সাহায্যে পৃথিবীতে এলিয়েনের জীবন খোঁজার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং তারা সফলও হয়েছিলেন। এই গর্তের মাটির নমুনাতে বেশ কয়েক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, যা নরকের উচ্চ তাপমাত্রা এবং নিম্ন পুষ্টির মাঝেও বেঁচে থাকতে সক্ষম।

অন্যান্য ক্রেটার

দরভাজা গ্যাস ক্রেটার ছাড়াও, কাছাকাছি আরো দুটি অনুরূপ সিঙ্কহোল রয়েছে। একটি ওয়াটার ক্রেটার ও অন্যটি মাড ক্রেটার নামে পরিচিত। ওয়াটার ক্রেটারের নিচের অংশ জলে পরিপূর্ণ এবং মাড ক্রেটারের নিচে সান্দ্র কাদার পুল রয়েছে, যা প্রাকৃতিক গ্যাসের বুদবুদ দ্বারা আলোড়িত হতে দেখা যায়। এই গর্তের মাঝে মাঝে অল্প সংখ্যক জ্বলন্ত শিখা দেখতে পাওয়া যায়।

বর্তমানে পর্যটন গন্তব্য দরভাজা গ্যাস ক্রেটার। Image source: geology.com

বর্তমান পরিস্থিতি

এই গ্যাস ক্রেটার একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন গন্তব্য এবং চলমান গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এটি পৃথিবীর ভূতত্ত্বের গতিশীল প্রকৃতি, মানুষের ক্রিয়াকলাপ এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর মাঝে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক প্রদর্শন করে। কিন্তু এই গ্যাস ক্রেটার হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করায় এবং আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব ফেলায় ২০২১ সালে তুর্কমেনিস্তানের রাষ্ট্রপতি গুরবাংগুলি বার্দিমুখামেদো নরকের দরজার আগুন নিভিয়ে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তবে কেউ যদি একবার এই বিশাল অগ্নিকুন্ডের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার গর্জন শুনে থাকে এবং শ্বাসরুদ্ধকর এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকে, তাহলে তার কাছে এটাই মনে হবে যে, পৃথিবীর বুকে হয়তো নরকের দরজা খুলে গেছে এবং ভেতর হতে অগ্নিশিখাগুলো উচুঁ হয়ে যেন তাকে বারবার ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই নরকের দরজা আদৌ বন্ধ করা যাবে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর শুধু সময়ই জানে।

 

 

 

Feature Image: atlasobscura.com 
References: 

01. The Door to Hell, Turkmenistan. 
02. Entering the 'Door to Hell'. 
03. Darvaza Gas Crater.