দেশের সাধারণ মানুষ নিজের উপর আঘাত না হওয়া পর্যন্ত কোন বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে না। কিন্ত পরিস্থিতি যদি বেগতিক হয় তাহলে আমজনতার বিপ্লব যে কত ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ফরাসী বিপ্লব।
আঠারো শতকে ফ্রান্স শুধুমাত্র ইউরোপ নয় বরং গোটা দুনিয়ার অন্যতম এক শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। এই শক্তিধর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ আসন করে ছিলেন রাজা ষোড়শ লুইস। তবে তার অসংযত আচরণ ও অপব্যয়ের জন্য তিনি খুবই সমালোচিত ছিলেন। রাজার এই আচরণ জনগণকে আন্দোলিত করে তোলে। অবশ্য এই আন্দোলন শুধুমাত্র তার আচরণের জন্যই নয়, তখনকার সমাজব্যবস্থাও এর জন্য দায়ী। তাই ফরাসী বিপ্লবকে জানতে হলে আগে আমাদের তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে।
তৎকালীন সমাজব্যবস্থা
১৭৮৯ সালের দিকে ফ্রান্সের সমাজ ব্যবস্থা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। আর এই শ্রেণিগুলোকে বলা হতো Estate (এস্টেট)। এস্টেটকে তিনভাগে ভাগ করা হয়।
- বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি (Privileged Class) – এদেরকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়। যারা প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট নামে পরিচিত।
- সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী (Unprivileged Class) – এদেরকে তৃতীয় এস্টেট বলা হতো।
রাজা বা সম্রাট (Monarch)
এস্টেটের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি ছিলেন রাজা। তিনিই মূলত সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের শাসনকার্য দেখতেন। তৎকালীন সময়ে রাজা ষোড়শ লুইস ছিলেন ফ্রান্সের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। পূর্বেই বলেছি যে তিনি তার অসংযত আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। রাজা হওয়ার এই ক্ষমতাকে তার স্ত্রীও অপব্যবহার করেন। তিনি তার পছন্দের নোবেলদের (Noble) উপর অনেক খরচ করতেন বলে জনমত আছে। এছাড়াও, ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত নারী হিসেবেও তার পরিচিতি আছে।
বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি (Privileged Class)
বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।
- প্রথম এস্টেট (First Estate)
- দ্বিতীয় এস্টেট (Second Estate)
প্রথম এস্টেট এর মানুষরা মূলত ‘Clergy’ অর্থাৎ যাজক বা পাদ্রীরা। সংখ্যায় ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার খুব স্বল্প পরিমাণ ছিল এরা।
আর, দ্বিতীয় এস্টেট এর মানুষরা উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক পদসমূহ এবং সামরিক পদগুলো দখল করে রাখতো। এছাড়াও, তাদের আওতায় ফ্রান্সের ২০% শতাংশ জমি ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, এই ২০ শতাংশ জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে ট্যাক্সের আওতায় আনা হয়নি। অর্থাৎ রাজা তো বটেই, তার সাথে সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট শ্রেণির মানুষদের ‘Freedom from tax’ এর আওতাভুক্ত করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই দুই শ্রেণির ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সংখ্যা ফ্রান্সের মোট জন্সংখ্যার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ ছিল।
সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী (Unprivileged Class)
এই শ্রেণির মধ্যে কৃষক, দিনমজুর এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা পড়ে। দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কৃষকদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল জমিহীন। তাদেরকে অন্যদের সাথে জমি ভাগ করে অথবা জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করতে হতো। অন্যদের থেকে জমি নিয়ে কাজ করার ফলে কৃষকদের তেমন একটা লাভ হতো না। এছাড়াও, তাদেরকে সব কিছুর জন্যই ট্যাক্স দিতে হতো। যেমন – রাস্তাঘাট ব্যবহার, চার্চ ব্যবহার ইত্যাদি।
অন্যদিকে, দিনমজুরদেরও অবস্থা ছিল সম্পূর্ণরুপে বেগতিক। তাদের ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ তো করতে হতোই তার সাথে সাথে আয় ছিল খুবই নগণ্য। বলে রাখা ভালো যে, ফরাসি বিপ্লবে এই শ্রেণির মানুষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
সবশেষে আসে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরা মোটামুটি ভালো আয় করতে পারলেও তাদের কোন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পদমর্যাদা ছিল না। ডাক্তার, উকিল, বণিক ইত্যাদি পেশার মানুষেরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সুবিধাবঞ্চিত এই শ্রেণির উপরই সব ট্যাক্স আরোপ করা হতো। দেশের কোন অবিচল অবস্থা সৃষ্টি হলে তাদের উপরই সব ভার চলে আসতো। ফলস্বরুপ তাদের ভিতর জন্ম হয় এক বিপ্লবী মনোভাব, যেই মনোভাবের দরুণ জন্ম নেয় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার।
আমরা বুঝতেই পারছি যে, উক্ত সময়ে দেশের সিংহভাগ মানুষের উপর এক বিশেষ বৈষম্য ভিত্তিক কাঠামো চালু ছিল। আর এই বৈষম্য ছাড়াও তৎকালীন সময়ের কিছু ঘটনাও আগুনে ঘি ঢালতে সাহায্য করেছিল।
এছাড়াও, ঐ সময়ে ফ্রান্সে নানা ধরণের দর্শন ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদেরও ভুমিকা আছে বলে স্বীকার করা হয়। যেমন – ভলতেয়ার ধর্মকে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলে। অন্যদিকে , মন্টেস্কিউ ‘Separation of Power’ এর ধারণা দেয়। তিনি রাজার এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে নির্বাহী, আইন এবং বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা দেয়; যা বিপ্লবে এক নতুন চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটায়।
বিস্ফোরণ
রাজার অযাচিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে ভেঙ্গে ফেলে। এছাড়াও, তৎকালীন সময়ে আমেরিকান বিপ্লবে ফ্রান্সের আমেরিকাকে সমর্থন ছাড়াও ১৭৮৮ সালে ঘটে যাওয়া খরাতে অবস্থা বেগতিক রুপ ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জায়গায় জায়গায় দাঙ্গা হয়। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির উপর সম্পূর্ণ ট্যাক্সের দায়ভার আসাই এই অবস্থার সৃষ্টি করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজা লুইস নতুন অর্থমন্ত্রী জ্যাকিউস নেকারকে নিয়োগ দেন। নেকার বলেন যে, প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেটের মানুষও এখন থেকে ট্যাক্স দিবে। পরবর্তীতে অবস্থা নিরসনে আলোচনার ডাক দেওয়া হয়, এটিকে মূলত ‘Old Feudal Assembly’ বলা হয়। এই আলোচনায় প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট শ্রেণির আলাদা করে দুটি ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয় এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মাত্র একটি ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি যারা জনসংখ্যার ২ থেকে ৫ শতাংশ, তাদেরকে বেশি অধিকার দেওয়া হয়। সুবিধাবঞ্চিতরা বুঝতে পারে যে তাদের এই একটি ভোটের কোন দাম নেই। সুবিধাপ্রাপ্তরা একযোগ হয়ে তাদের মতামতকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারবে। মূল্ত এর মাধ্যমেই বিপ্লবের সূচনা ঘটে।
বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব!
আলোচনা বর্জন করার পর সুবিধাবঞ্চিতরা রয়েল টেনিস কোর্টে গিয়ে একত্র হয়ে আলাদা ‘ন্যাশনাল এসেম্বলি’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তারা নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে।
১৪ই জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তিল দুর্গে আক্রমণের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের শুরু বলা যায়। দুর্গে আক্রমণ করে তারা অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয় এবং গভর্নরকে হত্যা করে।
এরপর তারা প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় যেটাকে ‘Declaration of the Rights of Man of the Citizen’ বলে অ্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে।
এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজার ক্ষমতাকে হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও দুইটি দলের দেখা মিলে। এক দল মনে করতো যে রাজার কোন দরকার নাই, সব ক্ষমতা শুধুমাত্র জনগণেরই থাকা দরকার। আবার আরেকদল মত দেয় যে তারা ক্ষমতায় সাম্য আনবে।
উক্ত অবস্থায় রাজা বিচলিত হয়ে পলায়ন করে এবং ১৭৯২ সালে গ্রেফতার হয়। বিপ্লবীরা রাজার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয় এবং ন্যাশলান কনভেনশনে ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক ঘোষণা করা হয় । এতে করে রাজা লুইসের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং ১৭৯৩ সালে তাকে গিলোটিন নামক যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
বিপ্লবের পর ফ্রান্সে প্রতিবিপ্লব সৃষ্টি হয়। ন্যাশনাল কনভেনশন দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে।
- প্রথম দলকে মডারেট নামে ডাকা হয় যারা রাষ্ট্রে রাজাকে নামমাত্র একটি উচ্চপদস্থ পদে রাখার মতামত দেয়।
- দ্বিতীয় দলকে র্যাডিকাল নামে পরিচয় দেওয়া হয়। তারা রাজার প্রয়োজনকে অস্বীকার করে এবং যারা এই মতের বিরোধীতা করবে তাদেরকে হত্যার জন্য সমর্থন দেয়।
র্যাডিকাল গ্রুপটি চার্চগুলোকে ‘Temple of Reason’ নামকরণ করেন এবং সেই ভিন্নমত পোষণকারীদের হত্যার জন্য ‘The Committee of Public Safety’ গঠন করে। তাদের এই আচরণকে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror) ডাকা হতো। যদিও পরবর্তীতে মডারেট গ্রুপটি ক্ষমতায় আসে এবং তারাও ঠিক একইভাবে র্যাডিকালদের হত্যা করতে থাকে। তাদের এই কার্যক্রমকে ‘হোয়াইট টেরোর’ বলা হয়।
মডারেটরা ক্ষমতাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে। যারা এই ভাগের বিরুদ্ধে ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণ বা হত্যার জন্য আমাদের সবার পরিচিত নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মডারেট দলটিও দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল বিধায় মানুষজন তাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল। নেপোলিয়ান ঐ সময় দেশের জন্য যুদ্ধ জয় করছিল। তাই তাকে সবাই ইতিবাচকভাবে দেখতো।
নেপোলিয়ান দেশে ফিরে মডারেট সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের প্রথম কাউন্সিল গঠন করেন এবং তাকে একনায়ক (Dictator) হিসেবে ঘোষণা করে। এইভাবেই ফরাসি বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে।
Feature Image: wikimedia.commons References: 01. The United States and the French Revolution. 02. UCL Art Museum: French Revolution Teaching Pack. 03. French Revolution. 04. French revolution - events.