পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা নিয়ে অনেক ধরণের কল্পকাহিনী ও রহস্যজনক ঘটনার কথা আমরা সবাইই কম-বেশি শুনে থাকি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আমরা শুধুমাত্র স্থলবিষয়ক কাহিনীগুলো নিয়েই বেশি অবগত। অথচ এই বিশ্বের সিংহভাগ অংশই সাগর, মহাসাগরে পরিপূর্ণ।
এই মহাসাগরেও অনেক রহস্যজনক কল্পকাহিনী আছে যার মধ্যে ফ্লায়িং ডাচম্যান (Flying Dutchman) প্রায় ৪০০ বছর ধরে রহস্য সৃষ্টি করে রেখেছে। প্রাকৃতিক নিয়ম ভেঙ্গে আসলেই কি এই ধরণের কোন কিছু সম্ভব? নাকি এসবই শুধুমাত্র বইয়ের কল্পকাহিনী? তা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোকপাত করাই যায়।
মহাসাগরে অলৌকিক কাহিনী বা কোনো দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই ঝড়ের প্রেক্ষাপট দেখা যায়। ফ্লায়িং ডাচম্যানের ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা বলা যায়। এর সৃষ্টি হয় ঝড়ো এক আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান ‘কেপ অফ গুড হোপ’ নামক জায়গায়।
ইউরোপ থেকে এশিয়ায় যাওয়ার ক্ষেত্রে এই অঞ্চল পড়ে। যদিও অঞ্চলটির ভয়াবহতার জন্য ভাস্কো ডি গামা এটাকে ‘কেপ অফ স্ট্রম’ (Cape of storm) নাম দিয়েছিলেন। জায়গাটি পার হওয়া সাধারণ নাবিকদের জন্যও দুষ্কর একটি কাজ। এখানে থাকা ডুবোপাথর ও উঁচু ঢেউয়ের কারণে অনেক জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
সাল ১৬৪১, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজ এশিয়া থেকে হল্যান্ডের আর্মস্টারডামের দিকে যাচ্ছিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন হেড্রিক ভ্যান ডের ডেকেন। তাদের জাহাজটি যখন কেপ অফ গুড হোপ অঞ্চলটিতে যায় তখন তারা ঝড়ো আবহাওয়ার সম্মুখীন হয়। এই আবহাওয়াতে জাহাজের নাবিকেরা পিছু ফেরার কথা বলেন। অথচ ক্যাপ্টেন ডেকেন জাহাজকে না ঘুরিয়ে এগিয়ে চলার প্রত্যয় করেন।
অনেক কাহিনীতে বলা হয় যে, ক্যাপ্টেন অনন্তকাল ভেসে হলেও জাহাজ না ঘুরানোর কথা বলেন। এই অবস্থায় জাহাজের নাবিকরা মনে করেন যে, ক্যাপ্টেন হয়তো নেশায় আছেন। এর জন্য অনেক নাবিক ক্যাপ্টেন ডেকেনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে, সেই নাবিকদের নেতাকে ক্যাপ্টেন মেরে ফেলে বলে কিছু জায়গায় বলা হয়।
আবার অন্য এক নথিতে দাবি করা হয় যে, ক্যাপ্টেন ডেকেনের সাথে ‘শয়তান’ (Devil) এর সম্পর্ক আছে। এজন্য নাবিকরা নাকি ক্যাপ্টেনের রুমে ঢুকতেন না। কেননা ক্যাপ্টেনের সাথে সেই শয়তানের মিটিং সেখানে হতো। বলা হয়ে থাকে, শয়তানের হত্যা করা একজন মেয়ের মাথা সমুদ্রে ভেসে থাকতো। সেই ভেসে থাকা মাথাকে অনুসরণ করেই ফ্লায়িং ডাচম্যান জাহাজটি সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ফ্লায়িং ডাচম্যানের এই কাহিনী যে শুধুমাত্র কল্পকাহিনী হিসেবেই রয়েছে তা কিন্ত নয়। ১৭৯০ থেকে ১৭৯৫ এর ল্যাটিন সাহিত্যে এই ভুতুরে জাহাজের কথা অনেকবার এসেছে। ওয়াগনার নামক একজন তখন লিখেন যে–
ডেকেন ও তার ক্রু জাহাজ নিয়ে এখনো চলছে।
শুধুমাত্র তাই নয়, প্রিন্স জর্জ এবং তার ভাই আলবার্ট ভিক্টরের জাহাজও অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি এই জাহাজের দেখা পেয়েছিল বলে বলা হয়। ১৮৮১ সালে জুলাই মাসের এক ভোরে প্রিন্স জর্জের জাহাজের নাবিকেরা একটি লাল আলো দেখতে পায়। তারা সেই লাল আলোর নিকট পৌঁছালে দেখা যায় যে, সেখানে আর কিছু নেই।
যেহেতু তখনকার সময়েও সেই ফ্লায়িং ডাচম্যান নিয়ে তোলপাড় ছিল, সেহেতু প্রিন্সের জাহাজের নাবিকরা আশেপাশেও তার খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করে। যথারীতি তারাও জাহাজটির সন্ধান পায়নি। কিন্ত বলা হয় যে, যেই নাবিক প্রথম সেই লাল আলো দেখতে পায় সে নাকি মারা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যসব জাহাজের ছায়া পানিতে দেখা গেলেও এই জাহাজের ছায়া আকাশে দেখা যেতো বলে বলা হয়।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ এক জাহাজও ভূতুড়ে এই জাহাজের দেখা পায় বলে নথিতে প্রকাশ হয়। হঠাৎ তীব্র বেগে ভূতুড়ে সেই জাহাজটি ব্রিটিশ জাহাজের নিকট আসতে থাকে। এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, জাহাজ দুটি সংঘর্ষে জড়াবে। অথচ কাছে আসলেই ব্রিটিশ জাহাজটি উক্ত জাহাজকে আর দেখতে পায় না। জাহাজটি যেন মুহূর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে যায়।
১৯৩৯ সালে খোদ সেই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কিছু মানুষ তীর থেকে সেই ফ্লায়িং ডাচম্যানকে দেখতে পায় বলে কথায় আছে। ব্রিটিশ সেই জাহাজের নাবিকদের মতো তারাও একই ভাষ্য দেন। জাহাজটি তীব্র বেগে আসতে থাকলেও হঠাৎ সমুদ্রে উধাও হয়ে যায়।
এসব ছাড়াও ফ্লায়িং ডাচম্যানকে অনেকে কেপ অফ গুড হোপের দিকে ছুটে আসতে দেখেছে। কিন্ত কেউই তার সরাসরি দেখা পায়নি। সবসময়ই সেই অঞ্চলের তীরে পৌঁছানোর আগেই সেটি হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়।
কিছু কিছু সংস্করণে আবার ফ্লায়িং ডাচম্যানের এই অবস্থার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন ডেকেনের চরিত্রের কথাও উল্লেখ করা হয়। বলা হয় ডেকেনের বাড়ি এক ডাইনি (Witch) পাহাড়া দিতো। সেই ডাইনির মাধ্যমে ক্যাপ্টেন অনেক কুকর্ম করতো এবং মেয়েদের হত্যা করতো।
হলিউডে ফ্লায়িং ডাচম্যান
হলিউডের বিখ্যাত মুভি পাইরেটস অফ দি ক্যারেবিয়ান মুভিটি আমাদের নিকট বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো অর্থাৎ জনি ডেপকেই এখানে বেশি চিত্রায়িত করা হয় এবং আমরাও তার প্রতিই বেশি মনোযোগ দেই। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে মুভিটিতে ডেভি জোনস (Davy Jones) নামের এক চরিত্র এখানে আছে। যার চেহারা অক্টোপাসের মতো।
এখানে সমুদ্রের দেবি ক্যালিপসো (Calypso) তার এই আকৃতি দেয় বলে জানা যায়। ডেভি জোনসের জাহাজের সাথে তার আরেকটি দায়িত্ব ছিল সমুদ্রে মারা যাওয়া আত্নাগুলোকে অন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করা।
এইভাবে দশ বছর কাজ করতে থাকলে ডেভি জোনস তীরে এসে মুক্তি পাবে বলে দেবি জানায়। কিন্ত ডেভি কিনারায় এলেও ক্যালিপসোকে দেখতে পায় না। বহুবার চেষ্টা করেও সে ক্যালিপসোর দেখা না পেলে সে প্রতিজ্ঞা করে যে সমুদ্রে আসা সব জাহাজকেই সে খতম করে ফেলবে।
অর্থাৎ শুধুমাত্র কয়েকশত বছর আগেই নয় এখনকার দিনেও ফ্লায়িং ডাচম্যানের এক ধাঁচ আছে যা কল্পকাহিনী নয় এখনকার সময়ে মুভিগুলোতে দেখা যায়।
বিজ্ঞান কি বলে?
এসব কল্পকাহিনী নিয়ে বিজ্ঞান সবসময়ই এক যৌক্তিক সমাধান দিয়ে আসছে। বিজ্ঞান জাহাজটির ছায়া আকাশে দেখার যুক্তিকে ফাটা মোরগানা (Fata Morgana) বলে উল্লেখ করছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি প্রাকৃতিক অপটিক্যাল ঘটনা, যা আলোর সাথে মিলিত আর্দ্রতা এবং বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার মাধ্যমে দূরবর্তী বস্তুর একটি স্থানচ্যুত চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
এটি আমাদের চোখকে এমন বস্তু দেখতে চালনা করে যা সেখানে আসলেই নেই। এটি সমুদ্র, মরুভূমি বা যেকোনো জায়গায় হতে পারে। তবে সমুদ্রের মতো এক বিশাল শূণ্য জলরাশিতে এই ধরণের ঘটনা স্বাভাবিক। এটা একটি বিভ্রম যা সমুদ্রে, কখনো কখনো একটি জাহাজ তৈরি করে যা খালি চোখের সীমার বাইরে জলের উপর প্রতিফলিত হয়। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, একটি জাহাজ সমুদ্রের উপরে ভাসছে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ফ্লায়িং ডাচম্যানের তেমন একটা কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় না। ফ্লায়িং ডাচম্যান এখন শুধুমাত্র ফুটবল প্রেমিদের কাছে সেটি বিশ্বকাপের একটি অসাধারণ গোল ছাড়া কিছুই নয়। অথচ সতের শতকের দিকে নাবিকদের জন্য এটি ভয়ংকর এক বিষয় ছিল। এর সত্যতা সম্পর্কে অনেকে অনেক প্রশ্ন করতে পারে।
আবার যৌক্তিক দিক বা বর্তমান আধুনিক দুনিয়ায় এসব অলৌকিক ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য। তবুও এই ধরণের ঘটনার মূলে আসলে কি আছে তা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে রহস্যময়ই থেকে যায়।
Feature Image: William D.higginson References: 01. Flying Dutchman. 02. Ghost Ship: The Mysterious Flying Dutchman. 03. The Story Of 'The Flying Dutchman'. 04. The Flying Dutchman.