ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি: গোলাপী পালকের পাখি

372
0

ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি তাদের উজ্জ্বল গোলাপী পালক, লম্বা পা ও এস-আকৃতির ঘাড়ের জন্য অন্যান্য পাখিদের মধ্যে অন্যতম।  এরা সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় পাখি। এদের বেশিরভাগেরই রং গোলাপি এবং লাল যা চোখে পড়ার মতো। এর অন্যান্য পাখিদের পালকের রং ধূসর বা সাদা।

ফ্ল্যামিঙ্গো শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ এবং ল্যাটিন শব্দ ফ্ল্যামেনকো থেকে যার অর্থ দাঁড়ায় আগুন।  সাধারণত যেই পাখিগুলোর উজ্জ্বল রংয়ের পালক থাকে যেমন: লাল, গোলাপি, কমলা তাদেরকে ফ্ল্যামিঙ্গো বলে।

ফ্ল্যামিঙ্গোর গায়ের রং সম্পূর্ণ তাদের খাদ্যের উপর নির্ভর করে। খাবারের কারণে এদের পার্কগুলো সাদা থেকে গোলাপি, গোলাপি থেকে কমলা পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে। এজন্যই একেকটি ফ্লেমিঙ্গোর পালকের রং একেক রকম দেখা যায় কখনো গোলাপী, কখনো লাল, কখনো ধূসর বর্ণের। তারা যা খায় সেই খাবারের রংই তাদের পালকে প্রতিফলিত হয়। 

ফ্ল্যামিঙ্গো সাধারণত চিংড়ি, প্লাঙ্কটন, শ্যাওলা, মলাস্কস, ক্রাস্টেসিয়ান জাতীয় খাবার খায় যাতে ক্যারোটিনের পরিমাণ অত্যধিক। আর এই ক্যারোটিনই তাদের পালকের রং নির্ধারণ করে।  এই খাবারগুলোতে রঞ্জক পদার্থ থাকে যা পালকের রং পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। সদ্য জন্মানো ফ্ল্যামিঙ্গোর এই কমলা বা লাল পালক অর্জন করতে ২ থেকে ৩ বছর সময় পর্যন্ত লাগতে পারে। 

ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির দল। Image Source: Photo by nicholas chester adams/unsplash

উচ্চতা 

ফ্ল্যামিঙ্গোর সবচেয়ে বৃহত্তম প্রজাতির যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় তাহলে এটি ৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা ওজনের দিক থেকে অনেক কম হয়ে থাকে সর্বোচ্চ ৮ পাউন্ড।  ছোট ফ্ল্যামিঙ্গোগুলো ৩ ফুট লম্বা এবং সাধারণত ৩ থেকে ৬ পাউন্ড ওজনের হয়। একে প্রাপ্তবয়স্ক ফ্ল্যামিঙ্গোর পা ৩০ থেকে ৫০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে যা তার সম্পূর্ণ শরীরের চেয়েও অনেক দীর্ঘ। 

এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার নৈপথ্য 

এই পাখিগুলোকে সাধারণত উষ্ম গ্রীষ্মমন্ডলী অঞ্চলেই দেখা যায়। এক পায়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এরা মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। এর অবশ্য একটি বিশেষ কারণও রয়েছে। এদের শারীরবৃত্তীক প্রক্রিয়াটি এমনভাবেই হয় যার জন্য এরা এদের শরীরের সম্পূর্ণ ভারসাম্য অন্য কোন পেশী ব্যবহার না করেই একদিকে বহন করতে পারে। তাই দুই পায়ে বহন করার চেয়ে এক পায়ে বহন করাই এদের জন্য সহজ। যদিও এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এর নিশ্চিত কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

ফ্ল্যামিঙ্গ বিশ্বের লম্বা পাওয়ালা পাখিদের মধ্যে অন্যতম যারা পানির মধ্যে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে  দীর্ঘ সময় হাঁটতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই এরা পানির কাছাকাছি কাটায় আর এদের লম্বা পায়ের জন্যই এরা স্বাচ্ছন্দ নিয়ে দীর্ঘ সময় পানিতে থাকতে পারে।

ফ্ল্যামিঙ্গো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করলেও এরা কিন্তু উড়তেও পারে। সাধারণত দল বেঁধে বা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তেই এরা বেশি পছন্দ করে। ঋতু ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এরা তাদের দেশ ও বাসস্থান পরিবর্তন করে। দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করার জন্য এরা সাধারণত রাত্রকেই বেছে নেয়। ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির একটি মজার বিষয় হলো যে, এরা শুধু পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এরা ঘুমাতেও পারে।  

এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেন ফ্ল্যামিঙ্গোর শিল্প। Image Source: Photo by Japheth Supeyo on Unsplash

ফ্ল্যামিঙ্গোর ৬ প্রজাতি 

ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি মূলত দেখা যায় আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের হ্রদ, মাটির ফ্ল্যাট এবং অগভীর হ্রদগুলোতে বাস করে। এদের মোট ছয়টি প্রজাতি রয়েছে। এর সবগুলো প্রজাতিই ফিনিকপটেরাস (Phoenicopterus) গণের অন্তর্গত। এর ভেতরে চারটি বিরল ও দুর্লভ প্রজাতির। 

ছয়টি প্রজাতি হল বৃহত্তর ফ্ল্যামিঙ্গো (ফিনিকপ্টেরাস রোজাস/ (Phoenicopterus roseus),  চিলির ফ্ল্যামিঙ্গো  (ফিনিকপ্টেরাস চিলেনসিস/ Phoenicopterus chilensis), ছোট ফিনিকপ্টেরাস (ফিনিকোনিয়াস মাইনর/ Phoeniconaias minor), আন্দিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো (ফিনিকোনিয়াস অ্যান্ডিনাস/Phoenicoparrus andinus), পুনা বা জেমসের  ফ্ল্যামিঙ্গো (আমেরিকান ফ্ল্যামিঙ্গো/ Phoenicoparrus jamesi, ক্যারিবিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো  (ফিনিকপ্টেরাস রুবার/Phoenicopterus ruber)। 

বৃহত্তর ফ্ল্যামিঙ্গো আফ্রিকা এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু অংশে পাওয়া যায়। এরা সবচেয়ে বড় ও লম্বা প্রজাতির ফ্ল্যামিঙ্গো। চিলি,  অ্যান্ডিয়ান এবং জেমসের ফ্ল্যামিঙ্গো শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকায় দেখা যায়। আন্দিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো ছয়টি প্রজাতির মধ্যে বিরল যেখানে মোট পাখির সংখ্যা ৪০,০০০ টিরও কম।  

দুর্লভ আন্দিয়ান প্রজাতির ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি। Image Source: John Pike/birds of the world

বৈরি আবহাওয়ায় বসবাস 

ফ্ল্যামিঙ্গো অনেক চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের সাথেও খাইয়ে নিতে পারে সেই সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা এমন পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত যেখানে অন্যান্য প্রাণীদের টিকে থাকাই মুশকিল! তানজিনিয়ার লেক “ন্যাট্রন” যেখানে খুব কম সংখ্যক ফ্ল্যামিঙ্গো বসবাস করে কিন্তু এটি তাদের প্রজননের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।

এই লেকের পানির তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং এই পানির ক্ষারীয়তা এতটাই বেশি যে এটি ত্বককে পুড়িয়ে ফেলার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং পরিবেশেও ফ্ল্যামিঙ্গো নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে আঁশ ও শক্ত চামড়ার জন্য এমনকি তারা প্রায় ফুটন্ত পানিও পান করতে পারে।

সঙ্গী নির্বাচন 

ফ্ল্যামিঙ্গো একটি সামাজিক প্রজাপতির পাখি।  তাই বন্ধু ও জীবনসাথী নির্বাচনে এরা বেশ সচেতনতা অবলম্বন করে। এরা শত শত এমনকি হাজার হাজার হাজার ঝাঁক নিয়ে বাস করতে পছন্দ করে, যেন বিরূপ আবহাওয়া ও শিকারিদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে এরা বিশ্বস্ততার দিকে খেয়াল রাখে। জীবন সঙ্গী ছাড়াও এরা বন্ধুত্বও করে থাকে। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার সামঞ্জস্যতার বিষয়টি মাথায় রাখে।  

ফ্ল্যামিঙ্গো একগামী পাখি। প্রজননের আগে মেয়ে ফ্ল্যামিঙ্গো পুরুষ ফ্ল্যামিঙ্গোকে নির্বাচন করে। সঙ্গী নির্বাচনের জন্য পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই নাচের মাধ্যমে তাদের সঙ্গীকে আকর্ষন করে।

যতদিন পর্যন্ত পুরুষ সঙ্গীটির প্রজনন সক্ষমতা থাকে ততদিন পর্যন্ত মহিলা সঙ্গীটি তার সাথেই থাকে। প্রজনন সক্ষমতা না থাকলে মহিলার সঙ্গীটি পরবর্তীতে নতুন একটি সঙ্গী খুঁজে নেয়। কিন্তু একবার সঙ্গী নির্বাচনের পর তারা এক বছরের জন্য সেই সঙ্গীর সাথেই থাকে। 

এভাবেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ জানায় ফ্ল্যামিঙ্গোরা। Image Source: Photograph by Sasidhar Ravinuthala/fine art of america

বাসা তৈরি 

ফ্ল্যামিঙ্গোর বাসা তৈরিতে তেমন কোনো বৈচিত্র দেখা যায় না, এটি সাধারণ একটি মাটির ঢিবির মতো হয়ে থাকে। এদের বাসার উচ্চতা মাটির ১২ থেকে ২৪ ইঞ্চি মিটার পর্যন্ত হয়। বন্যা ও খারাপ আবহাওয়া থেকে বাসাটিকে রক্ষা করার জন্য এটি যথেষ্ট পরিমাণ উচু হতে হয় মাটি থেকে। পুরুষ ও মহিলা উভয় মিলেই তাদের বাসা তৈরি করে থাকে। ঢিবির উপরের দিকটা অবতল হয় যাতে ডিম পড়ে না যায়। 

বাচ্চাকে খাওয়ানো 

ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি সাধারণত দিনে কয়েক ঘণ্টা খায়।  পানি থেকে খাবার বের করে এরা সেই খাবার ছেঁকে ফেলে। তারপর নিজে ও‌বাচ্চাদের খাওয়ায়। ফ্ল্যামিঙ্গো তার বাচ্চাকে ৫ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত দুধ খাওয়ায়। এই দুধ উচ্চ চর্বিযুক্ত ও উচ্চ প্রোটিন পদার্থ যা  ফ্ল্যামিঙ্গোর পাচনতন্ত্রে  উৎপাদিত হয়। 

২ সপ্তাহ পরেই তাদের ছানাগুলোর বিল যথেষ্ট বিকশিত হয় খাবার সংগ্রহ ও ফিল্টার করার জন্য। ‘বিল’ হলো উপরের এবং নিচের চোয়াল দিয়ে গঠিত যার চামড়া শিংযুক্ত আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে। এই বিলগুলো অনেক আকার ধারণ করে যা সাধারণত খাদ্য সংগ্রহ , প্রিনিং, বাসা তৈরি এবং অন্যান্য কাজের জন্য অভিযোজিত হয়। 

প্রাকৃতিক দূষণ যেমন: পানি দূষণ, বাসস্থান দূষণ, বৈদ্যুতিক তারের সাথে সংঘর্ষ, শিকার হওয়া, বিষক্রিয়া, ডিম নষ্ট হওয়া ইত্যাদি কারণে এরা আজ বিলুপ্তির পথে। এর পরেও একটি ভালো সংবাদ হলো যে, দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম লবণাক্ত পানির হ্রদ যেটি ‘Mar Chiquita’ নামে পরিচিত এটিকে বিরল প্রজাতির ফ্ল্যামিঙ্গোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে যাচ্ছে যা আর্জেন্টিনার বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান। বর্তমানে এটির কাজ চলমান রয়েছে। 

মায়ের পালকের নিচে সুরক্ষিত বাচ্চা ফ্ল্যামিঙ্গো। Image Source: San Diego Zoo

১৯৭৮ সালে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল যার মাধ্যমে ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির উপরে পর্যবেক্ষণ, জরিপ ও এরা  কতটা হুমকির মুখে পড়তে পারে সেই বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল।

ফ্ল্যামিঙ্গোর ছয়টি প্রজাতি খুব কম সংখ্যক দেশেই পাওয়া যায়। এর কিছু কিছু প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। লাল ও গোলাপি পালকযুক্ত এই অসাধারণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পাখিটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাই শীঘ্রই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ফ্লেমিঙ্গো (অরিজিন: দক্ষিণ আমেরিকা) পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরে বাহামার জাতীয় পাখি। 

 

Feature Image: pouted.com 
References: 

01. Flamingo. 
02. Flamingo. 
03. 20 Fun Facts About Flamingos.