সেতু সাধারণত দূরত্ব কমানো, চলাচল সহজ আর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু ভয়ংকর সেতু রয়েছে যেগুলো দেখলে ইঞ্জিনিয়ারদের বুদ্ধিদীপ্ততা দেখে অবাক হতেই হয়। এই ভয়ংকর সেতুগুলো যেসব স্থানে আছে সেখানে এই ধরনের সেতু নির্মাণের কথা কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তায় এই একেকটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কোন কোন সেতুর আবার অকল্পনীয় উচ্চতা এবং সবচেয়ে অস্বাভাবিক কিছু জায়গায় অবস্থান।
বিশ্বের এই ভয়ংকর সেতুগুলো দুর্গম এলাকা, জলপথ, গিরিখাত বা পাহাড় থেকে জনপদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে মূল ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, সেতুগুলো পারাপার যেমন ভয়ংকর বিপজ্জনক সেই সাথে রোমঞ্চকরও বটে। আবার, সবসময় যে সেতুগুলা চলাচলে আরামদায়ক অভিজ্ঞতা দিবে তা নয়। অনেক সময় এইসব সেতু পার হতে নানান রকম ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
তবুও এই ভয়ংকর সেতুগুলা দেখতে বেশিরভাগের লোকের আগ্রহ রয়েছে। সেগুলি যতই স্থিতিশীল বা অনিরাপদ হোক না কেন। দেখতে নয়ানাভিরাম অথচ বিপজ্জনক এমনই বিশ্বের ৫টি ভয়ংকর সেতু সম্পর্কে আজকের বিশেষ আলোচনা।
ঝাংজিয়াজি কাচেঁর সেতু
ঝাংজিয়াজি হলো একটি পথচারী ঝুলন্ত কাচেঁর সেতু। যা চীনের হুনান প্রদেশের ঝাংজিয়াজি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সিনিক এলাকায় অবস্থিত। এই সেতুটি মূলত একটি স্টিলের ফ্রেম এবং কাচেঁর প্যানেল দিয়ে তৈরি। ঝাংজিয়াজি সেতুটি এতটাই উঁচু যে, সেতু পারাপার হওয়ার সময় মনে হবে যেন বাতাসে হাঁটছেন।
সেতুটির দৈর্ঘ্যে ৪৩০ মিটার (১,৪১০ফুট) বিস্তৃত এবং এটিকে ভূমি থেকে ৩০০ মিটার (৯৮৪ফুট) উপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের দীর্ঘতম এবং সর্বোচ্চ কাচেঁর সেতু পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া, এই সেতুটিকে তীব্র বাতাস এবং ভূমিকম্পের মাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে নকশা করে নির্মাণ করা হয়েছে।
ঝাংজিয়াজি কাচেঁর সেতুতে একবারে একইসাথে প্রায় ৮০০ জন পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারেন। সেই সাথে সেতুটির প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০,০০০ দর্শকের ধারণক্ষমতা রয়েছে। এছাড়াও, সেতুটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে একটি এলইডি লাইট এবং একটি সাউন্ড সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি লাইট বসানো আছে।
এখানে আগত দর্শনার্থীরা ঝাংজিয়াজি কাচেঁর সেতুর আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে পারেন। যার মধ্যে রয়েছে ঝাংজিয়াজি ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট যা তার অনন্য শিলা গঠনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালে উদ্বোধনের পর থেকে সেতুটি চীনের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এসিমা ওহাশি সেতু
জাপানের এসিমা ওহাশি সেতু যা রোলার কোস্টার সেতু নামেও পরিচিত। এই সেতুটি খাড়া বাঁক করে নকশা করা হয়েছে যাতে জাহাজগুলি এর নীচে দিয়ে চলাচল করতে পারে। এর কারণ হলো এসিমা ওহাশি সেতুটি যে হ্রদের উপর সেই হ্রদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুট। এছাড়াও, সেতুটি নাকাউমি হ্রদের উপর দিয়ে মাতসু এবং সাকাইমিনাটো শহরকে সংযুক্ত করেছে।
দুই লেনের সেতুটি পার হতে ভয়ানক শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই সেতুটি ৪৪ মিটার উচ্চতা এবং এর দৈর্ঘ্য ১.৭ কিলোমিটার (১.১ মাইল) এবং এর একদিকে ৬.১% এবং অন্যদিকে ৫.১% এর একটি খাড়া ঢাল রয়েছে।
তবে দেখতে রোলারকোস্টার সেতুটির খাড়া বাঁক থাকা সত্ত্বেও সেতুটি গাড়ি চালানোর জন্য নিরাপদ। কারণ এখানে গার্ডেল এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুবই উন্নত। সেতু পার হতে চালকদের রাস্তার দিকে মনোযোগ দিতে এবং গতি সীমা অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ সেতুর উঁচু বাঁক একটি অপটিক্যাল বিভ্রম তৈরি করে, যা সেতুটিকে বাস্তবের চেয়েও বেশি উঁচু দেখায়।
এসিমা ওহাশি সেতুটির অনন্য নকশা এবং অত্যাশ্চর্য দৃশ্যের কারণে পর্যটকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া, এখানে সেতু ছাড়াও আশেপাশের অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। যার মধ্যে লেক এবং নিকটবর্তী পাহাড় ও রয়েছে। অন্যদিকে, ফটোগ্রাফারদের কাছেও এটি একটি জনপ্রিয় স্থান। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় ফটোগ্রাফারদের ভীড় করতে দেখা যায়।
হুসাইনি ঝুলন্ত সেতু
পাকিস্তানের হুসাইনি ঝুলন্ত সেতু পার হওয়া যেমন মজার তেমনই ভয়ের। গোজালের শিশকাট গ্রামে ব্রিটিশ শাসনামলে সেতুটি নির্মিত হয়েছিল। কারাকোরাম হাইওয়ে নির্মাণের সময়, এই ঝুলন্ত সেতুটি ১৯৬৮ সালে শিশকাট গ্রাম থেকে হুসাইনি গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়, যাতে নদীর অপর প্রান্তে জার আবাদ গ্রামে পৌঁছানো যায়।
প্রথমে হুসাইনি ঝুলন্ত সেতুটি স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে দিনে দিনে সেতুটি পর্যটকদের কাছেও প্রধান আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভয়ংকর এই ঝুলন্ত সেতুটি লম্বা প্রায় ৬৬০ ফুট এবং নদীর তলদেশ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা ১০০ ফুট পর্যন্ত। এই সেতুটি ৪৭২টি কাঠের তক্তা দিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
তবে সবার জন্য এই তক্তা দিয়ে হেটেঁ সেতুটি পার হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। কারণ সেতুটিতে ১০ থেকে ১৫ ধাপ এগিয়ে যেতেই কাপঁতে শুরু করে। দুই ধাপের মধ্যে দূরত্ব ন্যূনতম এক ফুট। তাই বেশির ভাগ পর্যটকই সেতুটি পার হতে গিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েন।
হুসাইনি ঝুলন্ত সেতুটিতে কোন উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই অথবা কোন উপকূলরক্ষীও নেই। সুতরাং দুর্ভাগ্যবশত কেউ পিছলে নদীতে পড়ে গেলে সাহায্য পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই দুর্ঘটনাবশত নদীতে পড়ে মারা গেলে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন।
ভিতিম রিভার সেতু
অনেকেই হয়ত কাঁচের সেতুতে হাঁটতে বা পাহাড়ী রাস্তায় যেসব সেতু নির্মাণ করা হয় সেগুলোতে যাওয়ার চিন্তা করে থাকেন। কিন্তু রাশিয়ার ভিতিম সেতুটি সম্পুর্ণ ভিন্ন। তাই খুব প্রয়োজন না হলে কেউ ভিতিম রিভার সেতু দিয়ে চলাচল করতে চান না। এর মূল কারণ হলো এই সেতুটি প্রায় জনবিচ্ছিন্ন আর পারপার হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। সেতুর জরাজীর্ণ কাঠামো যা দেখলে মনে হবে এই বুঝি সেতুটি ভেঙ্গে পড়ে গেল।
সত্যিকার অর্থে, ভিতিম রিভার সেতুটি আহামরি তেমন কোন উচ্চতা নয় আবার এর দৈর্ঘ্যও অন্যান্য সেতুর তুলনায় অনেক কম। তবু এই সেতুটি বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর সেতুর তালিকায় স্থান পায়। এই সেতু এতটাই ভয়ংকর যে মাঝখানে কিছু অংশ ভাঙ্গা, তাই যেকোন সময় ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তাছাড়া বছরের বেশিরভাগ সময়ই সেতুটি বরফে ঢাকা থাকে।
ভিতিম রিভার সেতুর নিচে নদীর পানিতে অনেক স্রোত থাকে। আবার, শীতের সময় বরফ হয়ে যায়। তাই নৌকা চলাচলে ব্যঘাত ঘটে। সুতরাং প্রথমে শুধুমাত্র মালামালা বহনকারী ট্রেন চলাচল করতে এই সেতুটিকে ব্যবহৃত হতো। পরে সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা নানান কাজে সেতুটিকে ব্যবহার করে আসছে।
রেলিংবিহীন ভিতিম রিভার সেতুর দৈর্ঘ্য ৫৭০ মিটার (১৮৭০ ফুট) এবং উচ্চতা ৫০ ফুট। সেতুটিতে প্রায়ই ঘটে নানান দুর্ঘটনা। তাই এই সেতুটি বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ন সেতু হিসেবে পরিচিত। এই সেতু চলাচলের জন্য চালককে অবশ্যই আলাদা সতর্রকতা অবলম্বন করতে হয়।
সানশাইন স্কাইওয়ে সেতু
সানশাইন স্কাইওয়ে সেতুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় টাম্পা উপসাগরের উপর নির্মিত। এই সেতুটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম তারের কংক্রিট সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই সেতুটি পিনেলাস কাউন্টির সেন্ট পিটার্সবার্গকে মানাটি কাউন্টির টেরা সিয়ার সাথে সংযুক্ত করেছে। ভয়ংকর সেতুটি এই অঞ্চলের একটি প্রধান পরিবহন পথ এবং এটি পর্যটকদের জন্য জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় স্থান।
বর্তমান সানশাইন স্কাইওয়ে সেতুটি ১৯৮৭ সালে সালে নির্মাণ করা হয়েছিল, যা ১৯৫৪ সালে নির্মিত আগের একটি সেতুর পরিবর্তে আনা হয়েছিল। আসল সেতুটি ১৯৮০ সালে একটি মালবাহী জাহাজের আঘাতের ফলে একটি অংশ ভেঙে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সেই দুর্ঘটনায় ৩৫ জন মানুষ নিহত হন।
এরপর নতুন সেতুটি উন্নত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নকশা করা হয়েছে। আর তাই বর্তমানে সেতুর নিচ দিয়ে জাহাজ চলাচল করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন প্রায় ৮৭,০০০ টন জাহাজের আঘাত প্রতিরোধ করতে পারে এমন ভাবেই সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।
সানশাইন স্কাইওয়ে সেতু টাম্পা উপসাগর এলাকায় একটি চমৎকার কাঠামো, যার অসাধারণ নকশা এবং নদী এবং নদীর আশেপাশের এলাকার নান্দনিক দৃশ্যের জন্য সুপরিচিত। এটি ২১,৮৭৭ ফুট লম্বা এবং এর প্রধান স্প্যান ১,২০০ ফুট। এছাড়াও, সেতুটি মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। সেতু জুড়ে একটি বার্ষিক রেস প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বের ৫টি ভয়ংকর সেতু; ভয় আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দিয়ে আপনাকে চমকে দেবেই। এই সেতুগুলো যতই বিপজ্জনক হোক না কেন অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের আনাগোনা ঠিকই আছে। সত্যিই, সেতুগুলোর অসাধারণ নির্মান শৈলী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে প্রতিদিন হাজার দর্শনার্থীদের ভীড় করতে দেখা যায়।
Feature Image: Writer Sources: 01. Worlds 25 Most Dangerous Bridges. 02. Most Dangerous Bridges in the World. 03. Most Dangerous Bridges in the World. 04. 10 Most Dangerous Bridges in the World. 05. Worlds Most Terrifying Bridges.