বরফের দেশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো। উন্নত অবকাঠামো, জীবনমান, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্মিলন ঘটেছে উত্তর ইউরোপে। তেমনি এক দেশের নাম ফিনল্যান্ড।
আইস এইজ বা বরফযুগ যে এলাকা জুড়ে বিরাজমান ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে, ফিনল্যান্ড সেই এলাকায় পড়েছে। বিশেষত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর উন্নত জীবনযাত্রার কারণেই সারাবিশ্বে ঈর্ষণীয় অবস্থান ফিনল্যান্ডের।
একনজরে ফিনল্যান্ড
- দেশের নাম – রিপাবলিক অফ ফিনল্যান্ড
- আয়তন – ৩,৩৮,২২৪ বর্গকিলোমিটার
- রাজধানী – হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর)
- ভৌগোলিক অবস্থান – ৬৪° উত্তর অক্ষাংশ ২৬° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ
- মুদ্রা – ইউরো
- জনসংখ্যা – ৫,৫৫৪,৯৬০ জন
- জনসংখ্যার ঘনত্ব – প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৬.৪১ জন
- জাতিগত নাম – ফিনিশ (Finnish) [প্রোটো জার্মানিক মূল Finne থেকে আসা শব্দ, যার অর্থ শিকারি বা ভ্রমণকারী]
- প্রধান ভাষা – ফিনিশ, সুইডিশ এবং স্যামি
- জিডিপি – প্রায় ৪৮,৩০০ ইউএস ডলার
ইতিকথা
বহু, বহুদিন আগে, খ্রিস্টের জন্মেরও আট হাজার তিনশো বছর আগে সুওমুসজার্ভি সভ্যতার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে ফিনল্যান্ডের আত্মপ্রকাশ। এর আগের সবটাই বরফ যুগের অধীনে ছিল। সেই হিসেবে ফিনল্যান্ডের আনুমানিক বয়স ১,৩০,০০০ বছর। তারপর প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ এবং লৌহ যুগ পার হয়ে এসেছে সেই বরফাবৃত ভূখণ্ড। লৌহ যুগের শেষে এখনকার ফিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে পাহাড়িয়া কেল্লার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে।
ফিনল্যান্ড পরে সুইডেনের অধীনে ছিল, তাও এক কিংবা দুইশো বছর নয়; পুরোপুরি সাতশো বছর। অতঃপর ১৮০৯ সালে রাশিয়ার অধীনে চলে যায়। তবে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেয়েছিল তখনই। তারপর ১৯১৭ সালে, রুশ বিপ্লবের পরপর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিনল্যান্ডের জন্ম।
‘হাজার হ্রদের দেশ’ মানে কিন্তু, গুনে গুনে ১ হাজার হ্রদই আছে ফিনল্যান্ডে, ব্যাপারটা এমন নয়। ছোট এই দেশটার কোলজুড়ে বয়ে গেছে ১,৮৭,০০০ এরও বেশি সংখ্যক হ্রদ। ৩,৩৮,২২৪ বর্গকিলোমিটার জায়গায় এই সংখ্যা বিশালই বলতে হবে। ‘হাজার’ শব্দটাকে বিশেষ অর্থে বড় অঙ্কের সংখ্যা নির্দেশক প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে কখনো কখনো। এখানেও সেই ঘটনা ঘটেছে। ফিনরা এই কারণে নিজেদের দেশকে ‘সুওমি’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। সুওমি অর্থ হ্রদ। ফিনদের মতে সুওমি মানেই ফিনল্যান্ড।
দেখার চোখ যদি থাকে
ফিনিশীয় জীবনযাত্রায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪২ সাল থেকে এরা দিনের আলো ধরে রাখবার তাগিদে ডে-লাইট সেভিং টাইম ব্যবহার করে চলেছে। মাঝে কেবল ১৯৮০ সালের দিকে এই ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। গ্রীষ্মকালে সারারাত এরা সূর্যালোক পায়। এই সময় সারাদিন এরা সাঁতার কেটে, ক্যাম্পিং করে, হাইকিং করে কাটায়। অন্ধকার সময়গুলোতে গাছে গাছে তুষার জমে থাকে। এ যেন এক পরম সৌন্দর্যের ল্যান্ডস্কেপ!
ঘুরতে যাবার জন্য ফিনল্যান্ড হতে পারে পরম আরাধ্য এক স্বর্গদ্বীপ। হ্যাঁ, দ্বীপই তো। দক্ষিণে ফিনল্যান্ড উপসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে বসনিয়া উপসাগর। দুইদিকের পানির মাঝেই সদা হাস্যোজ্জ্বল ফিনল্যান্ড! ওদিকে উত্তরে নরওয়ে, পূর্বে রাশিয়া, উত্তর-পশ্চিমে সুইডেন। দেশটির সীমারেখাই বলে দেয় দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য এক ভূমি।
ফিনল্যান্ডে দেখবার মতো আছে সাইমা হ্রদ। ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। ফিনল্যান্ডের অনেকগুলো বড়ো শহরকে বিভিন্ন প্রান্তে যুক্ত করে রেখেছে এই হ্রদ! আছে নুকসিও, কলি, প্যালাস ইলাসতুনতুরি পার্ক। এরকম ফিনল্যান্ডে মোট একচল্লিশটি ন্যাশনাল পার্ক আছে। তুর্কু আর্কিপেলাগো, ওল্ড রমার মতো স্থাপত্য নিদর্শন চোখজুড়ানো শোভা নিয়ে ফিনল্যান্ডে অপেক্ষা করছে!
গুরুত্বপূর্ণ
আপনি জানেন কি — ফিনল্যান্ড টানা কয়েকবছর ধরে সুখী মানুষের দেশের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে? হবে না-ই বা কেন? যে রাষ্ট্রের জনগণের জীবনমান যত ভালো, সে রাষ্ট্র তত সুখী। ফিনল্যান্ড ফিনদেরকে অনেক আগে থেকেই জীবনের সকল ক্ষেত্রে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল জীবনসংশ্লিষ্ট অধিকারের সুরক্ষার নিশ্চয়তা তো আছেই, আছে জবাবদিহিমূলক আইন ব্যবস্থা। সেদেশের কোর্টে মামলা অমীমাংসিত ঝুলে থাকে না। ফলে অপরাধের হার অনেক কম। সামাজিক আর পারিবেশিক শান্তি বিরাজ করলে একটা দেশের মানুষের মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকে।
এখন থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড ছিল বরফে ঢাকা। সেই বরফ একসময় গলতে শুরু করে। যার সাথে, ধারণা করা যায় যে, একালের নগরায়নের ডামাডোলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের প্রভাবও যুক্ত হয়ে থাকবে। এভাবে জমাট বরফের আস্তর গলতে গলতে হ্রদে পরিণত হয়। ব্যাপারটাকে হতাশার পাহাড় ভেঙে নামা শান্তির জলধারার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তাহলে প্রতীকীভাবে হাজার হ্রদের দেশে সুখী মানুষের বসবাসের রহস্যটা বোধকরি খোলাসা হয়ে গেছে এতক্ষণে।
ধর্ম
ফিনল্যান্ডের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ১৮ বছর বয়স হলেই ধর্ম বেছে নিতে পারে যে কেউ। কোনো প্রশ্ন অথবা বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্মের অনুসারীই ফিনল্যান্ডে বেশি। মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগেরও বেশি এরা। শতকরা ২২ ভাগ ফিন নাস্তিক। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, বাহাইজম, ইহুদি ধর্ম, রোমান ক্যাথলিজম ইত্যাদি।
আদিকালের ফিনদের কথা
ফিনল্যান্ডের আদিবাসী সম্প্রদায় বলতে স্যামিদেরকে বোঝানো হয়। ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ডে এদের বসত বেশি। এরা শিকারি সমাজের প্রতিনিধি। বল্গা হরিণ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে এরা এই আধুনিক যুগে এসেও। বল্গা হরিণের চামড়ার তৈরি ‘গাক্তি’ এদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। ইদানীং অবশ্য এই পোশাক উল, সূতা, রেশম দিয়েও তৈরি হয়। স্যামিরা আমোদপ্রবণ। সঙ্গীতপ্রিয় সম্প্রদায় এরা। সভ্যজগতের অপেরার ঢঙে তাদের সঙ্গীতের ধরণটি ‘ক্যাপেলা’ নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়া ‘জইক’ নামে এক ধরণের সঙ্গীত খুব জনপ্রিয় এদের মধ্যে।
বরফের মধ্যে তাবু বা ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পাঁচ-ছয়টি পরিবার জোটবেঁধে বসবাস করে এককালের যাযাবর এই সম্প্রদায়। এদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে এরা প্রধানত রাশিয়ান অর্থোডক্স। এর বাইরে কেউ কেউ লুথারিয়ান ধর্মমতে বিশ্বাস করে। এদের পূর্বপুরুষরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। মোটামুটিভাবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার স্যামি ফিনল্যান্ডে থাকে বলে ধারণা করা যায়।
ভাষা-সাহিত্য
ফিনল্যান্ডে প্রধানত ফিনিশীয় এবং সুইডিশ ভাষা প্রচলিত। ১৮৬৩ সালের আগ পর্যন্ত ফিনিশীয় ভাষার আনুষ্ঠানিক ব্যবহার হতো না বললেই চলে। সুইডিশ ভাষায় শিক্ষা এবং অন্যান্য খাত চলতো ফিনল্যান্ডে। ১৮৩৫ সালে ফিনল্যান্ডের জাতীয় মহাকাব্য কালেভালা প্রকাশিত হয় ফিনিশীয় ফোকলোরতত্ত্ববিদ এলিয়াস লনরটের তত্ত্বাবধানে। ফিনিশীয় জাতিত্ববোধ জাগরণে কালেভালার অবদান অনস্বীকার্য। বলাবাহুল্য ফিনিশীয়দের মাতৃভাষাপ্রীতিতেও এই মহাকাব্য নতুন মাত্রা দেয়। পরে ১৯১৯ সালের ফিনল্যান্ডের সংবিধানে সুইডিশের পাশাপাশি ফিনিশীয় ভাষা জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে।
ফিনিশীয় ভাষা বাল্টিক ভাষা শাখা থেকে জাত ভাষা। বিশেষত এস্তোনীয় ভাষার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ফিনিশীয় ভাষার। এই ভাষার বর্ণমালায় রয়েছে ২৯টি বর্ণ। ইংরেজি বর্ণমালার ২৬টি বর্ণের পাশাপাশি স্বরাঘাতযুক্ত আরও তিনটি বর্ণ (å, ä, ö) নিয়ে ফিনিশীয় বর্ণমালা। ফিনিশীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে ফিনিশীয় ভাষার প্রথম উপন্যাস অ্যালেকসিস কিভির লেখা Seitsemän veljestä (১৮৭০)। তিনি ফিনিশীয় ভাষায় প্রথম নাটকও লিখেছিলেন। এছাড়া লোককবিতায় সমৃদ্ধ ফিনিশীয় সাহিত্যভাণ্ডার। মারিয়া টার্টশানিনফ, ইঙ্গার-মারি আইকিও, মনিকা ফ্যাগারহোম প্রমুখ নামকরা ফিনিশীয় সাহিত্যিক।
খাওয়া, শুধুই খাওয়া
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ফিনিশীয়রা প্রধানত আমিষপ্রিয়। তবে আজকাল নিরামিষের প্রবণতাও দেখা যায়। বিভিন্ন ধরণের মাছ, মাংস, পাস্তা খেয়ে এরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। সকাল এগারোটা নাগাদ দুপুরের খাবার আর বিকেল পাঁচটা নাগাদ রাতের খাবার খাওয়াটা আমাদের বাঙালিদের না সইতে পারে। ওদের খুব সয়ে যায়। তবে খাবারটা গরম হওয়া চাই-ই চাই। ধর্মভেদে খাদ্যাভ্যাসে ফারাক চোখে পড়তে পারে। এশিয়ান, ইতালিয়ান খাবার এদের কাউকে কাউকে টানেও বেশ ভালোভাবেই।
মেনুতে দুধ কিংবা কফি চলে ব্যাপক। মদ খেতে পারে কেবল বয়েসীরা। কমবয়সের কারো কাছে এসব বেচাবিক্রি নিষিদ্ধ। মদ্যপ অবস্থায় কেউ গাড়ি চালাতে পারে না, জরিমানা গুনতে হয় বেশ বড় অঙ্কের।
শিক্ষানীতি? না স্বপ্ন?
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই উন্নত। সাত বছর বয়সের আগে কোনো বাচ্চাকে স্কুলের চৌকাঠ মাড়াতে হয় না সেদেশে। তার আগ পর্যন্ত সৃষ্টিশীল খেলাধুলায় মেতে থাকে তারা। পিঠে নেই সিলেবাসের গুরুভার বোঝা। স্কুলে গিয়েও ৪৫ মিনিট অন্তর খেলার জন্য তারা পায় আরও পনেরো মিনিট অতিরিক্ত সময়।
৯ বছর বাধ্যতামূলক শিক্ষাগ্রহণ শেষে চাইলে কেউ আরও পড়তে পারে, আবার নাও পড়তে পারে। এর মধ্যে শুধু একবার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বসতে হয় তাদের। হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস নেই ফিনদের। ফলে সৃষ্টিশীল মেধা সেদেশে বিকোয় ভালো। ফিনল্যান্ডে বেকারত্ব সমস্যা তেমন নেই। শতকরা ৭.৭ ভাগ লোক বেকার। বাকিদের অধিকাংশই বিভিন্ন সেবাখাতে কর্মরত। নারীপুরুষ নির্বিশেষে এক্ষেত্রে ফিনিশীয়রা সমান অধিকারই পায়।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকায় চোখ বুজে লেখা যায় ফিনল্যান্ডের নাম। ঘুরে দেখে আসবার আগ্রহ কেন তরতরিয়ে বাড়বে না? ছবির মতো সুন্দর আর স্বপ্নের মতো স্নিগ্ধ ওই বরফের দেশ আপনাদের টানছে তো? যাবেন নাকি নিজ চোখে হাজার হৃদের দেশ দেখতে?