খেলাধুলার ইতিহাস বহু পুরোনো। নির্মল বিনোদনের অন্যতম উৎস এটি। তবে খেলাধুলাকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা মূলত গ্রীসের। এরপর সময়ের পরিক্রমায় মানব ইতিহাসের বহু উত্থান পতন হয়েছে। সেই সাথে বদলেছে খেলাধুলার গতিপথও। আধুনিক বিশ্বের সব থেকে বড় এবং জনপ্রিয় দু’টি আসর হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেট। তবে উন্মাদনা বেশি চলে ফুটবলকে ঘিরেই।
এই আসরের ইতিহাসও বেশ পুরোনো। আজকের ফিফা তাদের প্রথম আয়োজনটি করেছিল প্রায় ৯০ বছর পূর্বে! ফিফা আয়োজিত প্রথম আসরে ১৯৩০ সালে বিজেতা হয় উরুগুয়ে। এরপর থেকে ৪ বছর পরপর এটি অনুষ্ঠিত হয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এটি বন্ধ ছিল। মোট ৩২টি জাতীয় দল এই আসরে অংশগ্রহণ করে।
১৯৩০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফিফা আয়োজিত এই আসরে ‘জুলেরিমে ট্রফি’ দিয়ে বিজেতা দলকে পুরস্কৃত করা হতো। এটির নামকরণ করা হয়েছিল একজন ফ্রেঞ্চ লোকের নামানুসারে যিনি এই টুর্নামেন্টটি প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৭০ সালে এটি তিনবার বিজয়ী দল ব্রাজিলকে (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০) স্থায়ীভাবে প্রদান করা হয়। নতুন কাপের নামকরণ করা হয় ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ। এই আসরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার বিজয়ী দল ব্রাজিল।
২০২২ এর বিশ্বকাপের মতো এত বিচিত্র আর ঘটনাবহুল বিশ্বকাপ বোধহয় আর দেখেনি পৃথিবী। বির্তকের শুরুটা হয়েছিল আয়োজক দেশকে ঘিরে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। অবহেলা জনিত কারণে হাজার হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর জন্যও দায়ী করা হয় তাদের।
পশ্চিমা বিশ্বসহ সকলকে তারা দিয়েছিল পোশাক-আশাকের বিধিনিষেধ। এজন্য পড়তে হয়েছে পশ্চিমাদের তোপের মুখে। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছে এই বহুল আকাঙ্ক্ষিত আয়োজন। অংশ নিয়েছে ৩২টি দেশ। মোট আটটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে খেলা।
শুরুতেই ধাক্কা! ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দুঁদে দলগুলোও তুলনামূলক ছোট দলগুলোর কাছে হেরে গিয়ে অনেক সমীকরণই বদলে দিল। পূর্বের সকল জল্পনা কল্পনা মিথ্যে করে দিয়ে বিশ্বকাপ এবার তার নতুন রং দেখাল। সম্ভাবনাময় দল হিসেবে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিল অনেক নতুন দল। আর শেষ পর্যন্ত টিকে রইল ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। অবিস্মরণীয় এক রাত। স্থান লুসেইল স্টেডিয়াম। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল খেলাটা বুঝি আর্জেন্টিনা একচেটিয়াই খেলছে। প্রথমার্ধে আলো ছড়াতে পারেনি ফ্রান্স। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে যখন ফ্রান্স প্রথম গোলটি দিল বদলে যেতে লাগল সমীকরণ। প্রতিপক্ষ ধাতস্থ না হতেই দ্বিতীয় গোল। এবার ২-২ এ সমতা হলো।
আসল খেলা শুরু সেখানেই। এরকমই টান টান উত্তেজনা। ছাড়ার পাত্র নয় কোনো দলই। অতিরক্তি সময়েও মীমাংসা হলো না। ৩-৩ এ এগিয়ে রইল দুই দলই। শেষ পর্যন্ত গড়ায় টাইব্রেকারে। ৪-২ গোলে অবশেষে জিতে যায় আর্জেন্টিনা।
তবে সম্ভাবনা ছিল উভয়েরই। শেষ হাসিটা হেসেছে আর্জেন্টিনা। ৩৬ বছর পর আবার তারা পেয়েছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। সেই সাথে লাতিন আমেরিকাও ২০ বছর পর কাপ নিজেদের ঘরে তোলার সৌভাগ্য অর্জন করল।
তবে ফ্রান্স হেরে গেলেও লড়াই করেছে বীরের মতো। রানার আপ দলের ‘কিলিয়ান এমবাপ্পে’ একেবারে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’-র মতো লড়ে গেছে। শীর্ষ গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন বুট জিতেছে সেই। খেলার আসল সৌন্দর্যটা ফুটে উঠেছে অনেকটাই তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে।
১৯৬৬ সালের পর এইবার আবার ফাইনালে কোনো খেলোয়াড়ের হ্যাট্রিক হলো। ৫৬ বছর পর জিওফ হার্স্টের উত্তরসূরী হিসেবে নাম লেখালেন এমবাপ্পে। তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান অধিকারী ক্রোয়েশিয়া আর মরক্কোও কম বিস্ময় উপহার দেয়নি। ফেয়ার প্লে পুরষ্কার জিতেছে ইংল্যান্ড।
ম্যাচটি নানা কারণে ঘটনাবহুল একটি ম্যাচে পরিণত হয়েছেন। হাফ টাইমের আগে এনজো ফার্নান্দেজের হলুদ কার্ড দর্শন, থিও হর্নান্ডেজের সঙ্গে সংঘর্ষে মেসির কানে আঘাত, ডি মারিয়াকে বক্সে আঘাত করায় পেনাল্টি প্রাপ্তি এই ঘটনাগুলো অনেকটাই বদলে দিয়েছে ম্যাচের গতিপথ।
গুঞ্জন উঠেছিল এটি লিওনেল মেসির শেষ ম্যাচ। কিন্তু জয়ের পর তিনি বললেন অন্য কথা। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল্ডেন বল বিজেতা আরো বিশ্বকাপ খেলতে চান। তার উদযাপন ছিল দেখার মতো। অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তের সাথী হয়েছিলেন খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরাও।
মার্টিনেজের উদযাপন ছিল দুষ্টু মিষ্টি অভিব্যক্তিতে ভরপুর। যদিও পরবর্তীতে সেটা নিয়ে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেছেন তো পরে।
এর আগেই গোল্ডেন গ্লাভসের মালিক জিতে নিয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়। আর্জেন্টাইন দলের এনসো ফার্নান্দেজ পেয়েছেন সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার।
৬৪টি ম্যাচে গোল হয়েছে মোট ১৭২টি। দর্শক সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪,০৪,২৫২ (ম্যাচ প্রতি গড়ে ৫৩,১৯১ জন)। গোটা বিশ্বের মহামারী মোকাবিলার পর এটিই ছিল সব থেকে বড় আয়োজন। তাই একে ঘিরে আগ্রহ উত্তেজনাও কম ছিল না। উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ছোট দলগুলোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপের মঞ্চকে রঙিন করার কৃতিত্ব অনেকটাই তাদের।
স্বাগতিক দেশ হিসেবে কাতারের আয়োজনও ছিল দেখার মতো। আয়োজক দেশ হিসেবে তারা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে। সেই সাথে নিজেদের দেশকে তুলে ধরার যে প্রয়াস সেটাও যথেষ্ট প্রশংসনীয়। অন্যরকম মুগ্ধতা ছড়িয়েছে জাপান। খেলার বাইরেও তারা তাদের আচরণ দিয়ে জয় করে নিয়েছে সকলের হৃদয়।
কোনো বড় আয়োজনের পুরোটা ঘিরে মানুষের আগ্রহ থাকলেও মূল উত্তেজনা থাকে চূড়ান্ত পর্বকে ঘিরে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চূড়ান্ত রকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর অনিশ্চয়তার পেন্ডুলামের দোলচাল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুগিয়েছে সকলকে। তবে এটিও ঠিক ফাইনালে এই উত্তেজনাটুকু না থাকলে আসলে মনে দাগ কাটতো না। খেলাও উপভোগ্য হতো না।
বিশতা পরিহিত মেসির মুখে খেলা করেছে এক অন্যরকম আলো। যে আলো একসাথে জয়, পরিশ্রম আর অধরাকে ছুঁতে পারার অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। এক সময় যাকে প্রতারক অপবাদও শুনতে হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় আজ সে বিশ্ব বিজেতা। তবে এ জয়ের পেছনে কারো অবদানই কম নয়। বরং নিজেদের রক্ষা করতে মার্টিনেজ নেমেছিলেন অতিমানবের ভূমিকায়। ফার্নান্দেজ, ডি মারিয়া আর দিবালারাও খেলে গেছেন নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে। দিনশেষে ঝুলি পরিপূর্ণ হয়েছেন সীমাহীন প্রাপ্তিতে। এ শুধু বিশ্বকাপ জয় নয় বরং বিশ্ববাসীকে জয়।
কাতার আয়োজিত এই বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে নানা কারণেই। এর সাথে জড়িয়ে আছে সহস্র মাইল দূরের এক ব-দ্বীপের অনুভূতিও। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পৌঁছে গেছে সুদূর আর্জেন্টিনাতে। সেই ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছে তারা। আর্জেন্টিনার সাংবাদিক দল এদেশের উদযাপন সরাসরি প্রচারের লক্ষ্যে সশরীরে হাজির হয়ে গেছে! খেলা যে সকল বিদ্বেষ দূর করে সকল প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে পারে তা প্রমাণ হলো আরো একবার। জয়তু বিশ্বকাপ! জয়তু ফুটবল!
Feature Image: dailysabah.com References: 01. World Cup Football. 02. World Cup Final Live Score Result Argentina vs France. 03. Argentina vs France World Cup 2022 Final.