ফেডএক্স: এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের গল্প

228
0

কুরিয়ার জগতে ফেডএক্সের নাম শুনেননি এমন মানুষের জুড়ি মেলা ভার! পণ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এই সংস্থাটি বেশ পুরোনো এবং ইতিহাস নির্ভর। ১৯৭১ সালে ফ্রেডেরিক ডব্লিউ স্মিথের হাত ধরে শুরু হয় এর যাত্রা। নানান চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজকের এই ফেডএক্স কীভাবে উন্নতি করলো বা এর দাঁড়ানোর পেছনে যেসব ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা নিয়েই আজকের বিস্তারিত আলোচনা।

ইতিহাস

ফেডারেল এক্সপ্রেস থেকে উৎপত্তি হয়েছে ফেডএক্স-এর। আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠান যা পৃথিবীর নামকরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের গর্বের স্থান তৈরি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পণ্য আদানপ্রদানের জন্য এটি একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা কিনা একসময় দেউলিয়ার পথে চলে গিয়েছিল।

শুনতে আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি। কিন্তু সফলতা লেখা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে, আর তাই হয়তো আজ সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাম করেছে। দেউলিয়া হতে হতেও ঘুরে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ, তা মাত্র পাওয়া যায় এই প্রতিষ্ঠান থেকেই।

একেক প্রতিষ্ঠান একেক সময় হারিয়ে যায়, ডুবে যায় তীরে। কিন্তু ফেডএক্স তার সাফল্যের জন্য লড়ে গেছে। আজকের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আয়ের হিসাব দেখাতে সক্ষম হয়েছে এরা। এর সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বেশ অদ্ভুত এবং মজার কিছু গল্প।

ফেডএক্স প্রতিষ্ঠান। Image Source: logo.com

আমেরিকার এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন স্মিথ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় ১৯৬২ সাল নাগাদ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক থিসিসের কাজে তিনি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার ওপর একটি থিসিস পরিবেশন করেন। সেই যুগান্তকারী থিসিসে তিনি এমন কিছু কথা উল্লেখ করেন যা তাকে গবেষণা করতে হয়েছিল দীর্ঘ সময় ধরে।

তিনি দাবী করেছিলেন, তার লেখা থিসিস যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে পণ্য সরবরাহের দিকটি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। স্মিথ শুধু ধারণাই দেননি, বরং সবার চিন্তাভাবনাকে পরিবর্তন করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

ফেডএক্সের দেউলিয়া হওয়ার পথের গল্প শুনলে যে কেউ চমকে যাবে। যে প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার ডলারের হিসাবনিকাশ রাখতো সেই প্রতিষ্ঠান এক সময় আয়ের পরিমাণ নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৫ হাজার ডলারে! কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও থেমে থাকেননি স্মিথ।

নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায়, শ্রম এসবের মিশ্রণেই স্মিথ পেরেছেন তার প্রতিষ্ঠানটিকে তুলে দাঁড় করাতে। ই-কমার্সের জন্য বিরাট এক আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো স্মিথের এই যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান ফেডএক্স!

ফেডএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ডব্লিউ স্মিথ। Image source: abovewhispers.com

কীভাবে দেউলিয়া হতে হতে বেঁচে গেল ফেডএক্স? 

একটা সময় হাজার হাজার মার্কিন ডলারের আয়ের প্রতিষ্ঠানটি একসময় ধস নেমে আসে তাদের প্রতিষ্ঠানে। ১৯৭১ সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি এক লহমায় ডুবে যায় সাগরে ডোবা মাঝির মতো। কিন্তু আশার আলো জ্বলবে এটাই হয়তো বিশ্বাস করেছিলেন স্মিথ।

পারিবারিক সুত্রে পাওয়া প্রায় চার মিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি ব্যাংক লোন নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান পূনরায় তার প্রতিষ্ঠানটিকে তুলে দাঁড় করাতে। সেই সময় ব্যাংক লোন নেয়া কোন চাট্টিখানি কথা ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন ছিল বেশকিছু পদক্ষেপ বা আইনীয় পদক্ষেপ যা স্মিথ খুব সহজেই নিতে পেরেছিলেন। তরীতে এসে ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থায় ঠিক তখনই এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেল।

তার প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য প্রয়োজন পড়লো বেশ কিছু বিমানের। কিন্তু একসাথে এতগুলো বিমান কেনাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্মিথের পরিচিত এক অফিস সেই সময় নিলামে বেশ কিছু বিমান বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেই সিদ্ধান্তটিই ছিল স্মিথের জীবনকে পাল্টে দেয়ার জন্য এক মোক্ষম সুযোগ।

১৯৭১ সালে এর কার্যক্রম শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ। তৎকালীন সময়ে আমেরিকার একটি পণ্য এক স্থান হতে আরেক স্থানে পরিবহণে বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। আর এখানে স্মিথের পরিকল্পনা ছিল সেই সময়কে কীভাবে কমিয়ে এনে সেবার মান উন্নত করা যায়। আর সেই পরিকল্পনাকেই কাজে লাগাতে শুরু করেন তিনি।

ফেডএক্সের কার্গো বিমান। Image Source: techcrunch.com

কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ করতে গিয়ে হারে হারে টের পেলেন কাজটি মোটেও সহজ নয়। কেননা এমন চেষ্টা ফেডএক্সের আগে আরো বহু প্রতিষ্ঠান করে হেরে গেছেন। বেশ জটিল কাজ হলেও দমে যাননি স্মিথ। ফেডএক্স বর্তমানে বেশ লাভবান প্রতিষ্ঠান হলেও প্রথম কয়েক বছর ছিল তাদের চরম দূর্ভোগের সময়। আয় তো দূর, এদের লোকসানের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছিল।

স্মিথ একটা সময় টের পেলেন আসলে এখানে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। টানা কয়েকটি পণ্য পরিবহণ করেও তাদের আয়ের পরিমাণ বাড়ছে না। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো দরজা বন্ধ করে পিছিয়ে যাননি। পণ্য পরিবহণ নিয়ে যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, সেই পরিকল্পনা খুব দ্রুত আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

আমেরিকার সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করে ফেডএক্স খুব অল্প সময়েই পণ্য পরিবহণ করতে সক্ষম। আর এই বিশ্বাসই ছিল স্মিথের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিরাট আশীর্বাদ! ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো এরা আয় করেন রেকর্ড মূলক ডলার যার পরিমাণ ছিল ৩.৬ মিলিয়নের কাছাকাছি। এবং এরপরই স্মিথ এবং তার তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান ফেডএক্সকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বর্তমানে সারা বিশ্বে অসংখ্য শাখা রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির। এমনকি বাংলাদেশেও রয়েছে এর শাখা যার সাহায্যে বেশ সহজেই বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য খুব সহজেই পরিবহণ করা যায়। এটি বেশ জটিল হলেও তা সহজই করে দিয়েছে স্মিথের এই প্রতিষ্ঠানটি।

ফেডএক্সে কর্মরত কর্মী। Image source: USA Today

ফেডএক্স কোম্পানিকে তুলনা করা যেতে পারে একটি ভেঙে পড়া কুঁড়েঘরের ন্যায়, যা শুরুতে ভেঙে পড়লেও শ্রম ও চেষ্টার বলে তা তুলে দাঁড় করানো সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বেশ কৌতুহলই ছিল আমজনতার। তাদের একটাই প্রশ্ন ছিল, পারবে তো উঠে দাঁড়াতে? তাদের জবাব দিতেই স্মিথ যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা!

জানা যায়, এক যুদ্ধে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বিরাট প্রভাব পড়ে ফেডএক্সের ওপর। শুরুতেই হোঁচট খাওয়া প্রতিষ্ঠানটি তখনও নিজেদের ধাক্কা সামাল দিতে পারছিল না এরিমধ্যে আমেরিকার তেল বিপর্যয়ে আরো যেন বিপর্যয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিল তারা। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরই পণ্য পরিবহণে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে লাগলো তারা। খরচ তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কোনরকম আশা পাচ্ছিলেন না স্মিথ।

কিন্তু এই সময় তিনি এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেন! প্রতিষ্ঠানটির আয়ের মাত্র ৫ হাজার ডলার একাউন্ট থেকে বের করে সোজা হাঁটা ধরেন লাস ভেগাসের দিকে। আর সেখানেই সারারাত ব্ল্যাক জ্যাক খেলে প্রায় ২৭ হাজার ডলার আয় করেন তিনি। আর সেই ডলার নিয়েই রওনা হোন তার নিজের শহরে।

আর তার এই দুঃসাহসিক কাজের তারিফ করতে গিয়েই অনেকে অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে বসেন তার দিকে। এবং স্মিথ এর জবাব সঠিকভাবেই দিতে পেরেছিলেন সেদিন। বর্তমানে ফেডএক্সে প্রায় ছয় লক্ষাধিক কর্মী কাজ করে যাচ্ছেন। এদের কাজ এবং পরিশ্রমের ফলেই এখন বিনা জটিলতায় এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফেডএক্সের পণ্য সরবাহ। Image Source: Fibre2Fashion

পতনের দিকে মুখোমুখি হলেও প্রতিষ্ঠানটি যে অবশেষে উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলো তা কেবল ফেডএক্সের ইতিহাস দেখেই বোঝা যায়। এই কোম্পানির বর্তমান মূল্য নিয়ে জানতে চাইলে জানা যায় এর বর্তমান মূল্য প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন ডলার! এবং এর বাৎসরিক আয় আশি বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে হার মানাতে সক্ষম!

ফেডএক্স মূলত এমনই এক প্রতিষ্ঠান যা ভেঙে পড়েও ঠিকই উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল। আর বিশ্বের ইতিহাসে এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা হয়তো বাজির বলেই বিশ্বজয় করে ঘরে ফিরতে পেরেছিল!

 

 

 

Featured Image: Post & Parcel
References: 

01. FedEx History
02. History of FedEx Corporation.