পৃথিবীতে দেশ ও জাতিভেদে দেখা মেলে হরেক ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। কিছু কিছু উৎসব বেশ উদ্ভট ধরনেরও হয়। ফামাদিহানা সেরকমই একটি উৎসব। বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে ছোট একটি দেশ মাদাগাস্কার। এটি আসলে একটি দ্বীপ। এই দেশেরই একটি অদ্ভুত উৎসবের স্থানীয় নাম ‘ফামাদিহানা’। কী হয়, কে বা কারা আমন্ত্রিত হয় এই উৎসবে? জানতে চান? এই বিচিত্র উৎসব সম্পর্কেই আজকের এই ফিচার।
ফামাদিহানা উৎসবের আদ্যপান্ত
ফামাদিহানার ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। নৃবিজ্ঞানীগণ ধারণা করেন যে, এটি ১৭ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক রেকর্ডের অভাবের কারণে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই এর উৎপত্তি বেশ রহস্যময়। তবে ঔপনিবেশিক শাসনামলে যখন খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে, তখন তারা এই প্রথার বিরোধিতা করেছিল বটে, কিন্তু স্থানীয় মানুষ কখনও এই প্রথা পালন থেকে সরে আসেনি বলে জানা যায়।
একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ফামাদিহানা পালিত হয়। এই উৎসবে পরিবারের জীবিত মানুষের পাশাপাশি যোগ দেয় মৃত মানুষেরাও। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, মাটির নিচ থেকে পরিবারের মৃত সদস্যদের মৃতদেহ উত্তোলন করা হয়, তারপর পুরো এলাকা ঘুরে সেই মৃতদেহ নিয়ে নাচ গান করা হয়।
যেহেতু একটি পরিবারের জীবিত ও মৃত সকল সদস্যকে উপস্থিত করা হয়, তাই প্রায় একবছর আগে থেকেই এই উৎসবের প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয় এবং প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া চলে। আফ্রিকায় মৃতদেহকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের লোকাচারের প্রচলন রয়েছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত লোকাচার মাদাগাস্কারের এই ‘ফামাদিহানা।’ প্রতি ৫ বা ৭ বছর অন্তর অন্তর ফামাদিহানা পালন করা হয়। ফামাদিহানা উৎসবের আয়োজন করা হয় সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। এই সময়ে মাদাগাস্কার দ্বীপে শীত থাকে।
সাধারণত, পরিবারের একজন বয়োজ্যৈষ্ঠ সদস্য স্বপ্নের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উৎসবের বার্তা পান। স্বপ্নে, মৃত পরিবারের সদস্য নতুন জামাকাপড় চায় কিংবা ঠাণ্ডা লাগছে বলে অভিযোগ করে। পরবর্তীতে যে স্বপ্ন দেখেছে সে জ্যোতিষীর পরামর্শে রাশিচক্র দেখার মাধ্যমে একটি তারিখ নির্বাচন করে। মৃত ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকীর উপর ভিত্তি করে তারিখ নির্বাচন করা হয় না। একবার সেই তারিখটি ঠিক হয়ে গেলে উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয় এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় ও কবর দেয়ার স্থান বা ক্রিপ্ট খুলে দেওয়া হয়। পায়ে হেঁটে উৎসবে যোগ দিতে আসেন বাকি সদস্যগণ।
মাদাগাস্কারে মানুষকে কবর দেয়ার নিয়মও বেশ অদ্ভুত। অধিকাংশ মানুষ তাদের পরিবারের জন্য দুটি কবর খনন করে। একটি কবরে থাকে পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য বরাদ্দ থাকে অপরটি পুরুষ সদস্যদের জন্য বরাদ্দ। নারীদের কবরে পুরুষদের শায়িত করা নিষেধ, ঠিক একইভাবে পুরুষদের কবরে নারীদের শায়িত করা নিষেধ। শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম শিথিল।
কবরের পেছনে মোটা অংকের টাকা খরচ করা হয়ে থাকে। এতই বেশি ব্যয় করে যে, তাদের বাড়ির চেয়ে মারা যাওয়া সদস্যদের কবর বেশি ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। তবে এর পেছনে যথেষ্ট কারন বিদ্যমান। মাদাগাস্কারে ধরে নেয়া হয়, যার বাড়ির সাথে সংযুক্ত কবর যত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও দামী, তার সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যও তত উঁচুতে।
ফামাদিহানার কিছু প্রথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পালন করা হয়। কিন্তু মাদাগাস্কারের মতো অন্য কোনো দেশ মৃতদেহ নিয়ে উৎসবটি উৎযাপন করে না।
উৎসবের তাৎপর্য
মাদাগাস্কারের পরিবারগুলো মনে করে যে এই উৎসবের মাধ্যমে তারা তাদের পুর্বপুরুষদের সাথে পুনরায় যোগাযোগ করতে পারে। উৎসব শুরু হলে কবর থেকে মৃত সদস্যদের কংকাল উত্তোলনের পর একদম নতুন সাদা রঙের চারকোণা কাপড়ে মুড়িয়ে নেয়া হয় এবং ম্যাটের উপর রাখা হয়। কবরগুলো যে স্থানে থাকে সেটিকে ক্রিপ্ট বলা হয়।
পরিবারের সদস্যরা ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরেন। কংকালের গায়ে জড়ানো কাপড় ও ম্যাটে সুগন্ধি মাখানো হয়। এভাবে তারা কাপড় ও ম্যাট ‘পবিত্র’ হয়েছে বলে ধরে নেয়। সবাই মোমবাতি নিয়ে লাশ উত্তোলন করার জন্য কবরের ভেতরে প্রবেশ করে।
লাশটি উত্তোলনের পর নাচ-গানের পর্ব শুরু হয়। সাদা কাপড়ে মোড়ানো কংকাল কোনোভাবেই মাটিতে পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। তাই যারা লাশবাহী ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন, তারা বেশ সতর্ক থাকেন।
সেখানকার মানুষেরা মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে সরানো কাপড়ে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। যারা গর্ভবতী হওয়ার চেষ্টা করছে তাদেরকে তাদের বিছানার নীচে মৃত মানুষের পুরানো দাফনের কাপড়ের টুকরো রাখতে বলা হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে করে দ্রুত সমস্যা সমাধান হবে এবং গর্ভে সন্তান আসবে।
যতদিন উৎসব চলে ততদিন মৃত সদস্যদের জন্য কান্না করা নিষেধ। এই উৎসবকে পারিবারিক মিলনমেলা বলা চলে। তবে অবশ্যই একটি ভিন্নধর্মী পারিবারিক মিলনমেলাও বটে! যেহেতু একটি পরিবারের জীবিত ও মৃত সদস্য মিলে বেশ অনেক মানুষের আতিথেয়তা করতে হয়। তাই অনেক আগে থেকে উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা হয় যাতে করে আতিথেয়তায় ব্যাঘাত না ঘটে।
যে বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করা হয় সে বাড়িতে অতিথিরা যখন আসে তখন আয়োজকদের চাল এবং টাকা দেয়। আয়োজকরা ‘টমপন ড্রাহারাহা’ নামে পরিচিত। টাকা ও চালের যে পরিমাণটুকু লিপিবদ্ধ করা হয় তা ‘ আতেরো কা আলাও’ নামে পরিচিত। যার আক্ষরিক অর্থ ‘কিছু দেওয়ার বিনিময়ে কিছু ফেরত নেওয়া।’ কী কী দেওয়া হয় তা তো জানলেন, কিন্তু কী ফেরত দেওয়া হয় তাহলে? ফেরত দেওয়া হয় মৃত প্রিয় সদ্যস্যদের সাথে কিছু আনন্দঘন মুহুর্ত!
জীবিত পরিবারের সদস্যরা মৃতদের সাথে বর্তমানে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করে। এছাড়াও তারা তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য মৃত ব্যাক্তিদের কাছে সাহায্য চায়। তারা মৃত ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং সম্পদের পরিমাণও জিজ্ঞাসা করে। মৃতদেহগুলো যখন উত্তোলন করা হয়, সেই সময়ে পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা পরিবারের ছোট সদস্যদের তাদের পূর্বপুরুষদের গল্প শুনিয়ে থাকে। এসব গল্প শুনতে পরিবারের লোকজন লাশের কাছে ভিড় জমায়।
পরিবারের প্রধান কর্তা পশু উৎসর্গ করে থাকেন। উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। আপ্যায়নের পর থেকে যাওয়া মাংস স্থানীয় দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। ২-৭ দিনের এই উৎসবে প্রচুর মদ্যপান হয়। যারা লাশ উত্তোলন করে এবং যারা লাশ কাঁধে নিয়ে নাচে, সবাই মদ্যপান করে। মৃতদেহ যে ম্যাটে বহন করা হয়েছিল, সেটি উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা বিদায়বেলায় স্পর্শ করেন। সবশেষে আয়োজক পরিবার ম্যাটটি নিজের বাড়িতে রেখে দেয়। কারণ, তারা মনে করে যে এটি পরিবারের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ফামাদিহানা উদযাপনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। পতনের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, ফামাদিহানের আয়োজন করা ব্যয়বহুল। দ্বিতীয়ত,মৃত ব্যক্তির জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা এবং মৃতদের জন্য কবরে উপহার দিতে হয়। যা অনুষ্ঠানের খরচ বাড়িয়ে দেয়।
Feature Image: newsweek.com
Reerences: