পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার এবং বিলাসবহুল দেশ হিসেবে আমেরিকার নামই সবার প্রথমে আসে। সারা বিশ্বে রাতের আঁধার নামলে সব দেশের শহর ঘুমিয়ে আসে আর এই আমেরিকার শহরগুলো যেন জীবিত হয়ে উঠে নিজেদের মতো। ভ্রমণপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় তাই সর্বপ্রথম সারিতে রয়েছে এই দেশের নাম।
আমেরিকার প্রাণ নিউইয়র্কের ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তুলেছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে স্থাপিত ‘ব্রুকলিন ব্রিজ’! ব্রুকলিন ব্রিজটি আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত। পুরো পৃথিবীতে এক বিষ্ময়কর ব্রিজ এটি। তবে ব্রুকলিন ব্রিজটি কিন্তু এমনি এমনি গড়ে উঠেনি। এটি গড়ার পেছনেও রয়েছে এক ইতিহাস।
ব্রুকলিন ব্রিজ একটি ঝুলন্ত সেতু। আমেরিকায় উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা হিসেবে খ্যাত এই ব্রিজটি। এই ব্রিজ তৈরির পেছনে রয়েছে এক বিশাল ইতিহাস। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে অবস্থিত এই ব্রিজ নিয়ে আজ জানবো জানা-অজানা বেশ কিছু চমকপ্রদ কথা।
ব্রুকলিন ব্রিজের জন্মকথা
যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটির ইতিহাস বেশ পুরোনো। নিউইয়র্কের সবচেয়ে জনবহুল এবং জনপ্রিয় শহর ম্যানহাটন থেকে একদম কাছে এই ব্রিজের অবস্থান। ব্রুকলিন ব্রিজ ছাড়াও অসংখ্য সেতুর আনাগোনা থাকলেও এই সেতুটির তৈরি করা নিয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে। এই শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবে এই ব্রিজকেই ধরা হয়ে থাকে।
প্রায় ১৪ বছর ধরে নির্মাণ কাজ চলতে থাকা এই ব্রিজের প্রতি মানুষের যেন আগ্রহের কমতি ছিল না এতটুকুও! এই ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন গাড়িসহ হাজারো মানুষের হাঁটা এবং আনাগোনা। মানুষ যেন হেঁটে ব্রিজের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে সেজন্য সেখানে ব্রিজটির একপাশে হাঁটার মনোরম জায়গা করে দিয়েছেন। নিউইয়র্কের ইস্ট নদী এবং অন্যান্য শহর উপভোগ করার জন্য এই ব্রিজটিকে স্বাচ্ছন্দ্যে বেছে নেন লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ।
আমেরিকাতে স্থাপিত এই ব্রিজটির উচ্চতা প্রায় ২৭২ ফুট বা (৮২.৯ মি)। আমেরিকাতে এর আগে অনেক ব্রিজই ছিল, কিন্তু এদের স্থাপত্যশৈলী ততটা মজবুত ছিল না। ভারী যানবাহন হরহামেশা চলাচলের কারণে ব্রিজের পিলার অনকসময়ই ফেটে যেতো বা নদীর তীব্র স্রোতে ভেঙে নিয়ে যেতো। আর এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ম্যানহাটন থেকে ইস্ট নদীর সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা আঁটেন তৎকালীন স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার জোনাথন অগাস্টাস রোবলিন।
তিনি নিউইয়র্কের ইঞ্জিনিয়ার হলেও তার আদিবাস ছিল জার্মানে। রোবলিং পরিবারের এই ছেলে নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে পাড়ি দেন আমেরিকাতে, পরে নিজের কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নেন নিউইয়র্কের মতো শহরকে।
১৮৭০ সালের দিকে তার মনে হলো নদী পারাপারের জন্য সাধারণ ফেরি চলাচল সুবিধাজনক নয়। কেননা ঝড়-বৃষ্টিতে অনেকসময়ই তাতে আশঙ্কাজনক অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো। একেক সময় দেখা যেতো অনেকে দারুণভাবে আহতও হচ্ছেন। আর ঠিক এই চিন্তা থেকেই তার মাথায় আসে ম্যানহাটনের মতো এত বড় একটি শহরে ইস্ট নদী পারাপারের জন্য একটি ব্রিজের দরকার।
ইস্ট নদীর মতো বিশাল এই নদীতে তখনকার সময়ে ব্রিজ নির্মাণের কথা চিন্তা করাও সাহসের ব্যাপার ছিল। তবু সাহসী ইঞ্জিনিয়ার রোবলিং সিদ্ধান্ত নেন তিনি ম্যানহাটন এবং ইস্ট নদী পারাপারের সুবিধা করে দিতে এক ব্রিজ নির্মাণে হাত দিবেন।
রোবলিং তার এই পরিকল্পনাটি তৎকালীন সময়ের আরও বেশকিছু ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে আলাপ-আলোচনা করলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন তারা! কেননা রোবলিং যে ডিজাইন তৈরি করেছিল সেই সময়ে এই ডিজাইনে ব্রিজ নির্মাণ করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই ডিজাইনে তখন এর আগে কোন ব্রিজ নির্মাণ হয়নি বলেই অন্যরা কাজটিকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেও আগাম বার্তা দেন।
একজন ইঞ্জিনিয়ার তো বলেই বসেন যে এই ব্রিজ নির্মাণের সময় মাঝ নদীতেই ভেঙে পড়বে। চারপাশ থেকে তখন ছুটে আসতে থাকে কঠিন সমালোচনার ঝুড়ি! কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে জেদ ধরা রোবলিং কারো কথাতেই দমে যাননি, বরং সাহস নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক ডিজাইনের পরিকল্পনা নিয়েই আগাতে থাকেন তার ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্তে।
ব্রুকলিন ব্রিজ একটি ক্যাবল বিশিষ্ট ঝুলন্ত ব্রিজ, যা ইস্ট নদীতে স্থাপনে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ ছিল। রোবলিং ১৮৭০ সালের দিকে এই ব্রিজের কাজ শুরু করেন। সাসপেনশন ধরনের এই ব্রিজটি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি কষ্টসাধ্য ছিল স্রোতস্বিনী নদীতে এর পিলার স্থাপন করা।
পুরো ব্রিজকে ধারণ করার জন্য এই পিলার দুটি ছিল মোটামুটি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ, কেননা হাজার হাজার যানবাহন, মানুষ এসব কিছুই ধারণ করার ব্যাপারটি নির্ভর করে এই পিলার দুটির উপর। আর এই পিলার দুটি নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল যে এটি মাঝ নদীতে ভেঙে না যায়! আর ভারী ভারী যানবাহন চলাচলে এটি ভেঙে পড়ার ভয় রোবলিং সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিজ নির্মাণে যে ধাতুর তার ব্যবহার করা হয় তাতে সে তামা কাজে লাগাবে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটা কারণ হচ্ছে, সেই সময়ে ব্রিজ নির্মাণে লোহা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু রোবলিং-এর চিন্তা ছিল দীর্ঘদিন এটি ব্যবহারে লোহায় মরচে ধরে যেতে পারে যা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আর এতে করে ভবিষ্যতে ব্রিজে বেশ বড় ধরনেরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো।
এক কথায়, এই ব্রিজ নির্মাণকালে ঝুঁকি নেই এমন কিছুর বাদ ছিল না। এমনকি যারা পিলারের ভিত্তি স্তরের কাজ করতো পানির প্রবল চাপে তাদের বেশ কিছু শারীরিক ত্রুটিও দেখা দেয়। কিন্তু তাতে দমে যাননি তারা। চলতে থাকে অসম্ভব সুন্দর এই ব্রিজের নির্মাণকাজ।
তবে একটি দুঃসংবাদ যে, ব্রিজটি নির্মাণের আগেই রোবলিং ব্রিজের কাছাকাছি এক ফেরি তাকে আঘাত করার কারণে আহত হয়ে বেশ কিছুদিন পরে মারা যান! এই হতাহত নিয়ে জানা যায়, ফেরি তাকে আঘাত করার পর রোবলিং পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পান। তাকে সবাই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে বললে সে সেটা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর পরিবর্তে ‘ওয়াটার থেরাপি’ নিতে থাকেন।
এই সময় তার পায়ে অনবরত পানি ঢালা হতো। কিন্তু এই সামান্য থেরাপি তার আঘাতকে সয়ে দিতে পারেনি। সুস্থ তো হননি, বরং অবস্থার চরম অবনতির ফলে এর তিন সপ্তাহ পরে তার মৃত্যু হয়। ব্রিজ নির্মাণের কাজের ভার নেন রোবলিনের ছেলে, যে নিজেও একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
ওয়াশিংটন অগাস্টাস রোবলিং শুরু করেন তার পিতার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ ব্রিজের নির্মাণকাজ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ব্রিজের নির্মাণকাজে অগাস্টাসকে প্রায়ই পানির নিচে কাজ করতে হতো। আর দীর্ঘসময় পানির নিচে কাজ করার জন্যে তার দেহের একপাশ অবশ হয়ে যায়। যার কারণে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়।
এসময় তাকে সাহায্য করেন তার স্ত্রী এমিলি ওয়ারেন রোবলিং। ব্রিজ নির্মাণের জন্য সে প্রচুর পড়াশুনা করতে শুরু করেন। এবং এক সময় নিজেই দায়িত্ব নেন এই নির্মাণকাজ শেষ করার। এরপর দীর্ঘদিন কাজ চলার পর প্রায় ১৪ বছর পর ১৮৮৩ সালে সর্বশেষে ব্রিজের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়।
ব্রিজ নির্মাণের পর অনেকেরই ভয় ছিল যে এটি সহজেই ভেঙে পড়বে। আর তাই ব্রিজটিকে পরীক্ষা করার জন্য একসাথে প্রায় বিশটি হাতি ছেড়ে দেয়া হয়। এতে করে ব্রিজে কোনরকম অসুবিধা বা অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। আর এই পরীক্ষায় সফল হওয়ার পরই সাধারণ মানুষের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়!
এই ব্রিজ নির্মাণকালে কত খরচ হয়েছিল? এই প্রশ্নের জবাবে জানা যায়, প্রায় ১ কোটি ৫৫ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল সেই সময় যার বর্তমান মূল্য হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় ৪১ কোটি ৬৬ লক্ষ ডলার! অর্থের পাশাপাশি রোবলিং, তার ছেলে এবং তার স্ত্রীর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
শুধুমাত্র একটি ব্রিজ নির্মাণের পেছনে সাহস, আবেগ এসব তাদের অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এই ব্রিজ একটি চমৎকার স্থাপনা হয়েই বেঁচে আছে এবং থাকবে সারাজীবন!
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Brooklyn Bridge. 02. Brooklyn bridge.