নরওয়ে: মধ্যরাতে সূর্যের দেখা মিলে যেখানে!

835
0

দিনের বেলা আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ধরুন, মধ্যরাতে আপনি বাড়ির বাইরে জরুরি কাজে বের হয়েছেন। বের হয়ে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনার পিলে চমকে উঠল! আকাশে সূর্য যেন ডুবে না গিয়ে ঝুলে রয়েছে। মধ্যরাতে চাঁদের আলোর পরিবর্তে সূর্যের আলোয় আপনি রাস্তায় হাঁটছেন! সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত কমলা আলোকরশ্মিতে আলোকিত হয়ে আছে দিগন্ত। অপার্থিব সেই আলোর আভায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে প্রকৃতি, চারপাশ।

অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে, নরওয়েতে এরকমটাই দেখা যায়; তাও আবার হরহামেশাই। তাই এটি কোন অবাস্তব কিংবা অতিপ্রাকৃত ঘটনা না। কিন্তু আপনার মনে নিশ্চয় এই প্রশ্ন জেগেছে যে এরকমটি কেন হয়? তাই না? তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক নরওয়ে সম্পর্কে! 

নরওয়ের আদ্যোপান্ত

উত্তর ইউরোপে অবস্থিত নরওয়ে দেশটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উপদ্বীপের পশ্চিমের অর্ধেক জায়গা দখল করে আছে। এদেশের পূর্বে সুইডেন, দক্ষিনে ফিনল্যান্ড এবং পশ্চিমে রাশিয়া অবস্থিত। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটি রাজতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত। নরওয়ের আয়তন ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৫২ বর্গ কিলোমিটার।  

নরওয়ের লোকেশন; Image Source: Encyclopedia Britannica

২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৫৪ লক্ষ ২৫ হাজার। নরওয়ে উত্তর ইউরোপের ফেনোস্ক্যান্ডিয়ান শিল্ডের মধ্যে স্থান দখল করে আছে। ফেনোস্ক্যান্ডিয়ান শিল্ড অত্যন্ত শক্ত বেডরক, যার বেশিরভাগই গ্রানাইটের সমন্বয়ে তৈরি। তাপ এবং চাপের দ্বারা গঠিত উপাদান নিয়ে নির্মিত। ধারণা করা হয়, এর বয়স এক থেকে দুই বিলিয়ন বছর।

এই দেশের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। রূপকথার গল্পের মতোই সুন্দর নরওয়ে। আছে সমুদ্রখাত, অরোরা বলিয়ারিস, তুষার ঢাকা বিশাল মালভূমি এবং অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা। প্রকৃতির পাশাপাশি আছে আধুনিক শহরের উপাখ্যান। 

বিশ্বজুড়ে নরওয়ে শান্তির দেশ হিসেবেও পরিচিত। প্রতি বছর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে (১০ ডিসেম্বর) অসলোর বিশ্ববিখ্যাত সিটি হল থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। শান্তির প্রতীকস্বরূপ অসলোর জাহাজবন্দরে একটি শিখা চিরপ্রজ্বলিত করে রাখা আছে সেখানে।  

নিশিথ সূর্যের দেশ নরওয়ে 

কেন নরওয়েকে নিশিথ সূর্যের দেশ বলা হয়? কী এমন কারণ আছে এর পেছনে? উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এই দেশে দিনশেষে দিগন্তের ওপারে সূর্য টুপ করে হারিয়ে যায় না। বরং স্থির হয়ে থাকে। ফলে দিনের ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো পাওয়া যায়। কখনো কখনো সূর্য ডুবলেও তা মাঝরাত্রে ডুবে। 

নিশিথ সূর্যের দেশ নরওয়ে; Image Source: Unsplash.com

ভোরে আবার সূর্য উদিত হয়। কারন যে সকল অঞ্চল সমুহের উপর টানা ২৪ ঘন্টাই সূর্য দিগন্ত রেখার উপরে থাকে, ঐ সকল অঞ্চল সমূহ ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো পেয়ে থাকে। 

একইভাবে সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নিচে অবস্থান করে তখন ঐ অঞ্চল সমূহে ২৪ ঘন্টাই রাতের অন্ধকার থাকে। প্রকৃতির এই আশ্চর্যজনক ঘটনাকে হোয়াইট নাইট বা শ্বেত রাত্রি বলা হয়। নরওয়ে ছাড়াও আরও কিছু দেশে এরকমটি ঘটতে দেখা যায়। যেমনঃ সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ড। 

নরওয়ে সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য

এমন দেশের কথা শুনে ভ্রমণের শখ হবে না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। তবে ভ্রমণের পূর্বে আপনাকে নরওয়ে সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে হবে। যেমন –  

১/ নরওয়ে একটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ

নরওয়ে ইউরোপের একটি দেশ হলেও এই দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল ৩টি নরডিক দেশ নিয়ে গঠিত। নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং সুইডেন। যা ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত। 

২/ নরওয়ের রাস্তায় পোলার বিয়ার ঘুরে না

নরওয়ে নিয়ে আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, নরওয়ের রাস্তায় পোলার বিয়ার ঘোরাঘুরি করে। যা একদম ভুল ধারণা। নরওয়ের প্রধান শহরগুলোতে পোলার বিয়ারের দেখাই মিলে না। তবে উত্তর দিকের অংশে মানুষের থেকে পোলার বিয়ারের সংখ্যাই বেশি। 

৩/ নরওয়ের মুদ্রার নাম নরওয়েজিয়ান ক্রোন

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নরওয়ে ঘুরতে আসেন অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকে মনে করেন নরওয়েতে ইউরো ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু তা মোটেও নয়। বরং নরওয়ের নিজস্ব মুদ্রা আছে যা নরওয়েজিয়ান ক্রোন বা নক (NOK) হিসেবে পরিচিত। 

নরওয়েজিয়ান ক্রোন; Image Source: norwaytravelguide

এছাড়াও, নরওয়ের বাসিন্দারা কেনাকাটায় ক্যাশ মানির তুলনায় ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এমনকি বার্গার, হটডগ ইত্যাদি ছোটখাটো খাবার কিনতেও সেখানে কার্ডের ব্যবহার বেশি হয়। 

৪/ অধিকাংশ নরওয়েজিয়ান ইংলিশে কথা বলে

আপনি নরওয়ে ঘুরতে যাবেন কিন্তু নরওয়ের ভাষা পারেন না? তাহলে কোন ভাষায় কথা বলবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন? চিন্তার কোন কারন নেই! এখানের অধিকাংশ মানুষই ইংরেজিতে কথা বলে। তাহলে, আপনি ইংরেজি পারলেই যথেষ্ট। 

৫/  নরওয়েতে ৪টি ঋতু  

নরওয়েতে ৪টি ঋতু বিদ্যমান। গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত এবং বসন্ত। আপনার হয়ত মনে হতে পারে ওখানে ঘুরতে যাওয়ার আগে কেন ওখানকার ঋতু সম্পর্কে জেনে যাবেন। কিছু কিছু দর্শনীয় স্থান আছে যা আপনি সারাবছর খোলা পাবেন না। বিশেষত শীতকালে। তাই আপনি যদি সেই স্থানগুলো ঘুরতে যেতে চান তবে নরওয়েতে যখন শীতকাল আপনাকে ঐসময়টি এড়িয়ে চলতে হবে। 

৬/  ঘুরতে এসে বেশি পরিমাণে শীতবস্ত্র সাথে আনবেন

নরওয়েতে খুব বেশি এবং খুব দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে আপনি যদি এখানে ঘুরতে এসে হাইকিংয়ের ইচ্ছা থাকে তাহলে তো অবশ্যই বেশি করে বিভিন্নধরনের শীতবস্ত্র সাথে রাখবেন। এমনকি গ্রীষ্মকালেও বৃষ্টির জ্যাকেট সাথে করে আনতে ভুলবেন না। 

৭/  বাহিরে খাবার খেলে খরচ বেশি হবে 

নরওয়েতে ঘোরাঘুরি করতে এমনিতেই অনেক খরচ হয়ে যায়। তবে এই খরচ আরও কমানোর উপায় হল নরওয়ের হোটেল এবং রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না। কারণ, এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের দাম আকাশচুম্বী। এছাড়াও, অন্যান্য দেশের মতো এখানে বাহিরের খাবার খাওয়ার সংস্কৃতি একদমই নেই।

তাই আপনি যদি লোকাল সুপারমার্কেট থেকে খাবার কিনে এনে রান্না করে খান তবে আপনার ভ্রমণ খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারবেন। তবে আপনার যদি খুব বেশি ক্ষুধা লাগে অথবা তাড়াহুড়ো থাকে তবে আশেপাশে অবস্থিত যে কোনো গ্যাস স্টেশন চলে যাবেন ওখানে কম খরচে বার্গার, হটডগ পাবেন। যার কোয়ালিটি নামীদামী রেস্টুরেন্টগুলোর মতোই। 

৮/ অধিকাংশ দর্শনীয় স্থানেই বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারবেন 

নরওয়ের ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করতে পারবেন একদম ফ্রিতে! এখানে ঘুরতে কোন প্রবেশমূল্য দিতে হবে না। এছাড়াও,  যে কোনো পাবলিক প্রোপার্টি সবার জন্য উন্মুক্ত।  

৯/ উত্তর এবং দক্ষিণ নরওয়ের মধ্যে রয়েছে বিশাল দূরত্ব 

অনেকেরই ধারণা যে নরওয়ে একটি ক্ষুদ্র দেশ। নরওয়ে আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও একেবারেই ক্ষুদ্রও না। আকৃতিতে লম্বা এই দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যেও আছে বেশ ভালো দূরত্ব।  

যে যে স্থান ঘুরবেন  

নরওয়েতে ভ্রমণ করতে গেলে যে যে স্থানগুলো অবশ্যই ঘুরে আসবেন। সেগুলো হচ্ছে-

লোফুটেন

লোফুটেন; Image Source: Unsplash.com

নরওয়ের সৌন্দর্যের আধার হিসেবে পরিচিত লোফুটেন দ্বীপপুঞ্জ, যা উত্তর নরওয়েতে অবস্থিত। এখানে আছে বেলাভূমি, পর্বত খাড়ি, জেলেদের গ্রাম যা দেখতে ঠিক যেন ছবির মতন। এখানে একটি ভাইকিং মিউজিয়াম আছে যা ভাইকিংদের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। 

বারগেন

আপনি যদি সামুদ্রিক খাবার খেতে ভালোবাসেন তবে চলে যাবেন বারগেনে। সেখানে পাবেন টাটকা সামুদ্রিক মাছ। এছাড়াও আছে মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারি। 

এছাড়াও নরওয়েতে দেখার মতো রয়েছে আরও অনেককিছু। যেমন: পোলারিয়াস সেন্টার, পোলার মিউজিয়াম, অসলো অপেরা হাউজ, অসলো সিটি হল, বাকল্যান্ড,ট্রনধেইমে  অবস্থিত সেইন্ট ওলাভ চার্চ, রেইনের গ্রাম, পালপিট রক হাইকিং ইত্যাদি। 

 

Feature Image: Unsplash.com
তথ্যসূত্রঃ 

  1. beautiful-places-norway-visit
  2. Norway
  3. norway-visit
  4. 17-things-you-need-to-know-before-visiting-norway